পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক মাফিয়া পরিবারের প্রধান দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে ক্ষমতা থেকে সরে গেছেন। কিন্তু তার মাফিয়া পরিবারটি ক্ষমতায় রয়ে গেছে।
পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে দুর্নীতি ও জালিয়াতির দায়ে সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নওয়াজ শরিফ সরে গেছেন বটে।
কিন্তু তারই ছোট ভাই শাহবাজ শাসক মুসলিম লীগের (নওয়াজ) মনোনয়নে প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। পাকিস্তানে এখন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত দুটি বিত্তশালী পরিবারের মধ্যে। একটি জারদারি (বেনজির ভুট্টোর স্বামী) পরিবার।
অন্যটি শরিফ পরিবার। এই দুই পরিবারের কোনটি কখন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নিরূপণের মালিক নেপথ্যে আর্মি। কেউ কেউ বলেন, আর্মির সহযোগী জুডিশিয়ারিও।
লন্ডনের গার্ডিয়ানের ২৯ জুলাইয়ের সংখ্যায় তারিক আলী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ সম্পর্কে যে কলাম লিখেছেন, তার হেডিং দিয়েছেন- Sharif has gone but pakistan's huge corruption problem stays (শরিফ গেছেন কিন্তু পাকিস্তানের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির সমস্যা রয়েই গেছে)। জারদারির শাসনামলে তার বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তিনি একবার দুর্নীতির দায়ে নওয়াজ শরিফকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। শরিফ ক্ষমতায় এসে জারদারিকে করেছেন দেশছাড়া।
পাকিস্তানের পলিটিশিয়ান, আর্মি, এমনকি জুডিশিয়ারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাহাড় সমান। দুর্নীতি সম্পর্কে পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদেরও মনোভাব কী সে সম্পর্কে তারিক আলী তার গার্ডিয়ানের নিবন্ধে একটি চমৎকার তথ্য দিয়েছেন। বেনজির ভুট্টো যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন তারিক আলীকে একদিন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘দেশের মানুষ তার সম্পর্কে কী বলে? তারিক আলী বলেছেন, দেশের মানুষ বলে আপনার স্বামী জারিদারি একজন চরম দুর্নীতিবাজ। কিন্তু স্বামীর এই দুর্নীতির কথা আপনি কতটা জানেন, তা তারা জানে না।’
এরপর তারিক আলী লিখেছেন, ‘স্বামীর দুর্নীতির কথা বেনজির সবই জানতেন। সেজন্য তিনি কিছুমাত্র লজ্জিত ছিলেন না। হেসে তারিক আলীকে বলেছেন, ‘তুমি একজন প্রুডিস (নীতিবাগিশ)। সময় বদলে গেছে। প্রত্যেক রাজনীতিবিদ এ কাজটা করছেন, প্রতিটি পশ্চিমা দেশেও। এই হল দুর্নীতি সম্পর্কে পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর মতো রাজনৈতিক নেতার মনোভাব। সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক হত্যাকাত সম্পর্কে পাকিস্তানের শাসক রাজনৈতিক দলগুলোর এবং বেনজির ভুট্টোর মনোভাব কী তা তার আ-জীবনীমূলক বই ‘ডটার অফ ইস্ট’ (প্রাচ্যকন্যা) বইটি পড়লেই বোঝা যায়। ’৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যায় এবং ’৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যায় তার পিতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সংশ্লিষ্টতা যেভাবে তিনি চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, তাতে তার রাজনৈতিক সততার পরিচয় পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানে বেপরোয়া দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত আর্মি। শুধু দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নয়, আফগানিস্তানে তালেবান রাজত্বকালে অবৈধ পপিচাষ ও ড্রাগস ব্যবসায়ে পাকিস্তানের আর্মি জেনারেলরা কতটা ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন, তার বিবরণ পশ্চিমা মিডিয়াতেই প্রকাশ করা হয়েছে। তারিক আলীর মতে, ‘পাকিস্তানে যদি সৎ ও আন্তরিক রাজনীতিবিদ খোঁজা হয়, তাহলে দেশটির ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি স্থায়ীভাবে শূন্য থাকবে।’ এই যেখানে পাকিস্তানের অবস্থা, সেখানে নওয়াজ শরিফকে বেছে বেছে শাস্তি দেয়া হল কেন? এই শাস্তি দেয়ার পেছনে একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত আছে। জাতীয় প্রেক্ষিতটির ব্যাপারে পরে আসছি, আগে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতটির ওপর আলোকপাত করি।
‘গার্ডিয়ান’ তার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছে, A Pakistani Prime minister falls, but this is an international affair (একজন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর পতন হয়েছে, কিন্তু এটা একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার)। পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারি অপ্রত্যাশিতভাবে ফাঁস হওয়া শুধু নওয়াজ শরিফ ক্ষেত্রে নয়, বিশ্বের আরও কোনো কোনো দেশের রাজনৈতিক নেতার বেলায় ঘটেছে। বিদেশে পাচার করা (ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া) অর্থ এবং অবৈধভাবে সম্পত্তি ক্রয়ের যে বিশাল দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকেও কয়েকদিনের মধ্যে সে কারণে পদত্যাগ করতে হয়। ব্রিটেনের সাবেক টোরি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও তার ফ্যামিলি ট্যাক্স সংক্রান্ত বিষয়ে তদন্তের সম্মুখীন হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত একই ধরনের কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পাকিস্তানের নওয়াজ শরিফও ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নওয়াজ শরিফের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। চীনের সঙ্গে তিনি যতই ঘনিষ্ঠ হচ্ছিলেন, ততোই মার্কিন প্রশাসন তার ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছিল। সৌদি আরবের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রতিবেশী ইরানকে রুষ্ট করেছে। আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীবিরোধী তৎপরতায় সাহায্য দানে মার্কিন প্রশাসনের ক্রোধ এবং পাকিস্তানে ড্রোন হামলার হুমকি নওয়াজ শরিফের ভাগ্য অনেকটা নির্ধারণ করে দিয়েছিল। পাকিস্তানকে উপেক্ষা করে আমেরিকায় ওবামা এবং ট্রাম্প দুই প্রশাসনই ভারতের বন্ধুত্বের জন্য ঝুঁকে পড়ায় নওয়াজ শরিফ পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে দহরম-মহরম করার যে নীতি গ্রহণ করেন, তাতে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানো আমেরিকা প্রয়োজন মনে করেছে।
নওয়াজ শরিফ হয়তো বুঝতে পারেননি, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে সম্পর্কের গুজব সত্য-মিথ্যা যা-ই হোক, মার্কিন এস্টাবলিশমেন্ট পুতিন ও রাশিয়াকে ট্রাডিশনাল শত্রু মনে করে। এজন্য আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়া ট্রাম্পকে সহায়তা করেছে কিনা তার ব্যাপক তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ট্রাম্পের ভাগ্যে কী ঘটবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। নওয়াজ শরিফের আগে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে, আমেরিকার নিষেধ না শুনে চীনের সাহায্যে আণবিক বোমা বানানোর উদ্যোগ নিতে গিয়ে।
ভুট্টোকে ফাঁসি দেয়ার কাজে পাকিস্তানের জুডিশিয়ারিও সাহায্য জুগিয়ে ছিল। এজন্য ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যাকে অনেকে জুডিশিয়াল কিলিং আখ্যা দেন। ভুট্টোর সময় থেকেই জুডিশিয়ারি ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। নওয়াজ শরিফের সময় সেই বিরোধ তুঙ্গে উঠেছিল। সুতরাং এখন অনেকেই মনে করেন, কেবল ন্যায়বিচার ও দুর্নীতি দমনের জন্য পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট শরিফের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তা সর্বাংশে সঠিক নয়। এর পেছনে প্রতিশোধ স্পৃহা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও কাজ করেছে। নওয়াজ শরিফের ভাগ্য ভালো, নিজেকে অতি চালাক মনে করে ভুট্টোর মতো তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়নি; দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে তাকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেছেন। ক্ষমতা তার একেবারে হাতছাড়া হয়েছে তা নয়। তার মুসলিম লীগই এখন ক্ষমতায় থাকবে। তার ভাই শাহবাজ শরিফ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী। তার দলের মনোনয়নে কোনো একটা নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হতে পারলেই তিনিই হবেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
জাতীয় রাজনীতিতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল নওয়াজ শরিফের প্রতিপক্ষ। পাকিস্তানের অঞ্চল বিশেষে এই দলের জনপ্রিয়তা আছে; কিন্তু শরিফের মতো অর্থবল নেই। ইউরোপের মাফিয়া সর্দাররা যেমন বিরাট অর্থবল থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বাঁচতে পারে না, তেমনি শরিফ পরিবার অর্থের পাহাড়ের ওপর বাস করলেও পরিবারের প্রধানকে রক্ষা করতে পারেনি। তারিক আলী তাই ঠাট্টা করে লিখেছেন-‘his billions could not byu a single judge this time.’ (নওয়াজের কোটি কোটি টাকা একজন বিচারককেও ক্রয় করতে পারেনি) আমার ধারণা, তার কারণ পাকিস্তানের বিচারকদের সততা নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিকূল পরিবেশের দরুন এই বিচারপতিরা ন্যায়বিচারের প্রতীক সাজতে বাধ্য হয়েছেন।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতি নওয়াজ শরিফ নিজেই সৃষ্টি করেছেন। তার এবং তার পরিবারের দুর্নীতি, জেহাদিস্টদের দমনের ব্যাপারে তার অনাগ্রহ, বরং নিজের ক্ষমতার স্বার্থে তাদের ব্যবহার করার চেষ্টা, আর্মির টপ অফিসারদের দুর্নীতি দমনে তার অক্ষমতা জনমনে তার সম্পর্কে বিরাট আস্থাহীনতা তৈরি করে। চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় তার দ্বিমুখী নীতি- অর্থাৎ একদিকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং অন্যদিকে ভারতের মোদি সরকারের মনোরঞ্জনের জন্য আকুল প্রচেষ্টা মোদি সরকারের বিশ্বাস অর্জন করেনি, অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক ও অসামরিক ভারতবিরোধী অংশকে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সক্রিয় করে তোলে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নওয়াজবিরোধী সব মহলের ইচ্ছাকে পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট পূরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচারে তাদের ‘সাহসী ভূমিকা’ দেখিয়ে।
পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের এই পতন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকদেরও সতর্ক হওয়া উচিত। বাংলাদেশে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দুর্গ একটি হাওয়া ভবন আমরা দেখেছি। এখন দেশে ছোট-বড় অসংখ্য হাওয়া ভবন গড়ে উঠেছে। এই হাওয়া ভবনের অধীশ্বররা ভাবছেন, তাদের কোনোদিন বিচার হবে না, সেই বিচারব্যবস্থা দেশে নেই। কিন্তু তারা জানে না পাপ একদিন নিজের শরীরের ভারেই ভূমিশয্যা নেয়। তার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি থাকে না। যে পাপের ভারে আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের পতন ঘটে।
পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব কোনো দেশে সুশাসন নিশ্চিত করে না। সুশাসন নিশ্চিত করে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমঝোতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ না করা। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগকে ক্রমাগত কোণঠাসা করার নীতি গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু বিচার বিভাগ সুযোগ পেলে কী ধরনের প্রতিশোধ নিতে পারে, পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে দেশের সুপ্রিমকোর্টের সর্বসম্মত রায় তার একটি বড় প্রমাণ। কথায় বলে, কেউ দেখে শেখে, কেউ শেখে ঠেকে, বাংলাদেশ দেখে শিখলে ভালো হয়।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন