আজকের কলামটি একটু ব্যতিক্রমী। পারিবারিক ঘটনার মাধ্যমে সমাজচিত্র ফুটিয়ে তোলার কঠিন প্রচেষ্টা। ১৯৬৮ সালের শেষে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম তখনকার কথা। ভর্তি হয়ে বাড়িতে গিয়েছি সব কিছু নিয়ে প্রস্তুত হয়ে হলে থাকার জন্য চলে আসব, এমন সময় আমার বাবা চার-পাঁচ মিনিটের মতো সময় ব্যয় করেছিলেন সিরিয়াস আলাপে; একটি উপদেশ দিতে। আমি তখন ১৯ বছরের কৈশোর উত্তীর্ণ একজন তরুণ মাত্র। তিনি যা বলেছিলেন তা অনেকটা এ রকম : ‘তোমাকে ক্যাডেট কলেজে লেখাপড়া করিয়েছি অনেক আগ্রহ নিয়ে; এখন তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে তোমার খরচ তোমার স্কলারশিপের টাকা থেকেই সঙ্কুলান হবে। তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি যে, তুমি যেই পথে আগাচ্ছ, ইনশাআল্লাহ বড় হবে। তবে মনে রাখবে, কোনো একটা পরিবারে শুধু একজন বড় হলেই হয় না, সব ভাইবোনকে বড় হতে হয়; এটা খেয়াল রাখবে।’ বস্তুতই আমার জন্য আমার বাবা এবং পুরো পরিবার সেক্রিফাইস করেছিল অনেক যেটা আমি তখন পূর্ণভাবে বুঝিনি, পরে বুঝেছি। সেই ১৯৬৮ সালে তখন আমরা ছিলাম সাতজন ভাইবোন এবং আমি ছিলাম জ্যেষ্ঠতম। বাবা চাকরি থেকে অবসর পেয়েছেন স্বাভাবিক নিয়মে ১৯৮৭ সালে। ইন্তেকাল করেছেন ২০১০ সালে। ইন্তেকালের বছর চারেক আগে তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত হন। তার বয়স বেশি ছিল বিধায় এলোপ্যাথিক চিকিৎসায় না গিয়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাই। বাবা চার বছর টিকেছিলেন; শেষের দিকে তিন থেকে চার মাস একটু কষ্ট বেশি পেয়েছিলেন। মাঝে মধ্যেই কথাটা বলতেন, কিন্তু মৃত্যুর আনুমানিক দুই-আড়াই বছর আগে গুরুত্বের সাথে ওই সিরিয়াস কথাটি শেষবারের মতো বলেছিলেন, যা বলেছিলেন সেটা অনেকটা এ রকম : ‘হায়াত কয় দিন বাকি আছে জানি না। তুমি বড়। তোমাকে বলে রাখি, সব ভাই একসাথে মিলেমিশে থাকবে। বর্তমান জমানায় এটি কঠিন কাজ, তারপরও চেষ্টা করবে; তুমি বড় তোমাকে বললাম।’
অনেকে হয়তো বলতেও পারেন, মা কি কোনো উপদেশ দেননি? বাবা কি আর কোনো কথা বলেননি? বাবা আরো অনেক কথা বলেছেন, বিশেষ করে আমার অবসরের পর। বুড়িশ্চর গ্রামে আমরা যখন ছোট তখন এবং অতঃপর চট্টগ্রাম বন্দর উত্তর কলোনিতে আসার পর, আমার মায়ের হাতে পবিত্র কুরআন শিক্ষা করেছে এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। আমার মা আউলিয়াভক্ত এবং তার জীবনে আমাদের প্রতি সর্বাধিক উচ্চারিত উপদেশ বা পরামর্শ হচ্ছেÑ নামাজ পড়ো, কুরআন পড়ো, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করো এবং সর্বাবস্থায় আল্লাহর সাহায্য কামনা করবে। মায়ের বয়স এখন ৮০ আর ৯০-এর মাঝখানে। বাবার সাথে ইন্টারঅ্যাকশনের কোনো সীমাপরিধি থাকে না জ্যেষ্ঠ সন্তানের; কিন্তু একটি ঐতিহাসিক ইন্টারঅ্যাকশন হচ্ছেÑ ২০ মে ১৯৯৬ তারিখে যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসিম বীর বিক্রম এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব হতে সৃষ্ট সঙ্কটের কারণে দেশের অবস্থা উত্তাল; ঘটনাক্রমে সেই তারিখে এবং সেই রাতে আমার বাবা যশোর সেনানিবাসে আমার বাসায় ছিলেন। আমি তখন যশোরে অবস্থিত পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং যশোর অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার।
ভাই হারানোর বেদনা!
এই ২০১৭ সালে আমার বাবা-মায়ের জীবিত ছেলেমেয়ে ছিলাম আমরা পাঁচজন ভাই, চারজন বোন। মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায় প্রতিটি ভাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং প্রতিটি বোনও হয় গৃহিণী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত অথবা পেশাজীবী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। পাঁচ ভাই ছিল হাতের পাঁচটি আঙুলের মতো। গত বুধবার ১৫ নভেম্বর আমার তথা আমাদের কনিষ্ঠতম ভাই সৈয়দ সালাহউদ্দীন ৪৩-৪৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। হাতের পাঁচটি আঙুল থেকে একটি আঙুল কাটা পড়লে হাতটি যেমন দুর্বল হয়ে যায়, ঠিক তেমনি কনিষ্ঠতম ভাই মারা যাওয়ায় আমি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হয়ে গেলাম বলে অনুভব করি; হৃদয়ের ব্যথার কথা না-ই বা বললাম। সালাহউদ্দীনের সদ্য বিধবা প্রকৌশলী স্ত্রী এবং ১১ বছরের নিচে বয়স দু’টি শিশুসন্তানের কথাও না-ই বা বললাম।
ডাক্তারের দায়বদ্ধতা দেশের প্রতি
আমি বের হওয়ার ১২ বছর পর আমার আরো একটি ভাই একই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ভালো রেজাল্ট করে বের হয়। সেই ভাই এখন একজন নিওরো সার্জন; জাপান থেকে পিএইচডি করেছেন এবং আমেরিকা থেকে অ্যাডভান্সড ট্রেনিং করেছেন তিন বছর। জাপান ও আমেরিকায় উভয় ক্ষেত্রেই অফার পেয়েছিলেন সেখানে অধ্যাপনায় ও চিকিৎসায় যুক্ত হতে। দেশের মানুষের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কথা চিন্তা করেই ডাক্তার ভাই বলেছিলেন, আমার প্রথম দায়িত্ব দেশে ফিরে যাওয়া, বাবা-মায়ের খেদমতে থাকা এবং দেশের মানুষের চিকিৎসা-খেদমতে নিবিষ্ট হওয়া। বাবা না থাকলেও ভাই এখনো সেই খেদমত করে যাচ্ছেন দেশের মানুষের প্রতি। আমি একজন সরকারবিরোধী অঙ্গনের রাজনৈতিক কর্মী এবং আমার ভাই হওয়ার কারণে তার ওপর যে অবিচার ও নিগ্রহ চলছে তার বর্ণনাও এখন দেবো না। দ্বিতীয় ভাইটি সেনাবাহিনীতে চাকরিরত একজন জ্যেষ্ঠ মেজর। পঞ্চম ও কনিষ্ঠতম ভাই সদ্য মরহুম; নাম সৈয়দ সালাহউদ্দীন। ঘরের মধ্যে আদর করে আমরা এবং ঘরের বাইরে বন্ধুরা ডাকতাম ‘নাজিম’ বলে। বুয়েট থেকে ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (ট্রিপল ই) পাস করল, প্রাইভেট সেক্টরে একটি আইটি কোম্পানিতে চাকরি করল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে ৩৩তম ব্যাচে এমবিএ করল; অতঃপর সাউথ ইস্ট ব্যাংকের সদর দফতরে সরাসরি যোগদান করল। এক যুগের বেশি চাকরি করে ২০১৭ সালের মার্চে অবসরে এলো বাধ্য হয়ে। ক্যান্সারের কারণে দৃষ্টিশক্তি চূড়ান্তভাবে লোপ পেয়েছিল ২০১৭ সালের মার্চে। অতএব বাধ্য হয়ে অবসরে এলো। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, তাদেরই অফিসার সৈয়দ সালাহউদ্দীনের প্রতি অত্যন্ত প্রীত ও সন্তুষ্ট ছিল; তার প্রতি দৃষ্টান্তমূলক মানবিক ও সহমর্মী আচরণ করেছে, যার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় বা ঢাকার বুয়েটের সুবাদে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়ার সুবাদে, সালাহউদ্দীনের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। আমার জানা মতে এবং পর্যবেক্ষণে কিশোর বয়স থেকেই নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছে। শিশুসন্তান নিয়ে হজ করে এসেছে। অন্তিম ঘণ্টাগুলোয় ল্যাবএইড হাসপাতালের আইসিইউর ভেতরে নিজ বিছানায় শুয়েও অস্থিরচিত্ত ছিল নামাজ নিয়ে। ১৫ নভেম্বর দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে সালাহউদ্দীন হাসপাতালের আইসিইউতে। অথচ শুক্রবার মাগরিবের আগে ও পরে সালাহউদ্দীন বনানীতে কুরআন শিক্ষার আসরে একজন ছাত্র ছিল; একা যেতে পারত না তাই স্ত্রী ও ছোট বোনকে নিয়ে যেত। নিজগুণে এবং নিজ কর্মদক্ষতায়ই সৈয়দ সালাহউদ্দীন তার সহকর্মীদের মন জয় করেছিল। সেটা গত কয়েক বছরে যথেষ্ট টের পেয়েছি। রক্তের প্রয়োজন হলে ব্যাংকের সহকর্মী ও বন্ধুরা অনেকেই ছুটে এসেছে। সালাহউদ্দীনের ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগিনা-ভাগিনীরা ছিল তার বন্ধুর মতো। তারাও তাদের বন্ধুপ্রতিম (মামা-চাচা) সালাহউদ্দীনের পাশে দাঁড়িয়েছে। সালাহউদ্দীন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জনে উৎসাহ দিত সর্বক্ষণ। আমি সালাহউদ্দীনের ব্যাংক কর্তৃপক্ষের প্রতি এবং সালাহউদ্দীনের সর্বস্তরের ও সব ব্যাকগ্রাউন্ডের বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
সম্প্রীতি সৃষ্টির মাধ্যম : নামাজে জানাজা
ঢাকা মহানগরের গ্রিন রোডের নর্থ রোডে (ভূতের গলি), বুধবার বাদ মাগরিব নামাজে জানাজার সময় টের পেয়েছি তার বন্ধুবান্ধবের সমবেদনা ও আমাদের পুরো পরিবারের আত্মীয় ও বন্ধুদের সমবেদনা। চট্টগ্রাম মহানগরের মুরাদপুরে ১৬ তারিখ সকালে দ্বিতীয় নামাজে জানাজার সময়ও দেখেছি তার শুভাকাক্সক্ষীকে এবং বন্ধুকে ব্যথিত হৃদয়ে অংশগ্রহণ করতে। গ্রামের বাড়ি বাদ জোহর নামাজে জানাজা হয়েছিল। সব অঙ্গন ও পেশার মানুষ, গ্রামের বাইরের মানুষ, আশপাশের সব ব্যাংকের প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তি ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরা নামাজে জানাজায় অংশ নিয়েছেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তো বটেই, ফটিকছড়ির সাবেক এমপি মাজহারুল হক শাহ বা বুড়িশ্চরের বর্তমান চেয়ারম্যান রফিকসহ বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা নামাজে জানাজায় এসেছিলেন। কল্যাণ পার্টির চট্টগ্রাম উত্তর জেলা, চট্টগ্রাম মহানগর ও হাটহাজারী উপজেলার নেতাকর্মীরা তো উপস্থিত ছিলেনই। অতীতেও অনুভব করেছি, এখনো অনুভব করি, নামাজে জানাজা মানুষের মিলনমেলা ও নামাজে জানাজা সম্প্রীতি সৃষ্টির সফল মাধ্যম।
ব্যাকরণ ও ভাইয়ের সম্পর্ক
আমার মরহুম দাদা-দাদী, মরহুম ভাই এবং আমার মরহুম বাবা ও চাচার নামে আমরা গ্রামে একটি অনিবন্ধিত ফাউন্ডেশনের আওতায় শিক্ষামূলক কর্ম পরিচালনা করি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে কোচিং করাই সপ্তাহে ছয় দিন ইংরেজি ও অঙ্ক বিষয়ে। এখন এই সদকামূলক কাজ যাদের রূহের মাগফিরাতের জন্য নিবেদিত, সেই ব্যক্তিদের তালিকায় যুক্ত হবে সৈয়দ সালাহউদ্দীনও। সৈয়দ সালাহউদ্দীনকে আমার বাবার কবরের দক্ষিণ পাশে এক কবর দূরত্বে দাফন করা হয়েছে। ওই কবরস্থানের বাসিন্দা এক দিকে ভাগ্যবান। জাতীয় ও বিদ্রোহী কবি প্রার্থনা করেছিলেন, মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, গোর থেকে আমি যেন মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই। মসজিদসংলগ্ন আমাদের মহল্লার কবরস্থানে আজানের শব্দ প্রতিনিয়ত পৌঁছায় এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর সেখানে কবর জিয়ারত হয়। আমরা পাঁচটি ভাই যেহেতু চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ব্যস্ত, তাই সব বিষয়ে শুভভাবে ও ইতিবাচকভাবে আন্তরিকতার সাথে পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখে দায়িত্ব পালনে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে আমার একমাত্র মরহুম চাচার সন্তানেরা। ঢাকায় সালাহউদ্দীনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরই আমাদের গ্রামের বাড়িতে সব ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করে আমার চাচাতো ভাইয়েরা। ব্যাকরণের কারণে বলতে হয় তাই চাচাতো ভাই বলি, অন্যথায় তারা সহোদর ভাই বটে। এটা সম্ভব হয়েছে আমার দাদা-দাদী এবং আমার বাবা ও তার একমাত্র ছোট ভাই কর্তৃক দেখানো শিক্ষার কারণে। ভাইদের ধন্যবাদ দেয়ার রেওয়াজ নেই। ভাইদের জন্য দোয়া করতে হয়। দোয়া করি।
ক্যান্সার প্রসঙ্গ
বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা জগতে অনেক উন্নতি হয়েছে। স্বাভাবিক কারণে বাংলাদেশ সব কিছুতেই উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। হয়তো ভবিষ্যতে পারবে। এককালে যক্ষ্মা ছিল ভীতিকর রোগ, এখন যক্ষ্মার নিরাময় অতি সাধারণ বিষয়। এখন বেশি আলোচিত ভীতিকর রোগ হচ্ছে ক্যান্সার। শত শত নাম এখানে উল্লেখ করা যাবে না। যেদিন আমার ভাই মারা যায়, সেদিন ভোরেই ক্যান্সারে মারা গিয়েছেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সুবাদে আমার ছোট ভাই বরেণ্য স্থপতি এবং চট্টগ্রামের বরেণ্য সংবাদপত্র পূর্বকোণ-এর সম্পাদক স্থপতি তসলিম উদ্দীন চৌধুরী। তার এক ছোট ভাইও ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সাবেক ছাত্র। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ দিন আগে ভারতে চিকিৎসারত অবস্থায় ক্যান্সারে মারা গিয়েছে চট্টগ্রামের মোহরার বিখ্যাত কাদেরি পরিবারের মেয়ে সদ্য পাস করা ডাক্তার আইনুন নাহার কাদেরি (সানজি)। পাকিস্তানের ক্রিকেটার ও রাজনীতিবিদ ইমরান খান, ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া তার মায়ের নামে স্থাপন করেছেন ‘শওকত আরা মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল’। হাজার হাজার বা লাখ লাখ মানুষ সহযোগিতা করেছে।
ক্যান্সার নিরোধে ইনভেস্টমেন্ট বৃদ্ধি করতে হবে
ক্যান্সার চিকিৎসায় আমাদের আরো অগ্রগতির প্রয়োজন আছে, আরো ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন আছে। ইনভেস্টমেন্ট অন্তত দুই প্রকার। একটি হলো হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা, হাসপাতালের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি আনা। আরেক প্রকার ইনভেস্টমেন্ট হলো হিউমেন রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট তথা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সৃষ্টি করা। অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি করার জন্য বিদেশে স্কলারশিপ দিয়ে চিকিৎসককে পাঠাতে হবে এবং প্রশিক্ষণের পর চিকিৎসক যেন বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসে তার জন্য দেশেই পরিবেশ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসক যেন মানবিক গুণসম্পন্ন ব্যক্তি হয়, সে কথাও খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশে আমরা, টেলিভিশনের পর্দায় হাসপাতালের বিজ্ঞাপন দেখি, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে বিদেশ থেকে চিকিৎসক কনসালটেশন দেয়ার জন্য আসছেন ওইরূপ বিজ্ঞাপন দেখি। নিরেট বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে এখনো জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক সংখ্যা কম। নিরেট বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে এখনো জটিল রোগীর তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কম। আমাদের দেশের চিকিৎসাকে বাণিজ্যিকপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতির উন্নতির জন্য একটি সুচিন্তিত জাতীয় পলিসি লাগবে। শুধু মেডিক্যাল কলেজ চালানোর অনুমতি দিলেই হবে না, সেখান থেকে কী রকম কোয়ালিটির ডাক্তার বের হচ্ছেন, সেটাও নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। ঢাকায় তুরাগ নদীর তীরে আহছানিয়া মিশনের উদ্যোগে আহছানিয়া ক্যান্সার হসপিটাল চালু হয়েছে, চট্টগ্রামে আগ্রাবাদে মা ও শিশু হাসপাতালের সহযোগিতায় এবং কয়েকজন জ্ঞানী ও দানশীল ব্যক্তির উদ্যোগে একটি ক্যান্সার ইনস্টিটিউট স্থাপনের পথে। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের অন্যত্র আরো উদ্যোগ আছে, যেটা আমি জানি না। ২০০৫ বা ২০০৬ সালে আমি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে গিয়েছিলাম, ‘ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ইকনোমিক ফোরাম’-এর প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য। বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১০ জনের কম গিয়েছিল। প্রধান অতিথি বা বক্তা ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শওকত আজিজ। শওকত আজিজ বা তার আমলের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সুনাম-দুর্নাম উভয়ই আছে; আমি সেদিকে যাচ্ছি না, সেটা আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় নয়। শওকত আজিজ তার বক্তৃতায় যা বলেছিলেন তার মধ্যে একটা কথা আমার এখনো মনে আছে। বিভিন্ন সাবজেক্টের মেধাবী ছাত্র বেছে বেছে বিদেশে পাঠানোর নীতি নিয়েছিল তাদের আমলের সরকার; প্রচুরসংখ্যক ছাত্র। ডাবল মাস্টার্স করার জন্য এবং পিএইচডি করার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল, শিক্ষাঙ্গনের ভিত্তি শক্তিশালী করা। ১৯৬০-এর দশকের শেষাংশে এবং ’৭০-এর দশকের শুরুতে তৎকালীন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টও এ ধরনের ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে হয়।
চিকিৎসকের প্রতি কৃতজ্ঞতা
আমাদের দেশ থেকে প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে যায়। সর্বাধিক যায় ভারতে, তারপরের সংখ্যা যায় থাইল্যান্ড এবং তারপরের সংখ্যা যায় সিঙ্গাপুরে। খরচের দিক থেকে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা খরচ সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসার গুণ বা মানদণ্ড প্রসঙ্গে, যেই রোগী যেখান থেকে সাফল্য পেয়েছেন, সেই রোগী এবং তার আত্মীয়স্বজন ওই জায়গা বা হাসপাতাল বা ডাক্তারের প্রশংসা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। ভারতের চেন্নাই বা ব্যাঙ্গালুরু বা ভেলোর বা দিল্লি এমনকি কলকাতার বহু হাসপাতাল এবং ডাক্তার আমাদের দেশে সুপরিচিত ও জনপ্রিয়। অনুরূপ ব্যাংককের বুমরুনগ্রাদ হাসপাতাল বা ব্যাংকক হাসপাতালও এখানে সুপরিচিত। সিঙ্গাপুরের একাধিক হাসপাতাল এবং বহু ডাক্তার বাংলাদেশে পরিচিত। আমার কনিষ্ঠ ভাই মরহুম সৈয়দ সালাহউদ্দীনের চিকিৎসা হয়েছে (সিঙ্গাপুরে), সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে এবং ঢাকায় ল্যাবএইড হাসপাতালে। সিঙ্গাপুরে টিম লিডার ছিলেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লিম সুন থাই এবং ল্যাবএইডে টিম লিডার ছিলেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মোফাজ্জল হোসেন। আমার ভাইয়ের ক্যান্সার আক্রান্ত শরীরে ক্যান্সারের প্রভাবে চোখের দৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সিঙ্গাপুরে চোখের চিকিৎসক ছিলেন চি সুন ফেইক এবং ঢাকায় চোখের চিকিৎসক ছিলেন ল্যাবএইডের ডাক্তার তারিক রেজা আলী। সিঙ্গাপুরে খরচ অনেক বেশি। সালাহউদ্দীনের ক্লাসফ্রেন্ড তুহিন প্রথম দুই বছর একাই সালাহউদ্দীন ও তার পরিবারকে যখন প্রয়োজন তখন রেখেছে। পরের বছর সালাহউদ্দীনের আরেকজন ক্লাসফ্রেন্ড (আমাদের মামাতো ভাই) মার্চেন্ট নেভির ক্যাপ্টেন আবু সাঈদ চৌধুরী যখন প্রয়োজন তখন সালাহউদ্দীন ও তার পরিবারকে রেখেছে। আমার বাবার যখন ক্যান্সার ছিল, সেগুলোর জন্য বড় বড় খরচের বিভিন্ন টেস্ট এবং সালাউদ্দীনের জন্য সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা খরচ বেশির ভাগ বহন করেছে আমার চতুর্থ ভাই সৈয়দ নাসির। মহান আল্লাহ তায়ালা সৈয়দ নাসিরকে আরো উন্নতি দিন, এটুকুই প্রার্থনা।
পরিশ্রম ও সততাই আনে টেকসই ব্যবসায়িক সাফল্য
কলামের শুরুতে একটি অনুচ্ছেদে বলেছিলাম ১৯৬৮ সালে আমার বাবার একটি উপদেশের কথা। মহান আল্লাহর দয়ায় পাঁচটি ভাই প্রতিষ্ঠিত ছিলাম। বাবার আগ্রহেই আমাদের চতুর্থ ভাই ব্যবসায় ও শিল্পে মনোযোগ দেন। মহান আল্লাহর দয়ায় তিনি যথাসম্ভব ভালো করেছেন। আমার ভাইয়ের মতো আরো যারা সৎভাবে ব্যবসায় করতে চান, শিল্প পরিচালনা করতে চান তাদের সামনে অনেক বাধা। তবে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ঘুষ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। সৈয়দ নাসির বিলাসী জীবন যাপন করে না, বিলাসী গাড়িতে চড়ে না এবং দৈনিক আঠারো ঘণ্টা পরিশ্রম করে। সীমাহীন কষ্ট ও উদ্বেগ, অপরিসীম ধৈর্য ধারণ করেই সৈয়দ নাসির ঢাকা ও চট্টগ্রামে দু’টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। সে শিখতে আগ্রহী। বছরে তিন-চারবার চায়না ফ্রান্স বা দুবাই বা মুম্বাই ইত্যাদি জায়গায় যায় বিভিন্ন শিল্পমেলায় অংশগ্রহণ করার জন্য, শেখার জন্য। আমার ভাইকে আমি দেখেছি বাংলাদেশী শিল্পোদ্যোক্তাদের সাহস ও ইনোভেটিভ স্কিলের জন্য প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে। এই ভাই, সৈয়দ নাসির পরিবারের পক্ষ থেকে এবং নিজের পক্ষ থেকে যেমন দান-খয়রাত করে, তেমনি পরিবারের কাছের গণ্ডি বা এক-দুই ধাপ দূরের গণ্ডির ভেতরেও আত্মীয়স্বজনের শোকে ও দুঃখে পাশে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় ভাই ডাক্তার নিউরো সার্জন মইনুদ্দীন সমন্বয় করেছেন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং চতুর্থ ভাই নাসিরের আর্থিক উদারতায় আমরা সালাহউদ্দীনের চিকিৎসা করাতে পেরেছি। সালাহউদ্দীনের ব্যাংকও আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে। আমরা ব্যাংকের প্রতি কৃতজ্ঞ। সালাহউদ্দীন এবং তার (প্রকৌশলী) স্ত্রীর সঞ্চয় বৃহদংশই ভাঙতে হয়েছে চিকিৎসার জন্য। অন্য ভাই ও বোনেরা, ভগ্নিপতিরা, পরিবারসহ পাশে থেকেছি। আত্মীয়স্বজন সর্বদাই দোয়া করেছেন। বস্তুতই আমি মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা কোনোমতেই যথেষ্ট প্রকাশ করতে পারব না যে, আমি এরূপ ভাই ও ভ্রাতৃবধূদের এবং এরূপ বোন ও ভগ্নিপতিদের বড় ভাই। সব প্রশংসা মহান আল্লাহরই বটে। এত কথা বললাম দু-একটি উপসংহার তুলে আনার জন্য।
পরস্পরের বন্ধন
পারিবারিক বন্ধন ও আত্মীয়তার বন্ধন বিপদ-আপদে এবং সঙ্কটে একটি বড় রক্ষাকবচ। পাশ্চাত্যের ঐতিহ্য হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিবার, বিচ্ছিন্ন পরিবার। আমাদের দেশের রেওয়াজ ছিল বড় পরিবার যৌথ পরিবার। আংশিকভাবে পাশ্চাত্যের প্রভাবে, আংশিকভাবে আমাদের দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রয়োজনে এখন যৌথ পরিবার আনকমন হয়ে আসছে। কিন্তু অতীতের তুলনায় উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, বিশেষত ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যবস্থা উন্নততর হওয়ায়, শারীরিক দূরত্ব বাড়লেও মনের দূরত্বকে কাছে রাখতে সহায়তা করছে। ব্যক্তির চরিত্রের ওপর নির্ভর করে বন্ধুত্ব। দায়িত্ব পালনের ওপর নির্ভর করে বন্ধুদের আনুগত্য ও ভালোবাসা। আমাদের দেশে যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল, সেহেতু আমাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর নির্ভর করতে হয় বিপদ-আপদ ও অসুখ-বিসুখ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন