|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
ট্রাম্পের রণহুঙ্কারে শুধু কোরিয়া নাকি সমগ্র বিশ্বই বিপর্যস্ত হবে?
17 April 2017, Monday
আজ (রোববার) ঘুম থেকে উঠেই লন্ডনের ভোরের কাগজে খবরের বিশাল হেডিং দেখলাম, Trump ready to strike kimis nuclear sites- কিমের আণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্য ট্রাম্প প্রস্তুত। সোজা কথায় উত্তর কোরিয়ার ওপর হামলা চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তৈরি। উত্তর কোরিয়ার অপরাধ তাদের প্রেসিডেন্ট কিম জং-আন পরমাণু বোমা বানানোর একটার পর একটা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত শনিবারও তারা রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে বিশাল সামরিক মহড়া চালায়। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, উত্তর কোরিয়ার হাতে যে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালাস্টিক মিসাইল আছে, তা দেখানোই এই সামরিক প্যারেডের উদ্দেশ্য।
উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু বোমা বানানো থেকে বিরত রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট পদে বসার আগে থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প গরম গরম কথা বলে আসছিলেন। চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক একটু সহজ হওয়ার পর অনেকেই ভাবছিলেন, ট্রাম্প কোরিয়া থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সব ইস্যুতেই রাশিয়া ও চীনকে না চটানোর নীতি অনুসরণ করবেন। বাস্তবে তা হয়নি। রাশিয়ার সঙ্গে তার বিতর্কিত সমঝোতাকে অগ্রাহ্য করেই তিনি প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে কেমিক্যাল উইপন ব্যবহারের অভিযোগ তুলে তার বিমান ঘাঁটিতে আকস্মিক মিসাইল হামলা চালিয়েছেন। তাতে রাশিয়া ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ জানিয়েছে। পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের বিশেষ দূতের বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে।
পরমাণু বোমা নিয়ে উত্তর কোরিয়ার ক্রমাগত টেস্ট চালানো সম্পর্কেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পিয়ংইয়ংয়ের মিত্র নয়া চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন। যাতে চীন তার প্রভাব বিস্তার দ্বারা পিয়ংইয়ংকে এই অস্ত্র বানানো থেকে বিরত করে। এখন চীনকে শুধু সতর্ক করেই ট্রাম্প ক্ষান্ত হননি। তিনি উত্তর কোরিয়ার পরমাণু স্থাপনায় মিসাইল হামলা চালানোর হুমকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের একটি বহর কোরিয়ান পেনিনসুলার দিকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
সিরিয়ার মতো উত্তর কোরিয়ায়ও আমেরিকা আকস্মিক মিসাইল হামলা চালাতে পারে। কিন্তু কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, ট্রাম্প যতই রক্তচক্ষু দেখান, হয়তো সহসা এই হামলা চালাতে যাবেন না। তার প্রধান কারণ, উত্তর কোরিয়ার হাতে পরমাণু বোমা আছে, সিরিয়ার হাতে নেই। আক্রান্ত হলে উত্তর কোরিয়া সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সামরিক ঘাঁটির ওপর হামলা চালিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং আমেরিকার অপসন হবে, যুগপৎ পিয়ংইয়ংকে ভয় প্রদর্শন এবং পিয়ংইয়ংকে নিরস্ত্র করার জন্য চীনের ওপর চাপ প্রয়োগ, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নির্ভর করছে চীনের মনোভাবের ওপর।
ইত্যবসরে আমেরিকা অবশ্য প্রচণ্ড রণবাদ্য বাজাতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল ম্যাক মাস্টার ব্রিটেনের সেনা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু স্থাপনাগুলো কোথায় তা খুঁজে বের করতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সক্ষম হয়েছে। মিসাইল হামলা চালিয়ে তারা যে সেগুলো ধ্বংস করতে সক্ষম সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রিটেনের আশঙ্কা, এই হামলার পরিণতি হবে ভয়াবহ। উত্তর কোরিয়া প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুরূপ মিসাইল হামলা চালাতে পারে।
ট্রাম্পের রণদামামা কি সত্যিই যুদ্ধ প্রস্তুতি, না উত্তর কোরিয়া ও চীনকে ভয় দেখানো তা দেখার জন্য আমাদের হয়তো বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। ট্রাম্প যদি তার হঠকারী বুদ্ধি ত্যাগ না করেন, তাহলে আমার এই লেখাটি যুগান্তরের পাঠকদের চোখে পড়ার আগেই ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালিয়ে বসতে পারেন। পিয়ংইয়ংও যে পাল্টা প্রতিশোধ নেবে তাতে সন্দেহ নেই। ট্রাম্পের হুমকির মুখে উত্তর কোরিয়ার মনোভাব আরও কঠোর হয়েছে। তারাও আমেরিকার দিকে তাদের সামরিক মাসল দেখাতে শুরু করেছে।
উত্তর কোরিয়ার চেয়ে আমেরিকা সামরিক শক্তিতে অনেক বেশি বলীয়ান। মার্কিন হামলার মুখে উত্তর কোরিয়ার বেশিক্ষণ প্রতিরোধ চালানোর শক্তি নেই। এখন প্রশ্ন, আমেরিকা হামলা চালালে চীনের প্রতিক্রিয়া কী হবে? চীন কি ওয়াশিংটনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষার জন্য উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু বোমা পরীক্ষা থেকে নিবৃত্ত করবে, না পঞ্চাশের দশকের মতো উত্তর কোরিয়াকে রক্ষার জন্য মার্কিন হামলা প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসবে? এই প্রশ্নের মধ্যেই খুঁজতে হবে বর্তমান কোরিয়া সংকট থেকে আবার কোনো বিশ্বসংকট সৃষ্টি হবে কিনা তার জবাব।
পরমাণু অস্ত্র বানানোর জন্য উত্তর কোরিয়াকে এককভাবে দায়ী করা চলে না। সেই পঞ্চাশের দশকের কোরিয়ান ক্রাইসিসের অবসানের পর থেকে আমেরিকা উত্তর কোরিয়াকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা নয়, ক্রমবর্ধমান সামরিক হুমকির মুখেও রেখেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং তাদের অস্ত্র সজ্জিত করা এবং উত্তর কোরিয়ার গা ঘেঁষে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে মিলে উস্কানিমূলক যুক্ত সামরিক মহড়া চালানো উত্তর কোরিয়ার জন্য এক বিরাট হুমকি সৃষ্টি করেছিল। এই হুমকির মুখেই উত্তর কোরিয়া পরমাণু অস্ত্র তৈরির পরীক্ষা শুরু করে। এই পরীক্ষা থেকে উত্তর কোরিয়াকে নিবৃত্ত করার একমাত্র উপায়, দক্ষিণ কোরিয়াকে ক্রমাগত অস্ত্রসজ্জিত করার নীতি থেকে আমেরিকার সরে আসা এবং সেখান থেকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি অপসারণ। আমেরিকা তাতে রাজি নয়। তার উদ্দেশ্য, উত্তর কোরিয়াকে অর্থনৈতিক ও সামরিক বেষ্টনীর মধ্যে কোণঠাসা করে রেখে সেখানে তাদের চেঞ্জ অব দ্য রেজিমের নীতি সফল করা।
পঞ্চাশের দশকেও কমিউনিস্ট চীন সরকারকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আমেরিকা কোরিয়া সংকটের সৃষ্টি করেছিল। তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রু–ম্যানের নির্দেশে জেনারেল ম্যাক আর্থার তার টোকিওর ঘাঁটি থেকে কোরিয়ায় প্রচণ্ড হামলা চালান। সেবারেও তিনি দম্ভোক্তি করে তার সেনাবাহিনীকে বলেছিলেন, কয়েকদিনের মধ্যে যুদ্ধে জয় লাভ করে টোকিওতে ফিরে এসে বড়দিনের কেক খেতে পারবে। মার্কিন সেনাবাহিনী চীন সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে চীনের অভ্যন্তরেও হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চীন তখন আমেরিকার বন্ধু ছিল না। তার তেমন সামরিক শক্তি ছিল না।
তা সত্ত্বেও চীনের গণফৌজ ম্যাক আর্থারের বাহিনীর ওপর ঝটিকা আক্রমণ চালায়। কয়েক মাসের যুদ্ধে ম্যাক আর্থার পরাজিত হন। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো সেদিন প্রেসিডেন্ট ট্রু–ম্যানও কোরিয়া যুদ্ধে আণবিক বোমা ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোরিয়ায় আমেরিকার সামরিক বিপর্যয় এতটাই বিশাল ছিল যে, তিনি আর এটম বোমা ব্যবহারে সাহসী হননি। বিশ্বজনমত ছিল আমেরিকার বিরুদ্ধে।
অবশেষে ট্রু–ম্যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর শরণাপন্ন হন আমেরিকাকে সম্মানের সঙ্গে কোরিয়া সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করার জন্য। ভারত যুদ্ধ অবসানে মধ্যস্থতা করতে রাজি হয়। ভারতের মধ্যস্থতায় উভয়পক্ষের মধ্যে শান্তি বৈঠক বসে। তাতে যুদ্ধবিরতি ঘটে এবং উভয়পক্ষের যুদ্ধবন্দিরা মুক্তি পায়।
বর্তমানে কোরিয়া নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবার লম্ফঝম্প দেখে মনে হয় অতীতের কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক ইরাক ও আফগান যুদ্ধ থেকেও তিনি কোনো শিক্ষা নেননি। আর নিয়ে থাকলেও হয়তো মার্কিন এস্টাবলিশমেন্টের ক্রমাগত চাপের মুখে তিনি হয়তো তার নির্বাচনী ওয়াদা পালন করতে পারছেন না এবং অধিকাংশ ইস্যুতে (যেমন রাশিয়া ও ন্যাটো) ইউটার্ন নিতে বাধ্য হচ্ছেন, তবে শেষ পর্যন্ত নিজের মুখ রক্ষার জন্য যুদ্ধংদেহি চেহারা ধারণ করে সিরিয়া ও কোরিয়া দুটি ইস্যুতেই বড় ধরনের অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন।
যদি তিনি তা ঘটান, তা বিশ্বের যতটা অমঙ্গল ঘটাবে তার চেয়ে বেশি অমঙ্গল ঘটাবে আমেরিকার। সিরিয়ায় মিসাইল হামলার বিরুদ্ধে রাশিয়া যেমন অবস্থান নিয়েছে, কোরিয়ায় সম্ভাব্য হামলা সম্পর্কে চীন সে রকম অবস্থান গ্রহণ করলে যে সংকটময় বিশ্বপরিস্থিতি দেখা দেবে তা সামলানোর ক্ষমতা ও মনোবল এখন আমেরিকার আর নেই। দ্বিতীয় কোরীয় যুদ্ধ যদি ঘটে, তাহলে তা প্রথম কোরীয় যুদ্ধের চেয়েও আমেরিকার জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। তাতে আমেরিকার একক সুপার পাওয়ারের মর্যাদা রক্ষাও কঠিন হতে পারে।
বিশ্ব এখন এক বড় ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বড় বড় ধ্বংসের মধ্য দিয়ে পৃথিবী বদলায় এবং নবযুগের সূচনা হয়। বিশ্বরাজনীতিতে ট্রাম্পের মতো নেতার অভ্যুদয়, আবার যুদ্ধের ঘনঘটা সৃষ্টির চেষ্টা বিশ্বকে কোন্ পথে টেনে নেয় তা এখন দেখার রইল। কোরিয়া সমস্যা কোন দিকে গড়াবে তা নির্ভর করে ট্রাম্প প্রশাসনের মতিগতি এবং নয়াচীনের নীতি নির্ধারণের ওপর। কোরিয়া সমস্যায় চীন পঞ্চাশের দশকের মতো সাহসী ভূমিকা নেবে, না আমেরিকার সঙ্গে মৈত্রী বজায় রাখার জন্য সুবিধাবাদী নীতি নেবে, তাও এই সংকটে দেখা যাবে। ট্রাম্পের হঠকারিতা বিশ্বে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ঘটাতে পারে, যা বিশ্বে একক সুপার পাওয়ারের অহংকার ও আধিপত্য দুইয়েরই অবসান-যুগের সূচক হবে।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন