রবীন্দ্রনাথের সেই গানের কলিটি নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। ‘ওগো দখিন হাওয়া, দে দোল দে দোল।’ এ গানটি লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ কি জানতেন, বসন্তের দখিন হাওয়ায় নয়, রাজনীতির কট্টর দখিন হাওয়ার জোয়ারে সারা উপমহাদেশ একদিন প্লাবিত হবে?
রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, সৈয়দ আহমদ, সৈয়দ আমির আলি, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষীর চেষ্টায় যে আধুনিক, উদার সমাজব্যবস্থা উপমহাদেশে গড়ে উঠেছিল তাতে ধ্বংসের ছোঁয়া লাগবে? এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতির শতকে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার যুগে ফিরে যাওয়ার জন্য উপমহাদেশের প্রধান তিনটি দেশেই প্রতিযোগিতা শুরু হবে?
না, এ কথা কেউ ভাবেননি। ধর্মীয় জাতীয়তার ছুরিতে ভারত ভাগ হওয়া সত্ত্বেও গান্ধী-নেহেরু চেয়েছেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ, উদার, আধুনিক ভারত গড়ে তুলতে।
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ চেয়েছিলেন ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়, কামাল আতাতুর্কের তুরস্কের মতো একটি আধুনিক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। আর শেখ মুজিব তো সবার শেষে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের স্বপ্নের শবদেহ এখন উপমহাদেশের তিনটি দেশেই ভূমিশয্যায় পড়ে আছে।
পাকিস্তানে যে জিন্নাহর স্বপ্ন সফল হবে না, এটা গোড়া থেকেই অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন। কাঁঠাল গাছে আমের ফলন হয় না। ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতেও আধুনিক রাষ্ট্র গড়া যায় না। জিন্নাহর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মস্ক এবং মিলিটারি দেশটাকে দখল করে এবং সৌদি আরবের অনুকরণে ধর্মান্ধ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চালায়। পরিণতি আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধ। দেশটাতে মুসলানের হাতে মুসলমান নর-নারী নিত্য নিহত হচ্ছে। তারা মসজিদ পর্যন্ত ভাঙছে। সৌদি আরবে তো পবিত্র কাবা শরিফের ওপরই হামলা চালানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সৌদি সরকার কোনোরকমে সেই হামলা ব্যর্থ করেছে।
বাংলাদেশেও অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন করার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় নিহত হন। নিহত হন তার সহকর্মী নেতারা। পাকিস্তানের অনুকরণে এখানেও মস্ক এবং মিলিটারি ক্ষমতা দখল করে। শুরু হয় নির্মীয়মাণ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রটির ভিত ভাঙার কাজ।
দীর্ঘ একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কল্যাণে এ ভাঙার কাজটি প্রতিহত করা হয়েছে। কিন্তু এ ভাঙনের অপদেবতারা এখনও পরাজিত হননি। তারা কখনও জামায়াতি, কখনও হেফাজতিবেশে, কখনও বিএনপির কাঁধে চেপে দেশটাকে পশ্চাৎমুখী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এ চেষ্টা সফল করার কাজে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটা দক্ষিণপন্থী অংশকেও প্রভাবিত করে ফেলেছে। প্রবাদ আছে, ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট।’ আওয়ামী লীগেরও এই হাইব্রিড অংশের নেতাদের মুখে শেখ মুজিব, কিন্তু বগলে হেফাজত।
যেসব বিদেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, যেমন ব্রিটেনের প্রয়াত জ্যাক ওয়াডিস আশা করছিলেন উপমহাদেশে গান্ধী ও নেহেরুর আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক ভারত রাষ্ট্র গঠনের সাধনা সফল হয়েছে এবং ভারতই গোটা এশিয়ায় (চীন কমিউনিজমের পথে যাওয়ায়) গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন ও তা রক্ষার শক্তিশালী পাহারাদার হবে, তারা এখন বেঁচে থাকলে (কেউ কেউ বেঁচে আছেন) কী ভাবতেন, তা বলা মোটেও মুশকিল নয়।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ায় ভারতের সাহায্য, শ্রীলংকায় সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিলবাদ রোখায় ভারতের ভূমিকা ও রাজীব গান্ধীর আত্মদান, নেপালে মাওবাদী সন্ত্রাসীদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথে টেনে আনা, এমনকি ক্ষমতায় বসতে দেয়া ভারতে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিই বিশ্বময় গড়ে তুলেছিল।
অনেকেরই ধারণা ছিল, ভারতের এই দৃঢ়মূল গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা সহজে কেউ ভাঙতে পারবে না। প্রধানন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার সেই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভেঙে দিয়েছেন। অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে প্রথম বিজেপি সরকার ভারতের অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভিত ভাঙার যে চেষ্টায় হাত দিতে সাহসী হননি, সে সাহস দেখাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকার। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ ধ্বনি তুলে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভারতকে একটি কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা শুরু করেছেন।
মোদি সরকার মুসলমান, খ্রিস্টান ও দলিত সম্প্রদায়কে দলনের যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তাতে ভারতের গণতান্ত্রিক শিবির এবং চিন্তাশীল ব্যক্তিরাও শঙ্কিত, রাষ্ট্রপতি পদে প্রণব মুখার্জির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারীকে ওই পদে বসানোর ব্যাপারে সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর মধ্যে যে ঐকমত্য গড়ে তোলা যেত, তাকে উপেক্ষা করে একজন কট্টর হিন্দুত্ববাদীকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ চেষ্টা শুরু করেছেন। এই চেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন প্রবীণ কলামিস্ট কুলদীপ নায়ারও।
কলকাতার ‘দৈনিক স্টেটসম্যানের’ কলামিস্ট বরুণ দাসগুপ্ত লিখেছেন, মোদি সরকার ক্রমেই কট্টর হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা ও আরএসএসের নির্দেশ মেনে চলতে শুরু করেছেন। এ সংঘ পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর ওপর দিন দিন বাড়ছে। এটা ভারতের বহুত্ববাদী সমাজের জন্য অশনিসংকতে। বরুণ বাবুর এ মন্তব্যে বাংলাদেশের মানুষদেরও সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ বাংলাদেশেও ক্ষমতাসীন দলের মাথায় হেফাজতিরা ডাণ্ডা ঘোরাতে শুরু করেছে। যদিও ভারতের মতো তা এখনও ততটা প্রকট নয়।
১০ জুন বরুণ দাসগুপ্ত দৈনিক স্টেটসম্যানে একটি নিবন্ধ লিখেছেন, তার শিরোনাম- ‘ভারতের উত্তরণ কি গণতন্ত্র থেকে গো-তন্ত্রে?’ এ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতের প্রধান উত্তরণ হচ্ছে গণতন্ত্র থেকে গো-তন্ত্রে। হাম্বা হাম্বা গো-রব আমাদের গৌরব বাড়াচ্ছে সারা বিশ্বে। গো-হত্যা নিষিদ্ধ হয়েছে, কেউ গবাদিপশু ক্রয়-বিক্রয়ের বাজারে গরু বিক্রি করতে গেলে তাকে গ্যারান্টি দিতে হয়, যে গরু সে বিক্রি করছে তা জবাই করা হবে না, অবশ্য সরকারি আদেশ বেরোনোর অনেক আগে থেকেই সংঘ পরিবারের গো-রক্ষকরা ট্রাকে করে কেউ গরু নিয়ে গেলে তাদের ধরে জবাই করা শুরু করেছিল। এবার তাদের কাজ সরকারি অনুমোদন পেল।’
গো-হত্যা নিবারণের নামে সংঘ পরিবারের দুর্বৃত্তরা মানুষ খুন করাও শুরু করেছে। গরুর মাংস বিক্রেতা, যাদের অধিকাংশই মুসলমান, তারা মাথায় হাত দিয়ে পথে বসেছে। এমনকি ভারতের লেদার ইন্ডাস্ট্রিতেও বড় রকমের সংকট দেখা দিতে যাচ্ছে। কিন্তু মোদি সরকার তাতেও অবিচল। তবে ভারতে শেষ পর্যন্ত তারা গো-তন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সফল হবেন কিনা তাতে সন্দেহ আছে। কেরলের সিপিএম সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার বলেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের গো-হত্যা বন্ধ করা সম্পর্কিত নির্দেশ তারা মানবেন না। দরকার হলে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন।
গো-হত্যা বন্ধের আইন নিয়ে বিজেপির মধ্যেও আপত্তি উঠেছে। অরুণাচলের বিজেপি দলীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রেমা খান্ডু প্রকাশ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছেন। বলেছেন, ‘আমি গো-মাংস খাই এবং তাতে দোষের কিছু আছে মনে করি না।’ মেঘালয়ের দুই বিজেপি নেতাও- বার্নার্ড মারক এবং বাচ্চু মারক দল ছেড়ে দিয়েছেন গো-মাংস খাওয়ার ইস্যুতে। বাচ্চু মারক বলেছেন, ‘গরুর মাংস খাওয়া আমাদের গারোদের অভ্যাস ও সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ। আমরা গারোদের এ ঐতিহ্যে আঘাত করে তাদের মনে কি ব্যথা দেব?’ অন্যদিকে বার্নার্ড মারক মোদি সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে একটা বিফ পার্টির আয়োজন করেছিলেন এবং সবাইকে গরুর মাংস খাইয়েছেন। গো-তন্ত্রের গৈরিক সাধকরা এই বার্নার্ড মারকের কল্লা নেয়ার সাহস দেখাতে পারেনি।
ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি কোনো ধর্মেই স্বীকৃত নয়। সারা উপমহাদেশেই ধর্মান্ধরা ধর্মের নাম ভাঙিয়ে যা করছে তা প্রকৃত ধর্ম নয়, তা মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ। এ অপরাধীরা ধর্মের আসল সত্য জানে না এবং কখনও অনুধাবন করে না। বরুণ দাসগুপ্ত সে কথা লিখেছেন তার ‘স্টেটসম্যানের’ নিবন্ধে। তিনি লিখেছেন, ‘পাঁচ হাজার বছরের হিন্দু সভ্যতার (ভারতীয় সভ্যতা নয়) ধ্বজাধারীদের নিয়ে মুশকিল হল তারা হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো পড়েও দেখেননি। পড়লে তারা জানতেন, প্রাচীন ভারতে গো-মাংস ভক্ষণের যে রেওয়াজ ছিল, তার অসংখ্য উল্লেখ আছে বেদ থেকে শুরু করে মনুস্মৃতি পর্যন্ত সর্বত্র।’
ধর্মান্ধতার ভিত্তিই হচ্ছে ধর্মের আসল সত্য সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের প্রবণতা। বাংলাদেশে জামায়াতি ও হেফাজতিদের ধর্মান্ধতা প্রচারের মধ্যে একই উদ্দেশ্য কাজ করছে। বাংলাদেশের সরকারও যা-ই করুক, সাধারণ মানুষের মনে ক্রমজাগ্রত সচেতনতা ধর্মান্ধদের এ উদ্দেশ্য ব্যর্থ করবে বলে আমার প্রত্যয়। ভারত সম্পর্কেও একই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বরুণ বাবু তার নিবন্ধে।
তিনি লিখেছেন, ‘গরু নিয়ে যতই কৃত্রিম উত্তেজনা সৃষ্টি করা হোক, গো-হত্যা নিরোধের অজুহাতে দেশের মানুষকে সাম্প্রদায়িক লাইনে, উচ্চবর্ণ ও নিন্মবর্ণের লাইনে বিভাজনের চেষ্টা করা হোক, দেশের জ্বলন্ত অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর তাতে কোনো সমাধান হবে না এবং বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের বঞ্চনা ও শোষণের কারণে বারবারই রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
পুলিশের গুলিতে মরতে হবে জেনেও দাঁড়াবে। গণতন্ত্র থেকে গো-তন্ত্রে উত্তরণ, যেখানে রাষ্ট্র শুধু গো-ব্রাহ্মণ হিতায় চ’ এই নীতি নিয়ে পরিচালিত হবে, তা দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ মেনে নেবে না। গরু জবাই বন্ধ হবে আর শাসক দল বিরোধী মানুষদের অবাধে প্রকাশ্যে হত্যা করবে এ মধ্যযুগীয় বর্বরতা ভারতে ফিরিয়ে আনা যাবে না।’
বাংলাদেশ সম্পর্কেও এ কথা সত্য। হেফাজতিরা যতই আউল-বাউল, সুফি ও মরমি সাধকদের এ দেশে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করুক, তা সফল হবে না। বাঙালির হাজার বছরের লোকজ সভ্যতাই তাকে রক্ষা করবে।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন