|
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
test@gmail.com |
|
গল্পের খরগোশ ও কচ্ছপের ভূমিকায় ডোনান্ড ট্রাম্প ও কিম জং
29 September 2017, Friday
শৈশবে পাঠ্যবইয়ে খরগোশ ও কচ্ছপের গল্প পড়েছিলাম। খরগোশ ও কচ্ছপের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা হয়েছিল। দ্রুতগামী খরগোশের জেতার কথা, জিতেছিল অতি ধীরগতির কচ্ছপ। কারণ, দ্রুতগামী খরগোশ ভেবেছিল, সে তো প্রতিযোগিতায় জিতবেই। তাই পথের মাঝে সে একটু ঘুমিয়ে নিয়েছিল। খরগোশ যখন ঘুমাচ্ছিল, কচ্ছপ তখন ধীর পায়ে অনবরত হেঁটে আগেই লক্ষ্যস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল। গল্পটা মনে পড়ল, আমেরিকার বাকপটু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং আনের মধ্যে বাকযুদ্ধের প্রতিযোগিতা দেখে। এই যুদ্ধে মহাশক্তিধর ট্রাম্প এগোতে পারছেন না। আসল যুদ্ধ শুরু হলে পারবেন কি?
দুই দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধটি আরও তীব্র হয়ে উঠেছে, উত্তর কোরিয়া তার ষষ্ঠ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা ৩ সেপ্টেম্বরে ঘটানোর পর। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সদম্ভে ঘোষণা করেন, উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট-নেতৃত্বকে তিনি উৎখাত করে ছাড়বেন। তার ভাষায় ‘north korea's leadership won't be around much longer’ (উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্ব বেশিদিন আর ক্ষমতায় থাকছে না)।
উত্তর কোরিয়ার জনসংখ্যা এখন ২৬ মিলিয়ন। এই দেশটিকে ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস করার’ যে হুমকি ট্রাম্প দিয়েছেন, তা উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন শান্তভাবে গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছেন ‘এই উক্তি উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।’ তিনি ট্রাম্পকে বলেছেন মানসিক বিকারগ্রস্ত লোক। গত মঙ্গলবার লন্ডনের কাগজগুলো খবর দিয়েছে, আমেরিকা যে কোনো সময় উত্তর কোরিয়ার ওপর হামলা চালাতে পারে এ আশঙ্কায় পিয়ং ইয়ং তার দেশরক্ষার শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি সংবাদ সংস্থা খবর দিয়েছে তাদের পূর্ব উপকূলে উত্তর কোরিয়া বিমান সমাবেশ বাড়াচ্ছে।
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ট্রাম্পের হুমকি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল এই অভিযোগটি আমেরিকা মেনে নেয়নি। কিন্তু মার্কিন বোমারুবিমান ফাইটার জেটের পাহারায় উত্তর কোরিয়ার পূর্ব আকাশ সীমানা দিয়ে উড়ে গিয়ে তাদের শক্তির মহড়া দিয়েছে। লন্ডনের একটি সান্ধ্য দৈনিকে মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) এক খবরে বলা হয়েছে, আমেরিকার হুংকারের জবাবে উত্তর কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিং ইয়ং হো বলেছেন, ‘এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। আমেরিকার বোমারুবিমান আমাদের দেশের আকাশ-সীমায় না ঢুকলেও তাকে গুলি করে নামানো হতে পারে।’
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গোটা বিশ্বের স্মরণ রাখা উচিত, আমেরিকাই প্রথম আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। প্রশ্ন হল, এ যুদ্ধে কে টিকে থাকবে, তখন তা দেখা যাবে।’ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এই বাকযুদ্ধ যে কোনো সময় প্রকাশ্যে ও প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে আমেরিকা মানবতাবোধের কোনো তোয়াক্কা না করে জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় পরমাণু হামলা চালিয়েছিল। তখন জাপানের হাতে আণবিক বোমা ছিল না। কিন্তু এবার উত্তর কোরিয়ার হাতে আছে পরমাণু-অস্ত্র। সুতরাং এবারের যুদ্ধটা একতরফা হবে না। ট্রাম্প ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসার লাভক্ষতি খতিয়ে দেখেন। মুখে যতই লম্ফঝম্প করুন, যুদ্ধের লাভক্ষতিটাও তিনি খতিয়ে দেখবেন।
তথাপি এ কথা সত্য, উত্তর কোরিয়ার হাতে যদি পরমাণু অস্ত্র না থাকত, তাহলে ট্রাম্প সাহেব এতদিনে তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ট্রু–ম্যানের মতো দেশটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সেটা না পেরে দীর্ঘ সময় ধরে বাকযুদ্ধ চালাচ্ছেন। তবে এই বাকযুদ্ধ থেকেও যে কোনা পক্ষের ভুলে আসল যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের নিযুক্ত নয়াচীনের রাষ্ট্রদূত। তিনি উভয় পক্ষকে শান্ত হওয়ার ও আলোচনায় বসে সমস্যাটির সমাধান করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অধিকাংশ বিশ্বনেতা, এমনকি জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল পর্যন্ত বলেছেন, ‘সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধান দরকার।’ যে দক্ষিণ কোরিয়াকে রক্ষা করার নামে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এত হাঁকডাক, সেই দক্ষিণ কোরিয়াও এই যুদ্ধ চায় না। তারা উভয় পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কারণ, যুদ্ধ যদি বাধে, তাহলে তার প্রথম বলি হবে দক্ষিণ কোরিয়া।
তার ভয়, যে কোনো সময় ‘অ্যাক্সিডেন্টাল মিলিটারি ক্ল্যাশ’ হতে পারে। তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। দক্ষিণ কোরিয়া বিধ্বস্ত হবে।
এটা স্পষ্ট, ট্রাম্প এডমিনিস্ট্রেশন উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করতে চায়। সে জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ তাদের কাছে একটি অপশন। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া জানে, তাদের হাতে পরমাণু অস্ত্র না থাকলে এতদিনে দেশটি আমেরিকার অর্থনৈতিক অবরোধ ও সামরিক চাপের মুখে টিকে থাকতে পারত না। এ জন্যই আমেরিকা দক্ষিণ কোরিয়ায় শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে রেখেছে। যে ঘাঁটির বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার মানুষের মনেও দিন দিন ক্ষোভ ও অসন্তোষ জমা হচ্ছে। তারা জানে, এই মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তাদের রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়নি। তৈরি করা হয়েছে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শাসন উৎখাতের জন্য।
কোরিয়ার বিরুদ্ধে আমেরিকা চল্লিশের দশকে একবার যুদ্ধে নেমেছিল। জয়ী হতে পারেনি। পানসুনজন চুক্তি করে যুদ্ধবিরতি ঘটাতে বাধ্য হয়েছিল। সেই পরাজয়ের বেদনা এবং উত্তর কোরিয়াকে শায়েস্তা করার ইচ্ছা ওয়াশিংটনের মন থেকে মুছে যায়নি। এ কথা জেনেই উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হওয়ার চেষ্টা করতে হয়েছে এবং সেই অস্ত্রকে ক্রমাগত শক্তিশালী করার (অন্তত মার্কিন হামলার মোকাবিলা করার মতো) নীতি অনুসরণ করতে হচ্ছে। কিম জং উন যদি এ কাজটি না করেন, তাহলে তাকে যে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও লিবিয়ার গাদ্দাফির পরিণতি বরণ করতে হবে এ কথা তিনি জানেন এবং প্রকাশ্যে বলেছেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই লম্ফঝম্প করুন, তার প্রশাসন জানে, এককালের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো মার্কিন সাম্রাজ্যের সূর্যও এখন অস্তাচলগামী। বিশ্বে একক সুপার পাওয়ার হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকার পরমাণু অস্ত্রের নখর-দন্ত এখন ভোঁতা হয়ে আসছে। এখন নখর-দন্ত থাকা সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের কোনো যুদ্ধেই আমেরিকা জয়ী হতে পারছে না। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ যুদ্ধের সময় তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এন্থনি ইডেন হুংকার ছেড়ে বলেছিলেন, ‘মিসরে নাসেরের রাজত্ব করার দিন শেষ হয়ে গেছে।’ এই যুদ্ধে ত্রিশক্তি (ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরাইল) জয়ী হয়নি। প্রেসিডেন্ট নাসের ক্ষমতায় রয়ে গেছেন। এন্থনি ইডেনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয়েছে। তার রাজনৈতিক জীবনও শেষ হয়ে গেছে।
১৯৫৬ সালের সুয়েজ যুদ্ধই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। প্রথম কোরিয়া যুদ্ধে আনবিক বোমা ব্যবহারের হুমকি দিয়েও আমেরিকা জয়ী হয়নি। এখন দ্বিতীয়বার আরেকটি কোরিয়া-যুদ্ধ শুরু করে ট্রাম্প জয়ী হবেন কি? হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা আছে। কিন্তু সমস্যার সামরিক সমাধানের কোনো সহজ সমাধান নেই। সুনির্দিষ্ট হামলা অথবা সামরিক অবরোধ দ্বারাও সমস্যার সমাধান হবে না।’
এই উপলব্ধি থেকে যদি যুদ্ধ বাধানোর হঠকারিতা থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিরত থাকেন, তাহলে আমেরিকাসহ উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া বাঁচবে। সারা বিশ্ব বাঁচবে। উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা থেকে বিরত রাখতে হলে তাকে আমেরিকার এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, উত্তর কোরিয়ায় ইরাকের মতো রেজিম চেঞ্জের জন্য হামলা চালানোর কোনো অভিসন্ধি আমেরিকার নেই। তার প্রমাণ দেয়ার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি সম্প্রসারণ এবং দেশটির সঙ্গে যৌথ সামরিক মহড়ার নামে উত্তর কোরিয়ার আশপাশে উসকানিমূলক সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে উত্তর কোরিয়াকে অবিরত হুমকির মুখে রাখা হবে, আর উত্তর কোরিয়া আত্মরক্ষার কোনো পদক্ষেপ নেবে না, এটা তো হয় না।
আমেরিকা চেয়েছিল, পরমাণু অস্ত্রের ওপর তার মনোপলি প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ বিশ্বে তার একক আধিপত্য। তা হয়নি। ভারত, চীন, পাকিস্তান এখন আনবিক অস্ত্রের অধিকারী। আমেরিকা তা হতে দিতে চায়নি। নানা বাধা সৃষ্টি করেছে। তাতে সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত দেশগুলোকে তাদের পরমাণু ক্লাবের সদস্য করে নিয়ে একটা নিয়ন্ত্রণ-বলয়ের মধ্যে আনতে হয়েছে। উত্তর কোরিয়াকেও এই পরমাণু ক্লাবের সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে তাকেও এই বোমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের আওতায় আনা যায়। আর পরমাণু অস্ত্রের বিস্তার রোধ করতে চাইলে আমেরিকার উচিত বিশ্বের কয়েকশ’ মনীষীর আবেদনে সাড়া দিয়ে নিজেদের মজুদ পরমাণু অস্ত্র ধ্বংস করে দিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে অন্য দেশগুলোকেও এই অস্ত্রের পরীক্ষা চালানো থেকে বিরত হতে বাধ্য করা। বিশ্বকে মারণাস্ত্র মুক্ত করা। মানবসভ্যতাকে নিরাপত্তা দেয়া। কিন্তু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এবং তাদের নেতা আমেরিকা কি তাতে রাজি হবে?
বর্তমান বিশ্বে ছোট-বড় কোনো সমস্যারই যে সামরিক সমাধান নেই, তার প্রমাণ আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধ। এখন তো প্রতিদ্বন্দ্বী সুপার পাওয়ার হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। তাহলে একক পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকা কোনো যুদ্ধেই জয়ী হতে কেন পারছে না? কেবল একটার পর একটা কিলিং ফিল্ড তৈরি করে চলেছে। এই কিলিং ফিল্ডের সীমানা একদিন আমেরিকা পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। আমার তো ভয় হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক বাকসর্বস্ব প্রেসিডেন্ট আমেরিকাকে যে পথে নিয়ে যাচ্ছেন তা কল্যাণের পথ নয়। ব্রিটেনের এন্থনি ইডেনের হুমকির মতো তার হুমকিও বুমেরাং হতে পারে। খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড়ের প্রতিযোগিতায় কচ্ছপের জয়ী হওয়ার মতো কিম জং উনের সঙ্গে বাকযুদ্ধ বা অন্য কোনো যুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হতে পারছেন না।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন