|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
ভাগ করলে ভাগ হতে হয়
20 March 2017, Monday
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না।’ বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নামে একদা পরিচিত মহাশক্তির অধীশ্বর ব্রিটেনের বর্তমান অবস্থা দেখে এখন এই প্রবাদটি স্মরণ করতে হয়।
সাম্রাজ্যহারা ব্রিটেন তবু এতকাল ধরে গ্রেট ব্রিটেন নামটি টিকিয়ে রেখেছে। ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড, নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড- এই চারটি রাজ্যের ইউনিয়নভুক্তির ফলে এই গ্রেট ব্রিটেন নামের উৎপত্তি।
নইলে ইউরোপীয় দেশ হয়েও ইংল্যান্ড ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন একটা ক্ষুদ্র দ্বীপ।
বর্তমানে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিতে ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে প্রবণতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা ঠেকাতে পারলে ইংল্যান্ড কি আবার তার ক্ষুদ্র দ্বীপের অস্তিত্বে ফিরে যাবে? ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্রিটেন নিজেই তাদের যুক্তরাজ্য বিযুক্ত করার ঝুঁকি নিয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
লক্ষণীয় ব্যাপার আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান তুলে যেমন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, ব্রিটেনে তেমনি গণভোটে ব্রেক্সিট গৃহীত হওয়ায় ব্রেক্সিটবিরোধী ক্যামেরনকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছেন থেরেসা মে’ও। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগানের মূল কথা বহির্বিশ্বের স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত রাখার চাইতে আমেরিকাকে তার নিজস্ব স্বার্থরক্ষার কাজে-কর্মে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। তেমনি ব্রিটেনের ব্রেক্সিটপন্থীদের মূল কথা, ব্রিটেনের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করা।
ব্রেক্সিটপন্থীরা বহুকাল ধরেই অভিযোগ করে আসছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনের অধীনে ব্রিটেনের নিজস্ব বহু আইন অচল হয়ে যাচ্ছিল এবং তাতে ব্রিটেনের সার্বভৌমত্ব গুরুতরভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়ে ব্রিটেনের যে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত লাভ হয়েছে, ইউরোপীয় অধিবাসীদের ঢালাওভাবে ব্রিটেনে এসে বসবাস এবং বিভিন্ন সামাজিক সুযোগ-সুবিধায় আধিপত্য বিস্তারের ফলে তা শুধু ক্ষুণœ হয়নি, মারাত্মকভাবে ব্রিটেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ব্রেক্সিটবিরোধীরা এই অভিমতের বিপরীত ধারণা পোষণ করেন। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি যেমন আমেরিকান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ফলে দ্বিধাবিভক্ত করেছে; তেমনি ব্রেক্সিটের পক্ষে গণভোটও ব্রিটিশ জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করে ফেলেছে। শুধু জনগণকে নয়, ব্রিটেনের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল টোরি এবং লেবার পার্টিও ব্রেক্সিট প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত। গণভোটে ব্রেক্সিটপন্থীরা সামান্য ভোটে জয়লাভ করেন। বর্তমানে বড় মিডিয়াগুলো ভোল পাল্টে ব্রেক্সিটের পক্ষের গণভোটের রায়কে গুরুত্বহীন করে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে।
গণভোটের রায় বহাল থাকুক, আবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গেও একটা শক্ত সম্পর্ক থাকুক, এই ধরনের একটা মনোভাব এখন ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে গড়ে উঠছে। ব্রিটিশ রাজনীতিতে সবচাইতে নিন্দিত ব্যক্তি সাবেক লেবার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ব্রেক্সিটবিরোধী একটা ফর্মুলা প্রকাশ করে ব্রিটিশ রাজনীতিতে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছেন। গণভোটে ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় গেলেও এর কট্টর সমর্থক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মেও ভালোভাবে জানেন, ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্নতা ব্রিটেনের অর্থনীতিতে একটা বড় রকমের ধাক্কা সৃষ্টি করবে। পাউন্ডের দরপতন তার প্রমাণ।
এই ধাক্কা সামাল দেয়ার জন্যই তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হতে না হতেই ওয়াশিংটনে ছুটে গিয়েছিলেন, আমেরিকার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে। অর্থাৎ ইউরোপ ছাড়লে ব্রিটেনের যে ক্ষতি হবে সেটা আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে পুষিয়ে নেবেন। তাতে ব্রিটেনের ক্ষতি কতটা পুষবে সে সম্পর্কে তার সমালোচকরা সন্দেহ পোষণ করছেন। তারা বলছেন, থেরেসা মে’র সরকারের নীতি হল, ইউরোপের ভারবাহী হয়ে না থেকে আমেরিকার গলদগ্রহ হয়ে থাকা। এই নীতি কাজ দেবে না।
সে যাই হোক, নানা বিতর্ক, সন্দেহ, অবিশ্বাসের মধ্যেও গত ১৩ মার্চ সোমবার ব্রেক্সিট বিলটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়েছে। এবার শুরু হবে ইউর সঙ্গে সম্পর্ক গুটিয়ে নেয়ার পালা। কিন্তু সে কাজটি কি সহজে হবে, না গ্রেট ব্রিটেনের অখণ্ডতাই ঝুঁকির মধ্যে পড়বে- সে প্রশ্ন এখন বিরাটভাবে দেখা দিয়েছে। স্কটল্যান্ড বরাবরই ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। তারা ব্রিটেনের সঙ্গে যেমন যুক্ত থাকতে চায়, তেমনি ইউরোপের সঙ্গেও দৃঢ় সম্পর্ক রাখার পক্ষপাতী। তাতে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও অধিকারের সুরক্ষা হবে বলে তাদের ধারণা। এই ধারণা থেকেই তারা ইংল্যান্ড থেকে স্বতন্ত্র হওয়া সম্পর্কিত গণভোটে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার পক্ষে রায় দিয়েছিল। এখন ব্রিটেন ইউরোপ ছাড়তে চাওয়ায় তারা ইউরোপে থাকার জন্য ব্রিটেন ছাড়তে চায়।
স্কটিশ ফার্র্স্ট মিনিস্টার নিকোনা স্টার্জিওন ব্রিটেনের সঙ্গে স্কটল্যান্ডযুক্ত থাকবে, না ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এই প্রশ্নে আবার গণভোট দাবি করেছেন। এই দাবি নিয়ে তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র সঙ্গে তুমুল বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন। ব্রিটেন ও স্কটল্যান্ডের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত। অন্যদিকে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের শক্তিশালী দল সিনসীন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট দাবি করেছেন। দলের নেতা বলেছেন, তারা ব্রেক্সিট চান না বরং দুই আয়ারল্যান্ড ইইউতে থাকবে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এই দাবিরও তীব্র বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু তিনি বা ইউরোপ থেকে বেরিয়ে আসা ব্রিটেন কি দীর্ঘকাল স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবি মোকাবেলা করে চলতে পারবেন? যদি না পারেন তাহলে ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রেট ব্রিটেনও ভাগ হয়ে যাবে। আর তখন দেখা দেবে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।
সাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীশ্বররা বহুকাল পৃথিবী শাসন করেছেন সাম্রাজ্যভুক্ত দেশগুলোকে ভাগ করার নীতি দ্বারা। উরারফব ধহফ ৎঁষব, অর্থাৎ ভাগ করো এবং শাসন করো এই ছিল তাদের নীতি। এই নীতি অনুসরণ করে তারা প্রথম মহাযুদ্ধের পর অটোমান এম্পায়ার বা ওসমানিয়া সাম্রাজ্যকে নিষ্ঠুরভাবে ভাগ করে মধ্যপ্রাচ্যে ছোট ছোট রাষ্ট্র তৈরি করেছে এবং এই রাষ্ট্রগুলোর শাসকদের মধ্যে বিবাদ জিইয়ে রেখে এই অঞ্চল শাসন ও শোষণ করেছে। এই ভাগাভাগির কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে এখনও চলছে রক্তাক্ত সংঘর্ষ।
একইভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষ ভাগ করেছে, আয়ারল্যান্ড ভাগ করেছে। অর্থাৎ পৃথিবীর যে অঞ্চলেই তারা গেছে, সে অঞ্চলকে ভাগ করা এবং বিভক্ত জনগণের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে রাখা ছিল তাদের সফল সাম্রাজ্যবাদী নীতি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস; সেই বিভক্তির ছুরি দ্বারা আজ গ্রেট ব্রিটেনের নিজেরই বিভক্ত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। বাংলা প্রবাদটির এখানেই সার্থকতা, ‘ভাগের মা গঙ্গা পায় না।’
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গড়ে ওঠার মূলশক্তির ভিত্তি ছিল এশিয়া ও আফ্রিকায়- বিশেষ করে ভারতবর্ষে তার আধিপত্যের বিস্তার। দুই মহাদেশের দেশগুলোকে স্বাধীনতা দেয়ার পরও এই দেশগুলোকে নিয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ গঠনই ছিল ব্রিটিশ অর্থনীতির শক্ত ভিত্তি। গত শতকের আশির দশকে ব্রিটিশ শাসকরা এই কমনওয়েলথের গুরুত্ব নষ্ট করে ফেলতে থাকেন এবং ইউরোপের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
ইউরোপে কখনও ফ্রান্স এবং কখনও জার্মানি ছিল ব্রিটেনের প্রবল প্রতিপক্ষ। ব্রিটেন তাদের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দেয়। কমনওয়েলথ ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়। আমেরিকা চেয়েছে রাশিয়াকে ঠেকানোর জন্য একটি অনুগত ঐক্যবদ্ধ ইউরোপ তার দরকার। ব্রিটেন তার লয়াল মিত্র হিসেবে ইউরোপে থাকলে মার্কিন স্বার্থ ও আধিপত্যের সুবিধা হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা তাই ব্রেক্সিট সংক্রান্ত গণভোটের আগে লন্ডনে এসে ব্রিটেনের ইউরোপে থাকার পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছিলেন। ব্রিটেনের অধিকাংশ মানুষ তার কথায় কান দেয়নি।
এখন ইইউ ছাড়ার সন্ধিক্ষণে ব্রিটেনের বহু মানুষই ভাবছেন, এই বিচ্ছেদ ও বিচ্ছিন্নতার প্রচণ্ড ধাক্কা তারা সামলাবেন কীভাবে? ফলে মৃতপ্রায় কমনওয়েলথ সংগঠনটির দিকে তাদের নজর পড়েছে। খবর বেরিয়েছে, ইইউ ছাড়লে ব্রিটেনকে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে হবে, তা সামলানোর জন্য কমনওয়েলথ সংস্থাটিকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার কথাও কোনো কোনো মহল ভাবছেন। এটা ভালো চিন্তা-ভাবনা অবশ্যই। প্রশ্ন হল পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে কমনওয়েলথ তার আগের স্থানে ফিরে যেতে পারবে কি?
এশিয়ায় এশিয়ান শক্তি হিসেবে চীন এবং ভারত এখন মাথা তুলেছে। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে তারা বলীয়ান। এশিয়ান শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যেও এখন শক্তির ও স্বার্থের প্রতিযোগিতা আছে। ব্রিটেন এখন আর তাদের চেয়ে বড় শক্তি নয়। শেষ পর্যন্ত ভাগের মায়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি কীভাবে ঘটে তা দেখার রইল। ব্রিটিশ রাজনীতিতে এখন হয়তো চমকের পর চমক সৃষ্টি হবে।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন