|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
ব্রিটেনের নির্বাচন কি ইতিহাসের দিক পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে?
13 June 2017, Tuesday
এটা যেন একটা চমক সৃষ্টির কাল। আমেরিকা, ফ্রান্স এবং এখন ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনেও একটা বড় চমক সৃষ্টি হয়েছে। সব পণ্ডিতি গবেষণা এবং বিগ মিডিয়ার প্রচারণা ব্যর্থ করে আমেরিকায় ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি, লে পেন পরাজিত হয়েছেন।
এখন ব্রিটেনের থেরেসা মে পরাজিত হলেন। এই পরাজয়ে যত চমক থাক, দুটি বার্তাও রয়েছে। প্রথম বার্তাটি হল, গত শতকের শেষদিকে বিশ্বব্যাপী কট্টর ডানপন্থার যে জয়জয়কার শুরু হয়েছিল, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় লাভের পর যেন সেই জয়ে ভাটার টান লেগেছে। বইতে শুরু করেছে পাল্টা হাওয়া। আবার ইতিহাস একটা দিক পরিবর্তনের দিকে সম্ভবত ঝুঁকেছে।
ব্রিটেনের নির্বাচন ফলের দ্বিতীয় বার্তা হল, পশ্চিমা ধনতন্ত্র তাদের আধিপত্যের দুর্গ টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু প্রতিক্রিয়াশীল নারী-নেতৃত্বকে সামনে খাড়া করে ফেমিনিজমের প্রতিষ্ঠা লাভের স্লোগানের আড়ালে নিজেদের যে কায়েমি স্বার্থ ও প্রভুত্ব রক্ষার চেষ্টা করেছিল, তা ব্যর্থ হয়েছে।
লন্ডনের একটি বিগ মিডিয়া তো প্রচার শুরু করেছিল, আমেরিকায় হিলারি, ফ্রান্সে লে পেন, ব্রিটেনে থেরেসা মে এই তিন নারী নেতৃত্বের মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতবাদ যাই হোক, বিশ্বে শক্তিশালী নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তা সারা বিশ্বের জন্য কল্যাণকর হবে।
এ প্রচারণার আড়ালে পশ্চিমা গণবিরোধী গোষ্ঠীর আশা ছিল, বিশ্বে নারীবাদী শক্তির কল্যাণকর প্রসারতা বাড়ছে, এই প্রচারণার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করা এবং এই বশ্য নারী-নেতৃত্বকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পৃথিবীর সর্বত্র যুদ্ধ বাধিয়ে যে ধনবাদী ব্যবস্থা বাঁচতে চাইছে তাকে রক্ষা করা। গণজাগরণের সম্ভাবনাকে ব্যাহত করা। এ প্রচারণায় এবার সাধারণ মানুষ, এমনকি নারীরাও ভোলেনি। তারা অতীতে ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের শাসন দেখেছেন। এই মুদি-কন্যা (Grocer's Daughter) কীভাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একজন পুরুষ প্রধানমন্ত্রীর চেয়েও নির্মমভাবে ব্রিটেনের ওয়েলফেয়ার স্টেটের ভিত্তি চূর্ণ করেছেন, তা আজ সবার জানা। বাংলাদেশেও তো সরকারি দল, বিরোধী দল সর্বত্র নারী-নেতৃত্ব রয়েছে। তাতে বলা হচ্ছে, নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। বাস্তবে নারী মুক্তি কতটা ঘটেছে?
ব্রিটেনের ধনতান্ত্রিক এস্টাবলিশমেন্ট, তাদের মুখপত্র সান, ডেইলি মেইল, টাইমস, টেলিগ্রাফ ইত্যাদি বিগ মিডিয়া চেয়েছিল, থেরেসা মে’কে আগের টোরি প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো লৌহমানবী প্রমাণ করে তার নেতৃত্বে একটি আকস্মিক নির্বাচন অনুষ্ঠান দ্বারা লেবার পার্টি ও করবিন নেতৃত্বকে ধ্বংস করা, টোরি দলকে আরও বেশি আসনে জিতিয়ে আনা এবং সাধারণ মানুষের সোশ্যাল বেনিফিট আর্থিক কৃচ্ছ্রের নামে নির্মমভাবে কর্তন অব্যাহত রেখে ধনীকে আরও ধনী এবং গরিবকে আরও গরিব করার নীতি বহাল রাখা। সর্বোপরি ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে দরকষাকষির ব্যাপারে থেরেসা মে-ই সবল নেতৃত্বদানে সক্ষম এটা সাধারণ মানুষকে বোঝানো।
ব্রিটেনের এই বিগ মিডিয়ার একমাত্র প্রচার ছিল থেরেসা মে’র নেতৃত্ব হচ্ছে শক্ত এবং স্থিতিশীল (Strong and stable)। অন্যদিকে লেবার পার্টি দুর্বল এবং ব্লেয়ারপন্থীরা দলে গ্রহণ করেছে বিভীষণের ভূমিকা। জেরেমি করবিন মোটেই জনপ্রিয় নেতা নন। তিনি অচ্ছুৎ এবং নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য নেতা। তার নেতৃত্বে লেবার পার্টি কখনও নির্বাচনে জয়ী হবে না। বিগ মিডিয়ার এই প্রচারণায় ব্রিটেনের এলিট ক্লাস তথা সুশীল সমাজেরও একটা অংশ তাল মিলিয়েছে।
থেরেসা মে সম্ভবত এ প্রচারণাতেই বিশ্বাসী হয়ে তার সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ৮ জুনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, করবিনকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুচ্ছ-জ্ঞান করেছিলেন। ভেবেছিলেন লেবার পার্টিতে অনৈক্য ও নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক ফুঁৎকারে করবিনকে পরাজিত করবেন এবং নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় অর্জন করে নিজেকে মার্গারেট থ্যাচারের চেয়েও জনপ্রিয় এবং লৌহমানবী প্রমাণ করবেন। নির্বাচনে এ বিজয় হবে তার নিজের বিজয়। দলের নয়। এই বিশ্বাস থেকে তিনি তার কেবিনেটের মন্ত্রী ও দলের নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজন বোধ করেননি।
এই অহমিকা এবং ভ্রান্তি বিলাসেরই প্রায়শ্চিত্ত করছেন এখন থেরেসা মে। ক্যামেরন থেকে থেরেসা মে এ দীর্ঘ টোরি শাসনে ব্রিটিশ জনজীবন এখন নির্মমভাবে পীড়িত। শিক্ষাব্যবস্থায় ধস নেমেছে, হাসপাতালে বেড নেই, চিকিৎসা নেই। আবাসন সমস্যা প্রকট। এ পীড়িত মানুষের কাছে কেবল ব্রেক্সিটের ধুয়া তুলে যে ভোট পাওয়া যাবে না, এটা টোরি দল হিসেবে ধরেনি। তার ওপর রয়েছে বেকার সমস্যায় জর্জরিত বিশাল তরুণ সমাজ। তাদের মধ্যে টোরি অপশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ক্রমাগত পুঞ্জীভূত হয়েছে।
এই ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মের সামনেই করবিন আশার আলো তুলে ধরেছেন। ছাত্রদের টিউশন ফি বাতিলের প্রতিশ্রুতি, শিক্ষা ব্যয়ের ঋণ জর্জরিত ছাত্রসমাজকে করবিন সমর্থন করেছেন।
টোরিদের নির্মম আর্থিক কৃচ্ছ্রের নীতি বর্জন এবং সোশ্যাল বেনিফিটে অধিক অর্থ মঞ্জুর করা এবং সন্ত্রাস দমনের জন্য ব্রিটিশ রাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনয়ন রাতারাতি জেরেমি করবিনকে জনগণের হিরোতে পরিণত করে। এবারের নির্বাচনে দলের ভেতরে ব্লেয়ারপন্থী বিভীষণদের চক্রান্তের দরুন লেবার পার্টি নিরংকুশ বিজয় লাভ করতে না পারলেও এক ঐতিহাসিক বিজয়ের অধিকারী হয়েছে এবং ব্রিটেনের রাজনীতিতে দীর্ঘকাল পর একটি সোশ্যাল রেভ্যুলেশনের দরজা খুলে দিয়েছে।
এবারের নির্বাচনে টোরি দলের পরাজয় তাই প্রতিক্রিয়াশীল এস্টাবলিশমেন্ট, তাদের তল্পিবাহক বিগ মিডিয়া, বিগ বিজনেসের সম্মিলিত চক্রের পরাজয়। আগেই বলেছি, এই পরাজয় থেরেসা মে’র ব্যক্তিগত অহমিকারও পরাজয়। তিনি ব্রিটেনের কেবিনেট পদ্ধতির সরকারের প্রধান। কিন্তু নিজেকে মার্গারেট থ্যাচারের সমতুল্য বিবেচনা করে ডিক্টেটরসুলভ আচরণ শুরু করেছিলেন।
এ সম্পর্কে টোরি সমর্থক পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফ পর্যন্ত লিখেছে, ‘নির্বাচনে থেরেসা মে’র পরাজয়ের পর দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা তার মন্ত্রিসভায় কোনো সদস্য তার পক্ষে কোনো কথা বলেননি। কারণ নির্বাচনের সময় তাদের অধিকাংশকে কথা বলতে দেয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী আশা করেছিলেন, তিনি ভূমিধস বিজয়ের অধিকারী হবেন এবং এটা হবে তার ব্যক্তিগত বিজয়। তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় টোরি দলকে ভোট দেয়ার কথা বলেননি। বলেছেন, আমাকে ভোট দিন। ফলে এই পরাজয় থেরেসা মে’র নিজস্ব পরাজয়, এই নির্বাচনে যাওয়া তার জন্য ছিল এক বিরাট ঐতিহাসিক ভুল। (an electoral blunder of historic proportions শনিবার, ১০ জুন)।
ব্রিটেনের নির্বাচন থেকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোরও শিক্ষা গ্রহণের রয়েছে। দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে এই স্লোগানে নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে সুবিধা করতে পারবে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য দূর করা এবং সন্ত্রাস ও দুর্নীতি দমনে তাদের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। সুশাসন ছাড়া উন্নয়নের সুফল পাওয়া যায় না।
আরেকটি কথা, বাংলাদেশে কেবিনেট সংসদীয় পদ্ধতির সরকার চলাকালেও দেখা গেছে, সরকার চলে এক ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর। এটা ভালো নয়। কেবিনেট পদ্ধতির সরকারের মূল কথাই হচ্ছে মন্ত্রীদের সম্মিলিত ইচ্ছার সরকার। প্রধানমন্ত্রী সবার অভিমত শুনবেন, এমনকি ভিন্নমতও। তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।
এই পরামর্শ ও কনসালটেশন ছাড়া একক ইচ্ছায় সরকার চালাতে গেলে কী হয় ব্রিটেনের থেরেসা মে তার প্রমাণ বহন করছেন। তার ব্যর্থতার ভাগ নিতে তার দল এখন রাজি নয়। তিনি আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি নামক একটি ভুইফোঁড় দলের সমর্থন নিয়ে একটি জোড়াতালির মাইনরিটি গভর্মেন্ট গঠন করেছেন। এই গভর্মেন্টের স্থায়িত্ব সম্পর্কে থেরেসা মে’র শুভাকাক্সক্ষীরাও সন্দিহান। ইতিমধ্যে বরিস জনসনকে সামনে খাড়া করে তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর উদ্যোগ চলছে।
একুশ শতকের শুরুতে বিশ্ব ইতিহাসের ঘড়িরকাঁটা পেছনে ঘুরতে শুরু করেছিল। মনে হয়েছিল অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ বইয়ের ঘটনাবলি ঘটতে শুরু করেছে। তার দু’দশক যায়নি, ঘড়ির কাঁটা আবার সামনের দিকে এগোতে শুরু করেছে।
‘দনিয়েতের সঙ্গে যারা সংগ্রামের তরে প্রস্তুত হয়েছে ঘরে ঘরে’- তারই আভাস ফুটে উঠেছে এবার ব্রিটেনের নির্বাচনে। আমার আশা, বিশ্বের পূর্বে ও পশ্চিমে ট্রাম্প ও মোদি যুগের অবসান খুব দূরে নয়।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন