অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় আগে নজরুল তার ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ।’ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নৌকা দুলছে না, জল ফুলছে না, কিংবা আওয়ামী লীগ নেত্রীও পথ হারাননি। তথাপি কেমন একটা রুদ্ধ-স্তব্ধতা যেন আমাদের রাজনীতিকে জড়িয়ে ধরেছে। সাবধানীরা শঙ্কা পোষণ করছেন। এত রুদ্ধ-স্তব্ধতা তাদের ভালো মনে হচ্ছে না। এটা কি প্রকৃতই শান্তি, না ঝড়ের আগের পূর্বাভাস? দেশে কি কোনো আকস্মিক ঝড় উঠতে পারে?
বাংলাদেশ অঘটন-ঘটনপটীয়সী দেশ। এদেশে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু ঘটতে পারে। দেশে জঙ্গি দমন হয়েও হয়নি। প্রমাণ সিলেট, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, সীতাকুণ্ডের ঘটনা। বিএনপি মরিয়াও মরেনি। প্রমাণ, কুমিল্লার মেয়র এবং সুপ্রিমকোর্ট বার কাউন্সিলের নির্বাচন। ক্ষমতাসীন দলে কাকের উপদ্রব বেশি বেড়ে গেছে। ফলে দলের সাধারণ সম্পাদককে কাক তাড়ুয়ার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়েছে।
ভালোয়-মন্দে মিশিয়ে আমি দেশের ভালোর দিকটাই বেশি দেখছি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফর হয়তো দেশের জন্য আরও মঙ্গল বয়ে আনবে। তাতে আওয়ামী লীগের চিরাচরিত সমালোচকরা তাদের রসনা এখন একটু সংযত করেছেন বটে; কিন্তু ছিদ্রান্বেষণ থেকে তারা এখনও বিরত হননি। পুলিশ ও র্যাব যে সাহস এবং দক্ষতার সঙ্গে জঙ্গিদের একটার পর একটা আস্তানা খুঁজে বের করছে, তাদের দমন করতে পারছে, এটাকেও তারা বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। বলছেন, এটা পুলিশের ভাষ্য। এটা একতরফা ভাষ্য। আমরা জঙ্গিদের সম্পর্কে আসল তথ্য জানতে চাই।
এই সমালোচনা সম্পর্কে আমার এক বন্ধু বলেছেন, জঙ্গিদের মোকাবেলা করছে পুলিশ ও র্যাব। জঙ্গিদের সঙ্গে যুদ্ধে মরছে তারা। এবারও র্যাবের এক অফিসার মরণাপন্ন অবস্থায় সিঙ্গাপুরে গিয়েও প্রাণ বাঁচাতে পারেননি। যুদ্ধের মাঠে যারা যুদ্ধ করছে তাদের ভাষ্য বিশ্বাস করব, না বিশ্বাস করব যারা নিরাপদ দূরত্বে বসে পাগলা মেহেরালির মতো ‘সব ঝুটা যায়’ বলে চেঁচাচ্ছেন, তাদের কথা?
সন্ত্রাস এখন একটা বিশ্ব সমস্যা। সব দেশেই সরকারের সন্ত্রাস দমন ব্যবস্থায় দল-মত নির্বিশেষে সবাই সহযোগিতা করে। সম্প্রতি লন্ডনের পার্লামেন্ট ভবনের সামনে যে সন্ত্রাস হয়েছে, তাতে পুলিশ সন্ত্রাসীকে গুলি করে মারতে বাধ্য হয়েছে। এ সম্পর্কে পুলিশের ভাষ্য কেউ অবিশ্বাস করেনি। এখানেও সন্ত্রাসীর সঙ্গে যুদ্ধে এক সাহসী পুলিশ অফিসারকে প্রাণ দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে এই ব্যাপারে বিএনপির সম্পূর্ণ উল্টো ভূমিকা। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের যুদ্ধ সম্পর্কে পুলিশের ভাষ্যকে বিএনপির নেতা-নেত্রীরা বিতর্কিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কবি শামসুর রাহমানকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করার চেষ্টা থেকে শুরু করে কুমিল্লায় সন্ত্রাসী আস্তানায় যুদ্ধ পর্যন্ত সবকিছুকে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পাতানো খেলা।’
মজার ব্যাপার, দেশে যদি সন্ত্রাসী ঘটনা বা জঙ্গিদের উৎপাত ঘটে, তখন বিএনপি ও তার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা হৈচৈ তোলেন- ‘সরকার সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ’। আর সরকার যখন কঠোর হাতে সন্ত্রাসীদের ধরপাকড় করা শুরু করে, তখন বিএনপিকে ভিকটিম-সিনড্রোমে পেয়ে বসে। তারা চিৎকার শুরু করেন এরা সন্ত্রাসী নয়। এরা আমাদের কর্মী-সমর্থক। সন্ত্রাস দমনের নামে আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের দলের ওপর বেপরোয়া দমননীতি চালাচ্ছে।
শেখ হাসিনার দিল্লি সফরও বিতর্কিত করার প্রবল চেষ্টা চলছে। সুতরাং বলা যাবে না যে, অবস্থা যতই শান্ত দেখাক, তার আড়ালে কালো মেঘ জমছে না, অথবা জমানোর চেষ্টা হচ্ছে না। এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এবং তার কোনো কোনো সহযোগী সংগঠনের (যেমন ছাত্রলীগ) দায়-দায়িত্বও কম নয়। তাদের একশ্রেণীর নেতা, কর্মী ও মন্ত্রী-এমপির দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির উপদ্রবে দেশের মানুষ অস্থির। বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের এক নিখোঁজ কর্মী সম্পর্কে রব তোলা হয়েছে, তাকে পুলিশ বা র্যাবই অপহরণ করে গুম করে ফেলেছে। নিখোঁজ ইলিয়াস আলী সম্পর্কে এই প্রচারণা তো এখনও অব্যাহত আছে।
ছোট ছোট কালো মেঘই এক সময় সারা আকাশ ছেয়ে ফেলে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি ঘটায়। বাংলাদেশেও যে ছোট ছোট ঘটনা বা প্রচারণাকে এখন অবজ্ঞা করা হচ্ছে, তা এক সময় রাজনীতির গগন ছেয়ে ফেলে অপ্রত্যাশিত বড় ঝড় সৃষ্টি করতে পারে। এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সরকারের এখনই অবহিত ও সতর্ক হওয়া দরকার।
আওয়ামী লীগ সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য যত ভালো কাজ করুক, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি তার কাকচক্ষু সমালোচক বা বিরোধীরা এই প্রচারণা চালাতে পারে যে, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশ চালাচ্ছে না। বরং স্বৈরাচারের পথ ধরেছে। দেশটিতে মানবাধিকার খর্বিত। আওয়ামী লীগে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি আস্তানা গেড়েছে- একথা প্রমাণ করার জন্য তারা দেশের নানা ছোট ছোট ঘটনার উদাহরণ টানছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর ভূমিকাকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার এসব এখন উপেক্ষা করতে পারে; কিন্তু বেশিদিন করা উচিত হবে না। আওয়ামী লীগকে বাইরের এই সমালোচনাকে মোকাবেলা করার জন্যই আত্মসংশোধনের, তা যত কঠোর হোক, পথ ধরতে হবে।
অন্য অনেক দেশের জনগণের মতো বাংলাদেশের মানুষও ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে দম্ভ ও ঔদ্ধত্য পছন্দ করে না। এই দম্ভ ও ঔদ্ধত্যই বিএনপির পতন ঘটিয়েছে এবং এখনও তাকে রাজনীতিতে খাড়া হতে দিচ্ছে না। জাতীয় পার্টির নেতা জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের পাহাড় প্রমাণ অভিযোগ। সেই অভিযোগ তিনি মোকাবেলা করছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশ ছেড়ে পালাননি। তার সমালোচনাকে দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের সঙ্গে উপেক্ষা করেননি। ফলে তিনি জেলে বসেও সাধারণ নির্বাচনে একাধিক কেন্দ্র থেকে একসঙ্গে নির্বাচিত হয়েছেন এবং এখনও দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে আছেন।
কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে এটা ঘটেনি। মাতৃস্নেহে তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে উন্নীত হলেও তার হাওয়া ভবনের দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিযোগের মোকাবেলা তিনি দেশে বসে করার সাহস ও বিনয় দেখাচ্ছেন না। দেশের বাইরে রয়েছেন এবং বিদেশে বসে এমনসব কথা বলছেন, যা তার দেশে প্রত্যাবর্তন আরও কঠিন করে তুলছে।
আওয়ামী লীগ সরকারেরও কিছু মন্ত্রী এবং এমপি আজকাল এমন ভাষায় কথা বলেন, যাতে বিনয় ও সৌজন্য নয়, ক্ষমতার দম্ভ ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায়। বিএনপিকে যেসব দোষের জন্য তারা সমালোচনা করেন, সেসব দোষ তাদের দলের মধ্যেও এখন উপস্থিত। জনগণের মধ্যে এজন্য তাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বাড়ছে। এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে কোনো উপলব্ধি ও সতর্কতা নেই। তাদের সম্ভবত একটাই আশা, শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ও ক্যারিশমা দ্বারা আগামী নির্বাচনে তরী পার করাবেন। একটা আশার বালুর চরে তারা বাস করছেন।
কুমিল্লা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরেছে বটে; কিন্তু এই নির্বাচন দুটি বিষয় সম্ভবত স্পষ্ট করে তুলেছে। এক. আওয়ামী লীগ কোনো নির্বাচনেই ম্যানুপুলেশন দ্বারা জয়ী হতে যাবে না। দুই. শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যতের মনোনয়নপ্রার্থীদের জানিয়ে দিলেন, লড়াই করে, নিজেদের যোগ্যতা ও দক্ষতার গুণে তাদের জয়ী হতে হবে। দলনেত্রীর জনপ্রিয়তা ও ক্যারিশমার ওপর তাদের নির্ভর করা চলবে না।
প্রকাশ্য জঙ্গি-সন্ত্রাস দমন করা সহজ; কিন্তু উগ্র মৌলবাদীদের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ দমন করা কঠিন। বাংলাদেশে জঙ্গিদের বা জিহাদিস্টদের প্রকাশ্য তৎপরতা এখন অনেকটা দমিত। কিন্তু জামায়াতিদের আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক এখনও সক্রিয় এবং শক্তিশালী। এই তৎপরতা হল সরকারি দলে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচারব্যবস্থাসহ প্রশাসনের সব স্তরে, সামাজিক ক্রিয়াকর্মে ঢুকে গিয়ে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন এবং ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার বিস্তার ঘটানো। আওয়ামী লীগে ঢুকে এবং আওয়ামী লীগার সেজে তারা দলটির এবং দেশের সর্বনাশ ঘটানোর চক্রান্তে লিপ্ত। এদের লক্ষ্য হল, প্রথমে গ্রামাঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করা, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল দখল করা, শিক্ষার কারিকুলাম পাল্টানো, তারপর শহরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় অনুপ্রবেশ। সরাসরি ক্ষমতায় না গিয়েও তারা ক্ষমতা দখল ও নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজে ধীর অথচ দৃঢ়গতিতে এগোচ্ছে।
তাই আওয়ামী লীগ নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বলি, ‘কাণ্ডারি হুশিয়ার’। নৌকা দুলছে না, জল ফুলছে না, মাঝিও পথ হারায়নি; কিন্তু দেশের রাজনীতির উপরিভাগ যত শান্ত দেখাক, তার নিচে বহমান সর্বনাশা ঘূর্ণিস্রোত সম্পর্কে তিনি সতর্ক হোন। তাকে বেঁচে থাকতে হবে, ক্ষমতায় থাকতে হবে। নইলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন