|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
আওয়ামী লীগকে আগে ঘরের জঞ্জাল সাফ করতে হবে
04 May 2017, Thursday
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি বলেছেন, ‘দলের বিতর্কিত এমপিদের সাধারণ নির্বাচনে আর মনোনয়ন দেয়া হবে না।’ এ মন্তব্যের সঙ্গে যদি ‘দুর্বৃত্ত’ কথাটি যুক্ত হতো তাহলে ভালো হতো। আওয়ামী লীগের যেসব এমপি শুধু বিতর্কিত নন, দুর্বৃত্তপনা ও দুর্নীতিতেও বিতর্কের সীমা ছাড়িয়েছেন, তাদের ভবিষ্যতে কেবল মনোনয়ন দেয়া না হলে কম শাস্তি দেয়া হবে, তাদের বিষয়ে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণও উচিত হবে।
দেশের রাজনীতিতে এ কথাটি প্রমাণিত হওয়া দরকার যে, যারা আইন প্রণয়ন করেন, তারাও আইনের ঊর্ধ্বের লোক নন।
স্বাধীনতার সেই ঊষালগ্নে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে তখনকার এমএনএ ও এমএলএ মিলিয়ে ২৭ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যহারের দায়ে সদস্যপদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, এমনকি মন্ত্রীদের কার্যকলাপ মনিটরিংয়ের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এ কমিটির কাজ হতো মন্ত্রী ও এমপিরা তাদের দায়িত্ব পালনে স্বচ্ছতার পরিচয় দিচ্ছেন কিনা, জনগণের আস্থাভাজন আছেন কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা, বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্ন পূরণের সময় পাননি। তার এ ইচ্ছাটিও পূর্ণ হয়নি।
সাম্প্রতিক অতীতে সামরিক সরকার এবং খালেদা জিয়া সরকারের আমলেও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতা ও এমপিদের, এমনকি তাদের মধ্য থেকে কারাদণ্ডভোগীদেরও বাছাই করে এনে মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি পদে বসানো হয়েছে। সন্ত্রাসী এবং দাগি আসামি বলে চিহ্নিত এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিরাও মন্ত্রী হয়েছেন। খালেদা জিয়ার বিগত সরকারের আমলে যাকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী করা হয়, সে ছিল দাগি অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানেও সে কারাগারে।
এ সময় থেকেই অর্থ ও পেশিশক্তির অধিকারী মানুষ বিপুল সংখ্যায় রাজনীতি এবং জাতীয় সংসদেও ঢুকতে শুরু করেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর বলেছিলেন, ‘I will make politics difficult for politician’ (আমি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি করা দুঃসাধ্য করে তুলব)। তার এই কথা সত্য হয়ে দাঁড়ায়। জিয়াউর রহমান আরও বলেছিলেন, 'টাকা কোনো সমস্যা না'। সেটিও সত্য হয়ে দাঁড়ায়।
ট্যাক্সের টাকা, চাঁদাবাজি, সুটকেসসর্বস্ব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি দ্বারা হাজার হাজার চরিত্রহীন নব্য ধনী তৈরি করা হয়। এরা প্রকৃত রাজনীতিকদের রাজনীতির অঙ্গন থেকে তাড়িয়ে সেখানে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। রাজনৈতিক দল থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সর্বত্রই এখন তাদের সংখ্যা বেশি। জিয়াউর রহমান যে খাল কেটে গিয়েছিলেন, তার পোনা মাছগুলো এখন বড় রুই-কাতলা হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগেও এখন তাদের সংখ্যাধিক্য ও প্রভাব দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানি এবং পেশিশক্তির আধিপত্য এখন এত বেড়েছে যে, শুধু বিতর্কিত ও দুর্বৃত্ত এমপিদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দিয়েই রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা যাবে, তা আমার মনে হয় না। যারা নতুন প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন, তারা যে শর্ষের ভেতরের একই ভূত নন, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? দলের মনোনয়ন পেয়ে অথবা তা ক্রয় করে সংসদে ঢোকার পর আবার তাদের বিতর্কিত চরিত্র দেখা যাবে। পুরনো বিতর্কিত সদস্যদের বদলে সমচরিত্রের নতুন ব্যক্তিরা জাতীয় সংসদে আসন নিলে সমস্যার কোনো সমাধান আশা করা যায় না।
বর্তমান হাসিনা সরকার একাধিক অভিযোগে একাধিক এমপিকে শাস্তি দিয়েছেন। এমপি কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। কোনো কোনো মন্ত্রী মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন, তাতে দল বা রাজনীতি কলুষমুক্ত হয়েছে কি? সেই চড়ুইপাখির গল্পের মতো। একটি চড়ুই ধানের গোলায় এসে একটি ধান নিয়ে উড়ে গেল। তারপর এলো আরেকটি। তারপর আরেকটি। তারপর- তারপর? এই ধানের গোলায় চড়ুই আসা বন্ধ করতে হলে গোলার মুখ ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করতে হবে। সেই কাজটি কে করবেন?
ওবায়দুল কাদেরকে সবিনয়ে বলি, জাতীয় সংসদে বিতর্কিত এমপিরা যাতে আবার ঢুকতে না পারেন, তার ব্যবস্থা করলেই চলবে না; বিতর্কিত চরিত্রের প্রার্থীরা যাতে মনোনয়ন না পায় তার শক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যবস্থাটি করতে হলে মনোনয়নপ্রার্থীর অর্থ ও পেশিশক্তিকে গুরুত্ব না দিয়ে তার জনসমর্থনের ভিত্তি, সততা ও দায়িত্ববোধের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। আওয়ামী লীগ এ কাজটি করতে পারবে কি?
এ সম্পর্কে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। একটি সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি ঢাকায় ছিলাম। বুড়িগঙ্গার ওপারে কেরানীগঞ্জের এক স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে আমি চিনতাম। তিনি বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী নেতা এবং এলাকায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যক্তি। কিন্তু তিনি সেবার জাতীয় সংসদের সদস্যপদে দলের মনোনয়ন পাননি।
তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার নমিনেশন না পাওয়ার কারণ কী? তিনি বললেন, দলের হাইকমান্ড বলেছে, আপনার পয়সা কড়ির জোর নেই। নির্বাচনে জয়ী হতে হলে এখন পয়সা লাগে। যে দলকে তিনি সারা জীবন সেবা দিয়েছেন, সেই দলের আচরণে তিনি আহত হয়েছিলেন, ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট হয়েছিল এলাকার জনগণ।
এটা লক্ষ্য করার বিষয়, দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের সময় প্রার্থী মনোনয়নে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখন আর সৎ, চরিত্রবান এবং জনগণের পছন্দের কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন না দিয়ে নীতিহীন ও অসৎ চরিত্রের কোনো নব্য ধনীকে দেয়। এরা নির্বাচিত হয়ে জনপ্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করে না, জনসেবাও করে না। নিজেদের সাধু-অসাধু ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারতায় এ সদস্যপদকে কাজে লাগায়। তাদের অনেকের সন্তানসন্ততি বা পরিবারের সদস্যদের দাপটে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এ দুর্বৃত্তেরা যে দলেরই হোক, এদের রোল মডেল সম্ভবত তারেক রহমান ও তার হাওয়া ভবন। দেশে এমন দৃষ্টিগ্রাহ্য একটি হাওয়া ভবনের জায়গায় দৃষ্টিঅগ্রাহ্য কতটি হাওয়া ভবন তৈরি হয়েছে, তা কে বলবে?
সুতরাং সাধারণ নির্বাচনের আগে দুর্বৃত্ত বা বিতর্কিত কিছু এমপি ও মন্ত্রী ছাঁটাই করে দলকে বা জাতীয় রাজনীতিকে বিশুদ্ধ করা যাবে না। কয়েকজন পুরনো বিতর্কিত ব্যক্তি হয়তো বিদায় নেবেন। কিন্তু নতুন কিছু মুখ এসে তাদের শূন্যস্থান পূরণ করবেন এবং আবার বিতর্কিত হবেন। এ সমস্যা দূর করতে হলে প্রথমে রাজনীতি থেকে মনোনয়ন বাণিজ্যটি উচ্ছেদ করতে হব। অর্থশক্তি ও পেশিশক্তি দেখে কাউকে যেন কোনো দলই মনোনয়ন না দেয় এবং টাকার জোরে মনোনয়নপত্রটি কেউ যেন কিনতে না পারে তার কঠোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে একটি কঠোর নির্বাচনবিধি তৈরির ক্ষমতা দিতে হবে এবং দুটি বড় দলকেই তা মেনে চলার গ্যারান্টি দিতে হবে।
নির্বাচনের আগে সব দলকেই প্রার্থী মনোনয়ন করতে হবে নির্বাচনী এলাকার মানুষের পছন্দের কথা জেনে এবং জনসেবায় প্রার্থীর নিষ্ঠা এবং অভিজ্ঞতা ও সততার রেকর্ড পরীক্ষা করে। কোনো কোনো দল ক্ষমতায় থাকাকালে প্রার্থীদের বাছাইয়ের জন্য গোয়েন্দা রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে। এ রিপোর্ট সবসময় সঠিক হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের উচিত, মন্ত্রী ও এমপিদের কাজ মনিটরিং করার জন্য নিজস্ব সেল তৈরি করা। নির্বাচনের আগে প্রার্থী মনোনয়নের বেলাতেও তাদের সম্পর্কে জনমত যাচাই করা এবং নিজস্ব মনিটরিং সেলের রিপোর্ট সংগ্রহ করা।
খবরের কাগজে অহরহ অনেক মন্ত্রী, এমপিসহ জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে নানা অভিযোগ ছাপা হয়। এগুলো অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হয়। এ খবরগুলো ক্ষমতাসীন দলের আমলে নেয়া উচিত। অনুসন্ধান করে এ অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। আবার সংবাদপত্রে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মী তাদের কাজের জন্য প্রশংসিত হন। নির্বাচনের সময় প্রার্থী মনোনয়নে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কথাও বিবেচনা করতে পারেন।
একটি উদাহরণ দিই। কিছুদিন আগে আলোকিত বাংলাদেশ নামে ঢাকার একটি দৈনিকে লালমনিরহাট-১ কেন্দ্রের এমপি মোতাহার হোসেন সম্পর্কে অভিযোগের দীর্ঘ ফিরিস্তি প্রকাশিত হতে দেখেছি। সবই তার স্বজনপ্রীতি ও তার সন্তানের দুর্বৃত্তায়ন সম্পর্কিত অভিযোগ। এগুলোর সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে আমি জানি না, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের উচিত এ সম্পর্কে ত্বরিত অনুসন্ধান দ্বারা ব্যবস্থা গ্রহণ করা। নতুন প্রার্থী মনোনয়নেও তারা জনমত যাচাইয়ের সঙ্গে সংবাদপত্রে কোনো জনপ্রতিনিধি সম্পর্কে মতামত প্রকাশিত হলে সেগুলো যাচাই করে দেখতে পারেন। আলোকিত বাংলাদেশের রিপোর্টেই দেখলাম মোতাহার হোসেনের নির্বাচনী এলাকা পাটগ্রামের উপজেলা চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল তার এলাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে এসব খবরের দিকেও রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া দরকার।
ওবায়দুল কাদের বিতর্কিত চরিত্রের দলীয় এমপিদের আবার মনোনয়ন পাওয়া বন্ধ করুন, তাতে জনগণ খুশি হবে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। একটি জলাশয় থেকে দূষিত পানি নিষ্কাশন করলেই জলাশয়টি বিশুদ্ধ হয়ে উঠবে না, তাতে নতুন দূষিত পানি যাতে ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা আগে করতে হবে। শর্ষে থেকে ভূত তাড়ানো হোক, কিন্তু তাতে নতুন ভূত যাতে না ঢোকে তার নিশ্চিত ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
বিশ্বে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের এখন পচনশীল অবস্থা। এ পচন বাংলাদেশের উন্নয়নশীল অর্থনীতিতেও দগ দগ করছে, রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। ফলে এ পচনশীল পশ্চিমা গণতন্ত্রের অনুসারী বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিকে কতটা কলুষমুক্ত করতে পারবে তা সন্দেহের বিষয়। যদি কেউ পারে, সেটা আওয়ামী লীগই পারবে। কিন্তু শর্ত হল আওয়ামী লীগকে আগে ঘরের জঞ্জাল সাফ করতে হবে।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন