|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
ফ্রান্সে সন্ত্রাস, নির্বাচন এবং আমার একটি সন্দেহ
23 April 2017, Sunday
ঘটনাটি ঘটেছে প্যারিসে। গত বৃহস্পতিবার রাতে করিম সেরমি নামে এক মুসলমান যুবক প্যারিসের প্রাণ কেন্দ্রে (Champs Elysees) গুলি করে একজন পুলিশকে হত্যা এবং আরো দু’জনকে আহত করেছে। লন্ডনে বসে আমার মনে সন্দেহ জেগেছে আসলে ঘটনাটি ঘটিয়েছে কারা? হয়তো আমার সন্দেহটি হাস্যকর এবং অমূলক। তবু সন্দেহটি ব্যক্ত করতে চাই অতীত ইতিহাসের কথা ভেবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর।” তেমনি বর্তমান বিশ্বে যত সন্ত্রাস ঘটে তার দায়িত্ব বর্তায় আইএসের ঘাড়ে। আইএসও বাহবা কুড়োবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়।
বাংলাদেশের ব্যাপারেও আমরা দেখেছি, ব্লগার হত্যা থেকে বিদেশি হত্যা, রেস্টুরেন্টে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত অধিকাংশ সন্ত্রাসের দায় স্বীকার করে বাহবা পেতে চেয়েছে আইএস। কিন্তু দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশে আইএস নেই। আইএসের নাম ভাঙিয়ে এই সন্ত্রাস চালিয়েছে দেশেরই উগ্র মৌলবাদী দল-উপদলগুলো। প্যারিসের গত বৃহস্পতিবারের ঘটনার পেছনেও আইএসের মুখোশের আড়ালে অন্য কোনো অশুভ শক্তির খেলা রয়েছে কিনা এ সন্দেহটিই আমার মনে প্রথম জেগেছে।
ফ্রান্সে নির্বাচন শুরু হওয়ার মাত্র ৭২ ঘণ্টা আগে এই সন্ত্রাস ঘটতেই উগ্র বর্ণবাদী দল ফ্রন্ট ন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ম্যারিন লে পেনের জয়ের সম্ভাবনা বেড়ে গেছে এবং তিনি হুংকার ছেড়ে বলেছেন, ‘তার দেশ থেকে ইসলামিজমের সঙ্গে সম্পর্কিত সব মুসলমানকে বের করে দিতে হবে। ইসলামিস্ট, সালাফিস্ট মতবাদের কোনো স্থান ফ্রান্সে নেই। আমরা এখন ইসলামিস্টদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত, আমরা এ যুদ্ধে পরাজিত হতে পারি না। ফ্রান্সে বিদ্বেষপ্রচারকারী মসজিদের ইমামদের বহিষ্কার করতে হবে এবং মসজিদ বন্ধ করে দিতে হবে।’
আমেরিকায় যে বহিরাগত বিদ্বেষ প্রচার ও মুসলিম বিতাড়নের ঝড় তুলে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতার অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন এবং হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়েছিলেন, ফ্রান্সে সেই একই পন্থা গ্রহণ করে লে পেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে চান। প্যারিসের সন্ত্রাসের ঘটনাটি তার অনুকূলে গেছে এবং তার জয়ের সম্ভাবনা বেড়েছে। এ সম্পর্কে ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন, ‘এই সন্ত্রাস ফ্রান্সের নির্বাচনে বিরাট প্রভাব ফেলবে এবং সম্ভবত লে পেনকে জয়লাভে সাহায্য জোগাবে। কারণ, লে পেন ফ্রান্সের সীমান্ত রক্ষা (বহিরাগতদের আটকানো) এবং আভ্যন্তরীণ সমস্যার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর নীতি অনুসরণ করতে চান।’ ট্রাম্প এ কথা গোপন রাখেননি, তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদে লে পেনকে দেখতে চান।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী চারজনের মধ্যে লে পেন এবং ফ্রাঙ্কোয়েজ কিলন দু’জনেই উগ্র বর্ণবাদী এবং মুসলিম-বিদ্বেষী। প্যারিসের ঘটনার পর কিলনও বলেছেন, ‘তার দেশ এখন রেডিক্যাল ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত।’ নির্বাচন সংক্রান্ত জনমত সমীক্ষায় তিনি এখন তৃতীয় স্থানে আছেন। লে পেনের একেবারে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইমানুয়েল ম্যাকরন একজন সংস্কারবাদী, উদারপন্থি প্রার্থী। কিন্তু ফ্রান্সে এখন চরম ডানপন্থি রাজনীতির অনুকূলে যে হাওয়া বইছে, তাতে অনেকের আশঙ্কা, তিনি আমেরিকায় হিলারি ক্লিনটনের ভাগ্য বরণ করতে পারেন।
সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, ফ্রান্সে বামপন্থিরা এখন বিভক্ত। প্রেসিডেন্ট পদে বাম প্রার্থী জাঁ লুক মেলেনচনের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা এবং ব্যক্তিগত ক্যারিশমা আছে। কিন্তু সারা ইউরোপ জুড়ে উগ্র ডানপন্থায় যে ঝড় বইছে, তার মোকাবিলায় তিনি টিকতে পারবেন কিনা সন্দেহ। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট পদে চরম উগ্র কথাবার্তা বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে নির্বাচিত হয়েছেন, ফ্রান্সে লে পেন সেভাবে জিতলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই চরম ডানপন্থি নেতা ফ্রান্সের নির্বাচনে জয়ী হলে সারা ইউরোপে তার বিপজ্জনক প্রভাব বিস্তার লাভ করবে।
ফ্রান্সের নির্বাচনের ফার্স্ট রাউন্ড শুরু হয়েছে। প্যারিসে গত বৃহস্পতিবারের ঘটনাটি যদি না ঘটত, তাহলে লে পেনের সম্ভাব্য বিজয় সম্পর্কে একশ্রেণির পর্যবেক্ষক এতটা নিশ্চিত হতে পারতেন না। লে পেনের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী উদারপন্থি ম্যাকরন ফার্স্ট রাউন্ড নির্বাচনে তার ‘নেক টু নেক’ অবস্থানে আছেন। প্যারিসে বৃহস্পতিবারের ঘটনার পর এই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটতে পারে। লে পেন আরো এগিয়ে যেতে পারেন। ম্যাকরন তার দুই উগ্র ডানপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বী সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন। তারা এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলছেন বটে, কিন্তু এই ঘটনাটিকে তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যবহার করছেন।
এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। দেখা যাচ্ছে এই সন্ত্রাস লে পেনের নির্বাচন জেতার সম্ভাবনা বাড়িয়েছে। তার মুসলিম বিদ্বেষী প্রচার এবং জেনোফেভিক নির্বাচন-প্রচারণার মাত্রা বাড়িয়েছে। এদিক থেকে বৃহস্পতিবারের সন্ত্রাসের নায়ক করিম লে পেনের শত্রু নয়, বরং মিত্রের ভূমিকাই পালন করে গেছেন। এখানেই আমার সন্দেহটি জাগে। তিনি কি জিহাদিস্ট বা আইএসের লোক না কোনো ভাড়াটে সন্ত্রাসী? উগ্র ডানপন্থিরাই তাকে জিহাদিস্ট সাজিয়ে, নির্বাচন শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে প্যারিসে তার দ্বারা পুলিশ হত্যা করিয়ে নিজেদের অনুকূলে জনসমর্থন ঘোরাতে চেয়েছে কি?
পুলিশের রিপোর্টেই দেখা যায়, ৩৯ বছর বয়সী করিম একজন দাগি আসামি। তার অপরাধের দীর্ঘ তালিকা আছে পুলিশের কাছে। তিনি পুলিশ বিদ্বেষী এবং তার বিরুদ্ধে দুটো হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগ আছে। তার উপর গোয়েন্দা পুলিশের নজর ছিল। করিম জিহাদিস্টদের তালিকাভুক্ত ছিলেন না। এই অবস্থায় কী করে পুলিশের নজরবন্দি এই সন্ত্রাসী প্যারিস শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে এই সন্ত্রাস ঘটায়? তাকে কারা ভাড়া করেছিল এবং নির্বাচন শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে পুলিশ হত্যা করিয়ে নির্বাচনী হাওয়া ঘোরাবার কাজে নিয়োগ করেছিল তার তদন্ত ফরাসী পুলিশ কি করবে? এই লোন মার্ডারারকে তো পুলিশই আবার হত্যা করেছে।
প্যারিসের এই ঘটনা সম্পর্কে আমার মনে সন্দেহ জাগার কারণ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে জার্মানিতে নািস দলের নায়ক হিটলারের ক্ষমতা দখল পর্বে প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। হঠাত্ একরাতে জার্মান রাইটসট্যাম্প (পার্লামেন্ট) ভবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হিটলার ঘোষণা করেছিলেন, ‘একজন ইহুদীর দ্বারা জার্মানির কম্যুনিস্ট পার্টি এই কাজটা করিয়েছে।’ তারপর শুরু হয় ইহুদী ও কম্যুনিস্টদের উপর চরম নির্যাতন। সাধারণ জার্মানদের ইহুদী ও কম্যুনিস্ট বিদ্বেষী করে তোলা হয়। হিটলারের জনপ্রিয়তা বাড়ে।
অনেকদিন পর ঘটনার আসল রহস্য ফাঁস হয়। প্রকাশ পায়, নািসরাই একজন দলত্যাগী ইহুদি কম্যুনিস্টকে পার্লামেন্টে আগুন ধরাবার জন্য প্রচুর অর্থ দিয়ে ভাড়া করেছিল। এই খবর যখন জানাজানি হয় তখন নািসরা ক্ষমতায়। ফ্রান্সের ঘটনাটি নিয়ে তাই সন্দেহ হয়, প্যারিসের বৃহস্পতিবারের ঘটনার পেছনে সে দেশের নব্য নািস পার্টি ফ্রন্ট ন্যাশনালের কোনো হাত আছে কিনা?
পড়ন্ত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এখন মিথ্যা প্রচারণায় নািস জার্মানির গোয়েবলসকেও হার মানিয়েছে। গালফ যুদ্ধ বাঁধানোর জন্য ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের হাতে বিশ্বধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে এই মিথ্যা প্রচার চালানো হয়েছিল। এই মিথ্যা প্রচারটি যে ব্রিটিশ গোয়েবলস চালিয়েছিলেন, সেই সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এখনো বুক ফুলিয়ে জনসমক্ষে হাঁটেন এবং বিশ্ববাসীকে নানা উপদেশ দেন।
অতীতের অন্য উদাহরণে যাব না। সিরিয়ার আসাদ বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে এবং সেই অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার আগেই আমেরিকা সিরিয়ায় ভয়াবহ মিসাইল হামলা চালিয়ে অসংখ্য লোক হত্যা করেছে। এখনতো প্রশ্ন উঠেছে, সিরিয়ায় আসাদ সরকার এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে না মার্কিন মদদপুষ্ট বিদ্রোহীরাই এই অস্ত্র নিজেরা ব্যবহার করে আসাদ সরকারকে দায়ী করার চেষ্টা করেছে? কারণ, আসাদ সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে তারা পেরে উঠছে না। একথাতো এখন সকলেরই জানা ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরানে রাসায়নিক বোমা ব্যবহারের জন্য ওই বোমা সাদ্দাম হোসেনের হাতে আমেরিকাই তুলে দিয়েছিল। পরে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ তারাই আবার তুলেছে।
প্রবাদ আছে, ‘সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো’, পড়ন্ত সূর্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের এখন এই নীতি। আইএস গঠন তারাই করেছে, এখন আইএসের সন্ত্রাসকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে সারা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস দমনের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। আফগানিস্তানে, ইরাকে, সিরিয়ায় অবৈধ বোমা হামলার এবং শ’য়ে শ’য়ে নিরীহ নর-নারী হত্যার অধিকার আমেরিকাকে কে দিয়েছে সে প্রশ্ন কেউ তুলছে না। তার প্রতিক্রিয়ায় সারা পশ্চিমা দেশগুলোতেই যদি প্রতিহিংসাকামী সন্ত্রাস ছড়াতে থাকে, তার জন্য দায়ী কারা?
প্যারিসের সন্ত্রাস, একজন পুলিশের মর্মান্তিক মৃত্যু নিশ্চয়ই নিন্দনীয়। কিন্তু এই মানবতা বিরোধী নিন্দনীয় কাজের পেছনে কাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গোপন হাত লুকানো রয়েছে তা হয়তো এখন জানা যাবে না। জানা যাবে বহু পরে, অলিখিত ইতিহাসের একটি অধ্যায় হিসেবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে ইউরোপে নািসবাদের অভ্যুদয় পর্বে যেসব ঘটনা ঘটেছিল, তার আলামত আবার দেখা যাচ্ছে, বর্তমান ইউরোপ ও আমেরিকা জুড়ে। এর পরিণতি কি তা বলার সময় এখনো আসেনি।
উৎসঃ ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন