|
সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম
mgsmibrahim@gmail.com |
|
রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রয়োজন জাতীয় সংহতি
05 October 2017, Thursday
কোনো একটি জনগোষ্ঠী যদি অনুভব করে অন্য একটি জনগোষ্ঠী তাদের বঞ্চিত, নিপীড়িত ও অপমানিত করছে, তাহলে একসময় সেই জনগোষ্ঠী প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়। প্রতিবাদের ভাষা ও মাধ্যম স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ফিলিপাইনের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত মিন্দানাও প্রদেশ, ভারতশাসিত কাশ্মীর রাজ্য, ভারতের আসাম প্রদেশ বা নাগাল্যান্ড প্রদেশ, রাশিয়ার অন্তর্গত চেচনিয়া এবং শ্রীলংকার উত্তর-পশ্চিম অংশের তামিল জনগোষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের নিপীড়নের প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিবাদের ভাষা ও প্রতিবাদের ধরনের কথাও বলা যায়।
পাঠক অনুগ্রহ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গটি উপরের উদাহরণগুলোর আলোকে বিবেচনা করুন। রোহিঙ্গারা কিন্তু এখনও প্রতিবাদ শুরু করেনি। তাদের প্রতিবাদের ভাষা কী হতে পারে সেটা আমরা জানি না। তাদের হয়ে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের আরও বহু দেশ প্রতিবাদ করছে। মিয়ানমারে অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আছে; তার মধ্যে রোহিঙ্গা একটি। অপ্রিয় হলেও সত্য, অন্যসব ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ধর্মীয় পরিচয়ে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হলেও একমাত্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় হল মুসলমান। ১৯৬২ সাল থেকে বার্মার কেন্দ্রীয় সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নিপীড়ন ও বঞ্চনামূলক আচরণ করে আসছে। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের হীন স্বার্থে সুদূর পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশটিকে মুসলমানমুক্ত করতে চায়। রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বই প্রদান করা হয় না। তাদের লেখাপড়া করতে ও ভালো কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে দেয়া হয় না। ফলস্বরূপ তারা একটি অনগ্রসর জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যেই চলে অত্যাচার। কোনো সময় এ আচরণ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। যখন বেশি ভয়ঙ্কর হয়, তখন রোহিঙ্গা জনগণ জীবন বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। অবস্থার উন্নতি হলে কিছু রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যায়, কিছু বাংলাদেশেই থেকে যায়। এভাবে গত ৩০-৪০ বছরে বেশ কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশেই রয়ে গেছে। রাখাইন প্রদেশ থেকে সরাসরি অথবা বাংলাদেশ হয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরবে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। অন্যদিকে গত ৪-৫ বছর ধরে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন বাড়তে বাড়তে ২০১৬-১৭ সালে এসে তা চরম আকার ধারণ করেছে। তারা গণহত্যার শিকার হচ্ছে। ফলস্বরূপ, বন্যার পানির মতো রোহিঙ্গা স্রোত বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মাটিতে এখন অতীতের রোহিঙ্গা এবং সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা মিলে এদের সংখ্যা কমপক্ষে আট লাখ।
১৯৮০-র দশকে এবং এর কিছু পরে রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে দু’-একটি চরমপন্থী সশস্ত্র সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। ২০১৩ সালে এরকম একটি সংস্থা জন্ম নেয় মিয়ানমারের মাটিতে। নাম ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’ (আরসা)। এ ধরনের সংস্থাগুলোর জন্মের প্রধান কারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনায় দেশটির সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত চরম নির্যাতন ও পোড়ামাটি নীতি। শুধু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নয়, বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রতিবাদী সংগঠন রয়েছে। প্রতিশোধের ধরন হচ্ছে, (মিয়ানমার) সেনাবাহিনী, পুলিশের থানা বা চেকপোস্ট, পুলিশের গাড়িবহর বা টহল দল ইত্যাদির ওপর আক্রমণ করা। অভিযোগ উঠেছে, আরসা গত বছর অক্টোবরে প্রথম কাজ শুরু করে এবং কিছুদিন আগে, আগস্ট মাসের ২৫ তারিখে, বড় আকারে গেরিলা কর্মকাণ্ড শুরু করে। আমি এ অভিযোগটি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু এই অভিযোগ তুলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশ রোহিঙ্গা জনগণের গ্রামে গ্রামে নৃশংস আক্রমণ চালায়। অতএব, সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচানোর জন্য সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হয়।
অতীতেও যেমন ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারের কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। আলাপ-আলোচনার পর নিয়মতান্ত্রিকভাবেই তাদের অনেককে ফেরত দেয়া সম্ভব হয়েছে। ওই সময়ের সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ ইতিবাচক ফল দিয়েছে। কিন্তু এবারের সমস্যাটির বহুমাত্রিক, জটিলও বটে। এ মুহূর্তে চলছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার জন্য জনগণের তৎপরতা। এরূপ তৎপরতা চলছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। গত ৯ সেপ্টেম্বর এই লেখকও চট্টগ্রাম মহানগরে এরূপ দুটি সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছে। উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ তৎপরতায় শরিক হওয়া, অন্যদের সচেতন করা ও শরিক করা।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রশংসা যেমন আছে, তেমনি সমালোচনাও আছে। তবে সমালোচনা ছাপিয়ে সার্বিকভাবে রোহিঙ্গাদের প্রতি বাংলাদেশের গণমানুষের চেতনা ও সহমর্মিতা চোখে পড়ার মতো। তবে রোহিঙ্গাদের প্রতি আমাদের আচরণের একটি সমন্বিত রূপ দেয়া দরকার। এটাকে আমরা বলতে পারি জাতীয় সংহতি তথা ইংরেজি পরিভাষায় ন্যাশনাল সলিডারিটি ফর দ্য রোহিঙ্গা। অর্র্থাৎ বাংলাদেশের ভেতরে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতীয় সংহতি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কিছু আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় উপস্থাপন করছি : ১. বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের কক্সবাজার জেলা পূর্ণভাবে এবং বান্দরবান জেলা ও চট্টগ্রাম জেলা আংশিকভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সৃষ্ট বিপর্যয়ে আক্রান্ত। এই জেলাগুলোর প্রশাসনিক ভৌত কাঠামো এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক সক্ষমতা এই বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। অতএব বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে সার্বিকভাবে সহায়তা একান্তই প্রয়োজন। সরকার সহযোগিতা দিচ্ছে, জনগণ উদার হৃদয়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু এই উদারতা কতদিন টিকবে এবং বাংলাদেশ কতদিন এটা সহ্য করতে পারবে? ২. বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বিভাজিত। এর কারণ ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। সেই সঙ্গে দেশের জনগণের জানমালের নিরাপত্তার অভাব, গুম-অপহরণ আতঙ্ক, সরকারের দুর্বল নৈতিক ভিত্তি ইত্যাদি কারণে স্বৈরাচারী মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা প্রশ্নে কিছু করছে কিনা, অথবা বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এই দুর্বলতাকে আমলে নিয়ে কিছু করছে কিনা, সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। তবে তারা করতেও পারে, নাও করতে পারে। ৩. একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের প্রথাগত নিরাপত্তা (ট্রাডিশনাল সিকিউরিটি অফ দ্য টেরিটরি অফ এ সভেরেইন স্টেট) সমগ্র জাতির মনোবল ও আবেগের সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমার বাংলাদেশের আকাশসীমা লংঘন করেছে এমন অভিযোগ দেশবাসীকে মর্মাহত করছে। তবে মিয়ানমার কর্তৃক সীমান্ত ও আন্তর্জাতিক সৌজন্য লংঘনের প্রত্যুত্তর কী হতে পারে, সেটি আলোচনার বিষয়। খোলামেলা না হলেও উপযুক্ত ফোরামে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
এখন ভূ-রাজনৈতিক বা ভূ-কৌশলগত বিষয়ে আলোচনা করব। ১. উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যের কোনো কোনোটিতে ইনসার্জেন্সি এবং কাউন্টার ইনসার্জেন্সি পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল ও আছে। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম অংশসহ বিভিন্ন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর (এথনিক মাইনরিটি) আবাসভূমিতে ইনসার্জেন্সি এবং কাউন্টার ইনসার্জেন্সি পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল এবং আছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও একসময় এরূপ পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে এরূপ পরিস্থিতি অতীতে ছিল, মাঝখানে ম্রিয়মাণ হয়েছিল, পুনরায় সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যায়ে সচেতন পাঠক প্রথমে কল্পনা করুন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের মানচিত্র। অতঃপর কল্পনা করুন বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পূর্ব সীমান্তে ভারত ও মিয়ানমারের ভূখণ্ডগুলোতে কোন ধরনের জনগোষ্ঠী থাকে এবং তাদের কর্মকাণ্ড কী। আরও কল্পনা করুন মুসলমানবিহীন রাখাইন প্রদেশ এবং বাঙালিবিহীন পার্বত্য চট্টগ্রাম। অতঃপর অংক করুন পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্বত্য ভূমিকে অসৎ উদ্দেশ্যে কারা কারা ব্যবহার করতে পারে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ভবিষ্যৎ কী হতে পারে। ২. বর্তমান বিশ্ব সন্ত্রাস, চরমপন্থা, মাদক পাচার, অবৈধ পন্থায় অস্ত্র ব্যবসা, অস্ত্র পাচার ইত্যাদি ব্যাধিতে আক্রান্ত। উপদ্রুত ভৌগোলিক এলাকার সঙ্গে যদি বিক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ ঘটে, তাহলে উপরোক্ত ব্যাধিগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই ব্যাধিগুলোর প্রভাবে বিস্তীর্ণ এলাকা এবং অনেক জনপদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতএব আরাকান বা রাখাইন যদি উপদ্রুত হয়, তাহলে তার প্রতিবেশীর ভৌগোলিক এলাকাগুলোও উপদ্রুত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এবার উপসংহার টানছি। ‘দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’-এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে, বাংলাদেশের মানুষকে সচেতন করে জাতীয় সংহতি গড়ে তুলতে হবে। বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা, আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে পরিবেশ ও পরিস্থিতি সৃষ্টি করা একান্তই প্রয়োজন। জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করা যাবে কী যাবে না সেটা আলোচনার বিষয় হতে পারে। তবে আহ্বান জানাতে, চেষ্টা করতে দোষ নেই।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন