বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হওয়া সত্ত্বেও বহুকাল বহির্বিশ্বে ছিল উপেক্ষিত ও অনালোচিত দেশ। বাংলাদেশের কথা উঠলেই ‘বটমলেস বাস্কেটের’ তুলনা টানা হতো। হাসিনা সরকার দেশের এই দুর্নামটি শুধু দূর করেননি, তার অর্থনীতির উন্নয়নের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে সমালোচক দেশগুলোরও প্রশংসা অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাংকও এখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করে। বাংলাদেশ এখন বহির্বিশ্বে একটি আলোচিত দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এ দেশটির গুরুত্ব এখন স্বীকৃত।
হাসিনা সরকারের এ সাফল্যের কথা দেশের বিএনপি-জামায়াত ও একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ স্বীকার করতে চাইবে না, তা সবার জানা। যে শেখ হাসিনার পিতাকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হয়েছে এবং যে শেখ হাসিনাকেও হত্যা করার জন্য গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ হামলা চালানো হয়েছে, তিনি সব শত্রু ও সমালোচকের মুখে ছাই দিয়ে তিন তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে রয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবেন, এটা কি তাদের সহ্য হয়! তারা পাগলা মেহের আলীর মতো চিৎকার জুড়েছেন- ‘সব ঝুট হ্যায়’।
কিন্তু বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি সম্পর্কে সব তথ্য ঝুট নয়, মিথ্যাও নয়। তা অতি বাস্তব। যদি বাংলাদেশের এ উন্নয়নের যাত্রা অব্যাহত থাকে, তাহলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশগুলোর মতো উচ্চ আয়ের দেশ হবে তাতে সন্দেহ নেই। শিল্প, শিক্ষা, কৃষি, ক্রীড়া ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি ঘটছে। চিরকালের খাদ্য-ঘাটতির দেশটিকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে রূপান্তর করা হয়েছিল। সম্প্রতি বন্যা, খরা এবং বৈশ্বিক নানা কারণে খাদ্য উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছে। চাল, পেঁয়াজ ইত্যাদির দাম হঠাৎ প্রচুর বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ সংকট সাময়িক। সরকার এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে পারবে। রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাটিকে একটু শ্লথ করে দিয়েছে সত্য।
রোহিঙ্গা সমস্যা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর সহসা গুরুতর চাপ সৃষ্টি করলেও সরকার তা সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করছে। অতীতে বিডিআর বিদ্রোহ ও পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সৃষ্ট সংকটের সময়েও শেখ হাসিনা সাহস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে তার মোকাবেলা করেছেন। এজন্যই দেশের মানুষের একটা বড় অংশের ধারণা, আগামী নির্বাচনে জিতে যদি শেখ হাসিনা আরও একদফা ক্ষমতায় থাকেন, উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকে, গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্থিতাবস্থা বজায় থাকে, তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যারও একটা শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক সমাধান তার সরকারই করতে পারবে। অন্য কোনো সরকারের দ্বারা তা সম্ভব নয়। এটা আমাদের অতীত থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা।
হাসিনা-সরকার দেশকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসমুক্ত করেছে। মৌলবাদী হিংস্রতা দমন করেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একইসঙ্গে ভারত, চীন, আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক স্থাপন করেছে। বিশ্বরাজনীতিতে বাংলাদেশ তার একটি সম্মানজনক স্থান করে নিয়েছে। অতীতের কোনো সরকার- বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত সরকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো সুনামই অর্জন করতে পারেনি। এখনও বিএনপির রাজনীতির বড় মূলধন মিথ্যাচার বা বাগাড়ম্বর। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও আরেক নেতা রিজভী রোজ সংবাদপত্রে বাক্যবাণ ছড়িয়ে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। দেশের সুধী সমাজের উচিত দু’জনকেই ‘তর্করত্ন’ উপাধি দেয়া।
আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যের বয়ান দিলে তা দীর্ঘ হবে। তাই বলে এ সরকারের কোনো ব্যর্থতা ও অসফলতা নেই তা বলব না। দেশের সব ধরনের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শত্রু দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার। একশ্রেণীর নব্যধনী দেশের শিল্প, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাংবাদিকতাতেও অশুভ প্রভাব বিস্তার করেছে। বড় দুটি রাজনৈতিক দলও তাদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত নয়। দেশের অধিকাংশ মসজিদ, মাদ্রাসা এখনও হিংস্র মৌলবাদী দলগুলোর কব্জায়। তাদের প্রভাবে সমাজে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশের মনমানসিকতা ধর্মান্ধতা দ্বারা আচ্ছন্ন হচ্ছে। এটা ঠেকাতে না পারলে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোথায়?
দুর্নীতি দমন, সাম্প্রদায়িকতার মূলোচ্ছেদ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় হাসিনা-সরকার তাদের সব আন্তরিকতা সত্ত্বেও সফল হয়নি। শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের ফসল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রাণপাত করছেন; কিন্তু সেই ফসল মাঝপথে লুটে নিচ্ছে তার দলেরই একশ্রেণীর লুটেরা মন্ত্রী, এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ ব্যাপক। আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহজ বিজয় অর্জনের কথা। যদি না পারে তাহলে বুঝতে হবে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্ষেত্রবিশেষে গণবিরোধী নীতি জনগণকে শেখ হাসিনার প্রতি বিপুল আস্থা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রতি বিমুখ করেছে। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় অস্বাভাবিক নয়। লক্ষাধিক ভোটে হারাটাই অস্বাভাবিক।
বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ঔপনিবেশিক আমলের আমলা-শাসনের বদলে নির্বাচিত জেলা গভর্নর দ্বারা দেশ পরিচালনার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। তাকে হত্যা করার পর সেনাপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলপূর্বক এ আমলা-শাসন ফিরিয়ে আনেন। ক্ষমতা আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। দেশে সামরিক শাসনের অবসান হয়েছে; কিন্তু ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভূত হওয়ার ব্যবস্থাটির পরিবর্তন হয়নি। দেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়নও রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্র ঢাকার অনুমোদন ছাড়া হয় না। আর এই অনুমোদন-বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট আমলা-কর্তারা কতটা আর্থিকভাবে লাভবান হন, সে কাহিনী এখানে কহতব্য নয়।
সম্প্রতি একটি গল্প শুনেছি আওয়ামী লীগের সিলেটবাসী এক নেতৃস্থানীয় বন্ধুর মুখে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটের এখন অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। কিন্তু উন্নতি হলে কী হবে, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে তৈরি এ রাস্তাঘাটগুলোর কোনো মেইনটেন্যান্স নেই। বছর না যেতেই এ রাস্তাগুলোয় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। তা মেরামতের ব্যবস্থা নেই। আমার বন্ধু সিলেটে তার এলাকায় গিয়ে রাস্তাঘাটের শোচনীয় অবস্থা দেখে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বললেন, সরকার আপনাদের তো প্রচুর টাকা দিচ্ছে। তাহলে রাস্তাঘাটের মেরামত করছেন না কেন? ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তা জবাব দিয়েছেন, আমাদের তহবিলে টাকার অভাব নেই। কিন্তু চিফ ইঞ্জিনিয়ারের অনুমোদন ছাড়া কিছু করার উপায় নেই। আমার বন্ধু চিফ ইঞ্জিনিয়ারের শরণাপন্ন হলেন। চিফ ইঞ্জিনিয়ার বললেন, রাস্তা মেরামতের জন্য টাকার অভাব নেই। হাসিনা সরকারের আমলের বৈশিষ্ট্য এই যে, কোনো উন্নয়ন কাজের জন্যই টাকার অভাব হয় না। কিন্তু সমস্যা অনুমোদনের। এই রাস্তা মেরামতের জন্য ঢাকা থেকে অনুমোদন আনতে হবে। আর এই অনুমোদনের জন্য কত মন্ত্রণালয়ে ঘুরতে হবে তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আর এ ঘোরাঘুরির পেছনে থাকে সর্বত্র নগদ নারায়ণের খেলা। ফলে সব কাজই লালফিতার মধ্যে আটকে যায়।
এই একই গল্প বাংলাদেশে সর্বত্র শুনেছি। রাস্তা সংস্কার, নদী সংস্কার, প্রাইমারি স্কুল সংস্কার, সেতু সংস্কারসহ সর্বক্ষেত্রে এটা ঘটে প্রশাসনিক ক্ষমতা অতিরিক্ত কেন্দ্রীভূত বলে। আর যদি সেই ক্ষমতা আমলাদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে ক্ষমতার সর্বোচ্চ চূড়ায় আটকে যায়, তাহলে গণতন্ত্রের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি গণ-উন্নয়নেরও। পাকিস্তানি আমলে আইয়ুবের শাসনের সময় উন্নয়ন-দশক পালিত হয়েছিল। বিপুল টাকা ব্যয় করা হয়েছিল উন্নয়ন কাজে। তা জনগণের জীবন স্পর্শ করেনি। সব টাকা গিয়েছিল মৌলিক গণতন্ত্রী নামক একদল তথাকথিত জনপ্রতিনিধি এবং তাদের আমলা-প্রভু সিও ডেভ্দের (Circle officer development) পেটে।
হাসিনা-সরকারের আমলে তা হয়নি। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় এবং আমলাদের হাতে ও রাজধানীতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকায় বিরাট অর্থ ব্যয়ে উন্নয়নের কাজ হলেও সেই উন্নয়নকে ধরে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। সেই উন্নয়নের সঙ্গে জনমানুষের সম্পৃক্ততা কম। দুর্নীতির ঘোড়া উন্নয়নের সব ঘাস খেয়ে ফেলে। বঙ্গবন্ধু তাই ব্রিটিশ ও পাকস্তানি আমলের পুরনো ও গণবিরোধী আমলাতান্ত্রিক শাসনের কাঠামো ভাঙতে চেয়েছিলেন। তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ চেয়েছিলেন। তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করা হয়।
দেশ শাসন ও গণতান্ত্রিক শাসন-কাঠামো পুনরুদ্ধারে শেখ হাসিনার সাফল্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তার তিন দফার শাসনামলেও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। বরং তা আরও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। আমলাতন্ত্রের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়েনি। কিন্তু তার দাপট অব্যাহত রয়েছে। অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষকও তাই বলেছেন, বাংলাদেশের বিপুল অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে; কিন্তু তা যে তৃণমূল পর্যায়ে জনগণকে প্রণোদিত ও সেই কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারছে না, তার মূল কারণ ব্যাপক দুর্নীতি এবং আরও দুর্ভাগ্যের কথা এই দুর্নীতি প্রশাসনের সর্বত্র বিরাজ করছে।
আমার ধারণা, দেশ শাসনে হাসিনা-সরকারের সাফল্য বিশাল। কিন্তু অসাফল্য দুর্নীতি দমনে এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে ব্যর্থতায়। নইলে সন্ত্রাস দমন থেকে শুরু করে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় হাসিনা-সরকারের সাফল্যের কোনো তুলনা নেই। কিন্তু ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায়, জনগণকে উন্নয়নের প্রতিটি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে না পারায় সাধারণ মানুষ এত উন্নয়ন সত্ত্বেও তৃপ্ত নয়, আওয়ামী লীগকে তাই নির্বাচনে জেতা সম্পর্কে ভাবতে হবে।
আওয়ামী লীগের শাসন অবশ্যই জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসন। কিন্তু এ জনপ্রতিনিধিদের একটা বড় অংশ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে তারা বিশ্বাসী নন। এমপি ক্ষমতা ছাড়তে চান না উপজেলা চেয়ারম্যানের হাতে। উপজেলা চেয়ারম্যান চান না ইউনিয়ন পরিষদ শক্তিশালী হোক। সবাই ক্ষমতা ধরে রাখতে চান; কিন্তু প্রকৃত ক্ষমতা ভোগ করতে পারে না কেউ। ক্ষমতার নাটাই থাকে আমলাদের হাতে। এ জন্যই এক ব্রিটিশ সাংবাদিক বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘In Bangladesh democracy politicians are in office, not in power’- বাংলাদেশের গণতন্ত্রে রাজনীতিকরা দফতরে বসেন, কিন্তু ক্ষমতা তাদের হাতে নেই।
আওয়ামী লীগকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। দুর্নীতির উচ্ছেদ এবং সেই লক্ষ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে অবশ্যই। দুর্নীতি এবং গণবিরোধী প্রশাসনের ঘাঁটি ভাঙতে হলে আওয়ামী লীগ সরকারকে দল সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন সংস্কারেও হাত দিতে হবে। সন্ত্রাসের মতো দুর্নীতির মহাদানবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দ্বারা জনগণকে উন্নয়নের প্রতিটি কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আমার ধারণা, এ কাজটি একমাত্র শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষেই করা সম্ভব। আর কারও দ্বারা নয়।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন