|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
ঢাকা ও লন্ডনের সাম্প্রতিক সন্ত্রাস প্রসঙ্গে
29 March 2017, Wednesday
বাংলাদেশে কি সুইসাইড বোম্বা বা আত্মঘাতী সন্ত্রাসীদের আবির্ভাব হয়েছে? ঢাকায় ১৭ ও ২৩ মার্চ পরপর দুটি ঘটনা এবং সিলেটের ঘটনাটির পর স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটি অনেকের মনে জাগতে পারে। বাংলাদেশ বিএনপি ও জামায়াতের দ্বারা সৃষ্ট সন্ত্রাসের এক অভিশপ্ত অধ্যায় পার হয়ে এসেছে। ব্লগার হত্যা থেকে বিদেশী হত্যা এবং জামায়াতের উপদল হরকত, হিজবুত ইত্যাদি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নির্মম হত্যা অভিযান, রেস্টুরেন্টে হামলাকেও বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত ও প্রতিরোধ করেছে। এখন এ নতুন সন্ত্রাস কাদের এবং কী উদ্দেশ্যে?
আইএসের নাম ভাঙিয়ে আগে দাবি করা হয়েছিল এ সন্ত্রাস মধ্যপ্রাচ্যের ওই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। আমেরিকাও বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ দাবি তুলেছিল। বাংলাদেশ সরকার দৃঢ়ভাবে তা অস্বীকার করেছে এবং পরে এসব সন্ত্রাস যে আইএসের তা প্রমাণিত হয়নি। প্রমাণিত হয়েছে এসব সন্ত্রাস দেশের ভেতরের হিংস্র মৌলবাদী দল-উপদলগুলোর। তাদের পেছনে আইএসের সমর্থন থাকতে পারে। তবে বাংলাদেশের সন্ত্রাসে আইএস বাহ্বা কুড়িয়েছে। তাদের নিজস্ব ভূমিকা কিছু ছিল না।
হালে বাংলাদেশে যা ঘটছে, তাতে র্যাব শিবিরে হামলা যে নিশ্চিতভাবে একজন আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর তা বোঝা যায়। পরবর্তী হামলায়ও সন্ত্রাসীরা মৃত্যুবরণ করেছে। তবে তারা আত্মঘাতী কিনা তা এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। আইএস এই সন্ত্রাসেরও বাহাদুরি নিতে চেয়েছে। কিন্তু সুদূর ইরাক বা সিরিয়ায় বসে কেবল বোতাম টিপে বাংলাদেশে এই সন্ত্রাস ঘটানোর শক্তি যে তাদের আর নেই সেটা এখন ক্রমেই জানাজানি হচ্ছে। বাংলাদেশের এ সাম্প্রতিক সন্ত্রাসের ঘটনাগুলো সম্পর্কে পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী তদন্ত চালাচ্ছে। হয়তো শিগগিরই জানা যাবে এগুলোও কপিক্যাট সন্ত্রাস কিনা। অর্থাৎ আইএসের অনুকরণে সন্ত্রাস চালিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে কিনা।
অনেকের মতো আমারও ধারণা, বর্তমান হাসিনা সরকার দেশে সন্ত্রাস দমনে অনেকটাই সফল হয়েছে। তথাপি এখনও যে মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস দেখা দিচ্ছে, তার কারণ পরাজিত সন্ত্রাস নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে প্রমাণ করতে চায় তারা এখনও টিকে আছে। মুফতি হান্নানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখার রায়দানের সময়ের সঙ্গেও এ সন্ত্রাস সম্পর্কিত হতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা এবং তা কার্যকর করার সময়েও সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিতে চেয়েছে।
আইএসের অস্তিত্ব এখনও আছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে আইএসের বিষদাঁত ভেঙে গেছে। আইএস যে এখনও টিকে আছে তার মূল কারণ, এই জিহাদিস্টদের দমনে আমেরিকার দ্বিমুখী ভূমিকা। প্রমাণিত হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নীতি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন নয়, বরং তার উল্টো- দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন। তবুও আইএসের আগের শক্তি এখন নেই; বিশ্বের যে কোনো স্থানে হামলা চালানোর ক্ষমতাও তাদের এখন আগের মতো নেই। ফলে এখন যে কোনো দেশেই সন্ত্রাস সংঘটিত হয়, সেটা নিজেদের বলে দাবি করে তারা বাহাদুরি নিতে চায়।
কিছুকাল আগে সংঘটিত প্যারিস ও ব্র্যাসেলসের সন্ত্রাসের পেছনে অবশ্যই আইএস সক্রিয় ছিল। কিন্তু ব্রিটেনের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, লন্ডনে ২২ মার্চের হামলার সঙ্গে আইএসের কোনো যোগ নেই। আইএস নিজেদের দুর্বলতা ঢাকা দেয়ার জন্য এ সন্ত্রাসের বাহাদুরিটিও নিতে চেয়েছে। ব্রিটেনের মেট্রোপলিটন পুলিশ বলেছে, ‘গধংড়ড়ফ ধিং ষড়হব ড়িষভ’, অর্থাৎ পার্লামেন্ট ভবন ও ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজে খালেদ মাসুদ এককভাবে হামলা চালিয়েছে। আইএস বা কোনো সন্ত্রাসী সংস্থার সঙ্গে তার যোগাযোগের কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
এটা ব্রিটিশ পুলিশের অভিমত। কিন্তু সন্ত্রাসী খালেদ মাসুদের অতীতের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে অনেকেই মনে করেন, মাসুদ আইএসের সঙ্গে যুক্ত না হলেও তাদের মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এ ছাড়া তার এই একক সন্ত্রাসের আর কোনো উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তার ধর্ম পরিবর্তন এবং সৌদি আরবে গিয়ে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময় জিহাদিস্টদের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত হয়ে থাকলে তার বর্তমান সন্ত্রাসের একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। তার একক সন্ত্রাস জিাহিদস্টদের দ্বারাও প্ররোচিত হয়ে থাকতে পারে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সন্ত্রাস কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশীয় সন্ত্রাসীদের যে ভগ্নাবশেষ এখনও দেশে টিকে আছে, এটা তাদেরই অস্তিত্ব জানান দেয়ার প্রয়াস। কোনো সন্দেহ নেই পুলিশ ও র্যাবের সম্মিলিত অভিযানের মুখে এরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে এখন হয়তো নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। এই মরিয়া চেষ্টার পেছনে আরেকটি উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। সেটি হল শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরের আগে দেশে একটা অরাজক ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এ সফরের উদ্দেশ্য ভণ্ডুল করা।
রাজনৈতিক পর্যায়ে এ চেষ্টা বিএনপি এবং আমাদের একটি ‘নিরপেক্ষ’ মিডিয়া গোষ্ঠী চালাচ্ছে। বিএনপি তো আগেই প্রচার শুরু করেছে, তিস্তার পানি চুক্তি না হলে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত হাসিনা সরকারের আগের সব চুক্তি ব্যর্থ। যে দল দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থেকে ভারতের কাছ থেকে গঙ্গার এক ফোঁটা পানি আদায় করতে পারেনি, পেরেছে হাসিনা সরকার; সেই দল এখন চেঁচাচ্ছে, তিস্তার পানির ভাগ হাসিনা সরকার আনতে পারবে না। আনতে পারে কিনা সেটি দেখার জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্যও তাদের নেই। দেশ চুলোয় যাক, ক্ষমতা তাদের চাই-ই।
অন্যদিকে একটি ‘নিরপেক্ষ’ বাংলা দৈনিক তো অনবরত শেখ হাসিনার এ দিল্লি সফর সম্পর্কে তাদের মস্তিষ্কপ্রসূত জল্পনা-কল্পনা ছেপে চলেছে, যার উদ্দেশ্য এ সফর সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং সফরটি সফল হতে না দেয়া। পাকিস্তান আমলে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভা যখন ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিল, তখন এই একই ধরনের প্রচার চালিয়েছিল ঢাকা ও করাচি থেকে প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ। তারা সেবার সেই চেষ্টা সফল করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এবার তা পারাটা বেজায় শক্ত।
সুতরাং এবার হাসিনা-মোদি বৈঠক ব্যর্থ করার জন্য যদি শক্তিহীন সন্ত্রাসকেও শক্তি জোগানো হয়ে থাকে, তাহলে বিস্ময়ের কিছু নেই। সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর হতেই হবে। প্রমাণ করতে হবে সরকার শুধু সন্ত্রাস দমন নয়, তার মূলোচ্ছেদেও বদ্ধপরিকর। কিন্তু সেজন্য র্যাব ও পুলিশের অভিযান যথেষ্ট নয়। র্যাব ও পুলিশ অবশ্যই সন্ত্রাস দমনে কৃতিত্ব দেখিয়েছে। কিন্তু এই সন্ত্রাসের মূলোচ্ছেদ করতে হলে সরকারকে বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা আন্তরিকতার সঙ্গে কার্যকর করতে হবে।
এই বহুমুখী পরিকল্পনার একটি হবে, ধর্মীয় পরিচয়ের আড়ালে মসজিদ, মাদ্রাসা এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সমাজের প্রতিটি স্তরে জামায়াত এবং অন্যান্য উগ্রপন্থী দল যে শিকড় বিস্তার করে রেখেছে, তার মূলোচ্ছেদ করা। দেশে হিংস্র মৌলবাদের অভ্যুত্থান রোখার জন্য জামায়াত ও হেফাজতকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার সরকারি নীতি সফল হয়েছে; কিন্তু পরিণামে সরকারের এ অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি হেফাজতকে খুশি করার জন্য পাঠ্যপুস্তকে এমন পরিবর্তন ঘটানো হয়, যা আমাদের হাজার বছরের লোকায়ত সমাজ সভ্যতার বিকাশের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। ধর্ম পালনের অবাধ অধিকার রক্ষার পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কালচারকে কিছুতেই মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা দ্বারা প্রভাবিত হতে দেয়া যাবে না। যে কাজটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগও এখন করছে। এই নীতি দেশ থেকে মৌলবাদী সন্ত্রাস স্থায়ীভাবে দমনের সহায়ক নয়।
কিছু সন্ত্রাসী হত্যা করে সন্ত্রাসের মূলোচ্ছেদ করা যাবে না, যদি সন্ত্রাসের বীজ সমাজদেহ থেকে উচ্ছেদ করা না যায়। একদল সন্ত্রাসীকে দমন করা হলে এই বীজ থেকে আরেক দল সন্ত্রাসী জন্ম নেবে। এজন্য আমি আগেও লিখেছি, দেশের ছোট-বড় গণতান্ত্রিক দলগুলোকে সেকুলার রাজনৈতিক কালচার নিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতে হবে এবং প্রচার করতে হবে। মুখে সেকুলার রাজনীতির কথা বলে কাজে ধর্মীয় রাজনৈতিক কালচারের অনুসরণ আসলে আত্মপ্রতারণা এবং তা দেশে সু®ু¤ গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলবে না।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক তিনটি সন্ত্রাসী ঘটনা এ কথাই প্রমাণ করছে, সরকার সন্ত্রাসী দমন করেছে, কিন্তু সন্ত্রাসের মূলোচ্ছেদ এখনও ঘটাতে পারেনি। সন্ত্রাসেরও এখন বিশ্বায়ন ঘটেছে। সুতরাং এ সন্ত্রাস দমন কঠিন। ব্রিটেনের গত ২২ মার্চের ঘটনা তার প্রমাণ। তথাপি এ সন্ত্রাসের মূলোচ্ছেদে নতুন কৌশল ও নতুন পন্থা গ্রহণ প্রয়োজন। এবং সেই কৌশলের একটি হবে সমাজের সর্বস্তরে রোপিত উগ্র মৌলবাদের বীজ ধ্বংস করা। সেজন্য ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রম গ্রহণ করা দরকার। আওয়ামী লীগ সরকার এদিকে নজর না দিলে দেশ সর্বতোভাবে সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। মাঝে মাঝেই ক্রনিক সন্ত্রাস রোগে ভুগতে থাকবে।
সন্ত্রাস একটি অপরাধ। কিন্তু তাকে এখন রাজনৈতিক মতবাদে পরিণত করা হয়েছে এবং তার দিকে একদল তরুণ মোহাবিষ্টের মতো ছুটছে। এই অসুস্থ রাজনৈতিক মতবাদকে সুস্থ রাজনৈতিক মতবাদ দ্বারা মোকাবেলা করতে হবে। সেই সুস্থ মতবাদটি হচ্ছে সেকুলারিজম, যার ভিত্তি হিউম্যানিজম। এই সুস্থ মতবাদই পারবে অসুস্থ ও অমানবিক মতবাদের দুর্গটিকে ভাঙতে। অন্যথায় তা সম্ভব হবে না।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন