|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
এশীয় রাজনীতিতে ইসরায়েলের অশুভ অনুপ্রবেশ
30 July 2017, Sunday
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি গোটা এশীয় রাজনীতিতে বড় রকমের প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে মনে হয়। ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সখ্য ও সহযোগিতা এশীয় রাজনীতির এবং ব্যাপক অর্থে বিশ্ব-রাজনীতির এক টার্নিংপয়েন্ট বলে অনেকেই বিবেচনা করছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইসরায়েল সফর, এক বৈঠকেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে তিনবার আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়া মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে তুলতে পারে। নেতানিয়াহু ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে বলেছেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে এই বন্ধুত্বের জন্য ষাট বছর অপেক্ষা করেছি।’
স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের নেহরু সরকারের নীতি ছিল প্যালেস্টাইনের আরবদের মুক্ত সংগ্রামে সমর্থন দেওয়া এবং ইসরায়েলের মতো একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের বৈধতাকে স্বীকার না করা। কংগ্রেস দল যতদিন ক্ষমতায় ছিল এই ইসরায়েল-বিরোধী নীতি অনুসরণ করেছে। নরসীমা রাওয়ের কংগ্রেসী সরকার ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত ভারত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল, ‘যে কারণে ভারত ভাগ করে পাকিস্তান নামে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা বিরোধী ছিল, সেই একই কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল নামে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা বিরোধী।’
দিল্লির এই নীতির দরুনই ভারতের নিজস্ব কাশ্মীর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ভারতের সঙ্গেই বেশি মৈত্রী গড়ে তুলেছেন। ঘোর ইসরায়েল-বিরোধী এবং আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরের সঙ্গে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বন্ধুত্বতো এখন ইতিহাসে কিংবদন্তির গল্প।
তারপর ধীরে ধীরে সময় বদলায়, পরিস্থিতি ঘুরে যায়। দিল্লিতে কংগ্রেস শাসনের অবসান ঘটে এবং ঘোর সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি ক্ষমতায় আসে। অটল বিহারি বাজপেয়ী হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার আমলেই তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন।
কংগ্রেস সোনিয়া গান্ধী ও ড. মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে আবার ক্ষমতায় এসে বাজপেয়ী সরকারের অনুসৃত ইসরায়েল সংক্রান্ত নীতি থেকে আর সরে আসেননি। বরং স্থিতাবস্থা বজায় রেখেছেন। ইত্যবসরে মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতির সম্পূর্ণ পটপরিবর্তন ঘটে। আফগান যুদ্ধ এবং আরবদের শক্তিশালী বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরই একক সুপার পাওয়ার আমেরিকার সমর্থন ও সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসন অদম্য হয়ে ওঠে। ইসরায়েলের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হিসেবে যে সব আরব রাষ্ট্র ছিল যেমন মিসর, ইরাক ও লিবিয়া তাদের ধ্বংস করা হয়। পাকিস্তানকে শিখন্ডি হিসেবে সামনে খাড়া রেখে তালেবান, আলকায়েদা এবং শেষ পর্যন্ত আইএস নামক ভয়াবহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জন্ম দেওয়া হয়।
এই সন্ত্রাসী দলগুলোর একটিরও ইসরায়েল-বিরোধী কোনো কার্যক্রম নেই। এরা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে আরব দেশগুলোতে যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে, তাতে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রাম দুর্বল হয়েছে, আরব ঐক্য ধ্বংস হয়েছে। কিছু বিভীষণ আরব রাষ্ট্র যেমন সৌদি আরব, মিসর ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইসরায়েল-বিরোধী সর্বশেষ দুটি মুসলিম দেশ ইরান ও সিরিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া শক্তিশালী হয়ে না উঠলে এবং ইরান ও সিরিয়াকে সমর্থন না দিলে এতদিনে এই দুটি রাষ্ট্রও ধ্বংস হতো।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনের জন্য ব্রিটিশ রাজ যেমন অতীতে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে উসকে দিয়েছে এবং কাজে লাগিয়েছে, বর্তমানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সেই একই নীতি অনুসরণ করে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের বিবাদকে কাজে লাগিয়ে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করেছে। এই শত্রুতার ফলে সৌদি আরব ইসরায়েলের পরিবর্তে ইরানকেই প্রধান শত্রু হিসেবে গণ্য করে ইসরায়েলের সহায়তায় ইরান ও সিরিয়াকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে এই আত্মঘাতী সংঘর্ষ সৃষ্টি করে তার ফায়দা লুটছে আমেরিকা ও ইসরায়েল। তালেবান থেকে আইএস সন্ত্রাসীদের জন্ম দিয়ে ইসলামের নামে সন্ত্রাসের খোলস পরিয়েছে আমেরিকা এবং তার রূপকার ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। একথা তো এখন ওপেন সিক্রেট। সন্ত্রাস দমনের নামে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ন্যাটো ও পশ্চিমা সৈন্যদের যে অব্যাহত হামলা চলছে তা ওয়াশিংটন ও তেল আভিভের যৌথ পরিকল্পনা। মুসলমানরাই এখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের দেশ ধ্বংস করছে, এমন পরিস্থিতি প্রথম মহাযুদ্ধের পর ওসমানিয়া বা অটোম্যান এমপায়ার ভেঙে পড়ার সময়েও দেখা যায়নি।
এমন এক পরিস্থিতিতে ভারতের মোদী সরকারের ইসরায়েলের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার নীতি গ্রহণ করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘ইসলামের ডিফেন্ডার’ হওয়ার দাবিদার সৌদি আরব যদি ইসরায়েলের পরম বন্ধু হতে পারে এবং মোসাদকে ‘পবিত্র আরব ভূমিতে’ অবাধ তত্পরতা চালাতে দিতে পারে, তাহলে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকারের ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামরিক সহযোগিতা ব্যাপকভাবে বাড়ালে তাতে কারো বিস্মিত হওয়ার কারণ থাকতে পারে কি? ইসরায়েল প্যালেস্টাইনে বিদ্রোহী আরব মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, ভারত তেমনই কাশ্মীরে বিদ্রোহী কাশ্মীরি মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধরত। এক্ষেত্রেও দুই দেশের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা মিল আছে।
মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার নীতি হলো সর্প হয়ে দংশন করা এবং ওঝা হয়ে বিষ নামানোর অভিনয় করা। এই নীতির সাফল্যের ফলে শুধু ইরাকে ও লিবিয়ায় দু’জন শক্তিশালী সেকুলার নেতার পতন ঘটেনি, তুরস্ক ও মিসরের মতো দু’টি প্রতিষ্ঠিত সেকুলার রাষ্ট্রে মৌলবাদের অভ্যুত্থান ঘটেছে। আমেরিকার নীতি একদিকে হিংস্র মৌলবাদকে তোল্লা দেওয়া এবং অন্যদিকে হিংস্র মৌলবাদী বা জিহাদিস্টদের দমনের অজুহাতে সামরিক হামলা অব্যাহত রেখে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্য ও শক্তি ধ্বংস করা। আমেরিকার অনুগত নরম মৌলবাদীরা কোনো দেশে ক্ষমতা দখল করলে ওয়াশিংটনের আপত্তি নেই। বাংলাদেশে যেমন জামায়াতের প্রতি তাদের সহানুভূতি।
এজন্যেই ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এক সময় গুজরাত দাঙ্গার জন্য দায়ী করে মার্কিন সরকার তাকে আমেরিকায় ঢোকার ভিসা দেয়নি। পরবর্তীকালে সেই আমেরিকায় দুই প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প তার সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে ফোটো-সেসন করেছেন। নরেন্দ্র মোদীকে ওয়াশিংটনে বিরল সম্মান দেখানো হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে ভারতের নরেন্দ্র মোদীর দৃঢ় মৈত্রী গড়ে ওঠার ফলে অবশ্যই ভারত উপকৃত হবে। ভারতের সামরিক শক্তি বাড়বে। কাশ্মীরে বিদ্রোহ দমনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাহায্য সে পাচ্ছে এবং আরো পাবে। ইসরায়েলও মধ্যপ্রাচ্যে আরো শক্তিশালী হয়ে সকল শান্তি পরিকল্পনা অগ্রাহ্য করে প্যালেস্টিনিদের বিরুদ্ধে বর্বর দমননীতি অব্যাহত রাখতে পারবে।
ভারত-ইসরায়েল সহযোগিতা শুধু এশিয়ার রাজনীতিতে নয়, বিশ্ব রাজনীতিতেও বর্তমান স্থিতাবস্থা ও শক্তির ভারসাম্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। রাশিয়া ও চীন এখন পর্যন্ত ইসরায়েল-বিরোধী নয়। বরং ইসরায়েলের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক রক্ষার নীতি বজায় রাখতে আগ্রহী। কিন্তু ভারত-ইসরায়েল মৈত্রী যদি চীনের এশীয় নীতির জন্য কোনো আশঙ্কা সৃষ্টি করে, কিংবা রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে বিশ্ব-রাজনীতিতেও বড় রকমের একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইতে পারে। শক্তির ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রেও বর্তমান কাঠামোতে আঘাত লাগতে পারে।
বিশ্বে পশ্চিমা জোটের একক অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রভাবের বিরুদ্ধে ভারত-চীন-রাশিয়া ও ব্রাজিল মিলে একটি নতুন জোট এবং বিশ্বব্যাংকের বিকল্প একটি নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগ কি অব্যাহত থাকবে, না ভারত-ইসরায়েল উত্তরোত্তর সম্পর্ক বৃদ্ধি বর্তমান অবস্থায় মোড় ঘুরিয়ে দেবে? অনেকের ধারণা, মোড় ঘুরিয়ে দেবে। যদি তা হয়, তাহলে বাংলাদেশও পরিবর্তনের এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ শুধু পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে নয়, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও ক্রমশ প্রভাব ও অনুপ্রবেশ বাড়াচ্ছে। ভারতের সঙ্গে দৃঢ় মৈত্রী তার এই শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধিকে আরো সহায়তা দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও যে মোসাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে, আমেরিকায় শেখ হাসিনার পুত্র জয় ওয়াজেদকে অপহরণের চক্রান্তে মোসাদের এজেন্টের জড়িত থাকার খবর ফাঁস হওয়ায়। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সঙ্গেও মোসাদের গোপন যোগাযোগের অভিযোগ একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিকাংশ দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির যে নীতি ইসরায়েল গ্রহণ করেছে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশেও ইসরায়েল সেই নীতি অনুসরণ করতে চাইলে বিস্ময়ের কিছু নেই। বাংলাদেশে জামায়াতিদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ রক্ষা করে চলার খবর এক সময় পাওয়া গিয়েছিল। ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস ও জিহাদিস্টদের ট্রেনিং দেওয়া ও অস্ত্র সরবরাহে ইসরায়েলের ভূমিকার কথাতো পশ্চিমা সংবাদপত্রেই প্রকাশিত হয়েছে।
একদিকে আমেরিকায় ট্রাম্প-প্রেসিডেন্সি যে অস্বস্তিকর ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এবং তা বাড়াচ্ছে, তার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের আগ্রাসী শক্তি ও তত্পরতা বৃদ্ধি এবং গোটা এশীয় রাজনীতিতে তার প্রভাব বৃদ্ধি বিশ্ব রাজনীতিতে অশুভ পরিবর্তনের সূচনা করবে বলে অনেকের আশঙ্কা, এই আশঙ্কাটি অসত্য হোক, এটাই আমার আন্তরিক প্রার্থনা।
ইত্তেফাক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন