তৌহিদেরই মুর্শিদ আমার,
মুহাম্মদের নাম, মুর্শিদ মুহাম্মদের নাম ॥
ওই নাম জপলে বুঝতে পারি,
খোদারি কালাম ॥
মুর্শিদ, মুহাম্মদের নাম ॥
এই কলামের প্রেক্ষাপট
উপরের লাইনগুলো আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, কাজী নজরুল ইসলামের একটি ইসলামি সঙ্গীতের প্রথম চারটি চরণ (ভুলভ্রান্তি মার্জনীয়)। সঙ্গীতের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ, অনেক কবিই ইসলামি সঙ্গীত রচনা করে গিয়েছেন, কিন্তু ইসলামি জগতে আমার মতো অনেকের দৃষ্টিতে, কবি নজরুল ইসলামের উপর কেউ নেই। রবিউল আওয়াল মাস এলে ১২ রবিউল আওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকি। এই সময়টাতে আমি, বছরের অন্য সময়ের তুলনায়, নজরুলের ইসলামি সঙ্গীতগুলো শুনতে বেশি আগ্রহী থাকি এবং এই শ্রবণ আমার কাছে অতি শান্তিপ্রদ মতো মনে হয়। যে কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারতাম না, সেই কথাগুলো এই কবি বলে গেছেন। সে জন্যই সাধক, সাহিত্যিক ও সঙ্গীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসীর মতো অনেকেই বিদ্রোহ কবির নাম অতি সম্মান ও আদবের সাথে নিয়ে থাকেন এবং সম্বোধন করেন। এখন রবিউল আওয়াল মাস চলছে; আজ বুধবার রবিউল আওয়াল মাসের ৯ তারিখ। সে জন্যই নিজের মনের আগ্রহে, একটি বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপন করলাম। প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে ১৫ নভেম্বর তারিখে এই পত্রিকায়। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে দ্বিতীয় খণ্ড।
উম্মতের কষ্টে উদ্বিগ্ন রাসূল সা:
পবিত্র কুরআনের নবম সূরা, সূরা তওবার ১২৮ নম্বর আয়াতের অনুবাদ এখানে উদ্ধৃত করছি। প্রথমে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (মার্চ ১৯৯০) অনুবাদ থেকে : ‘তোমাদিগের মধ্য হইতেই তোমাদিগের নিকট এক রাসূল আসিয়াছে। তোমাদিগকে যাহা বিপন্ন করে, উহা তাহার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদিগের মঙ্গলকামী, মোমিনদিগের প্রতি সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’ দ্বিতীয়ত, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান কর্তৃক করা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ গ্রন্থ ‘কানযুল ঈমান’ থেকে উদ্ধৃতি: ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট তাশরিফ এনেছেন তোমাদের মধ্য থেকে ওই রসূল, যাঁর নিকট তোমাদের কষ্টে পড়া কষ্টদায়ক, তোমাদের কল্যাণ অতি মাত্রায় কামনাকারী, মুসলমানদের উপর পূর্ণ দয়ার্দ্র, দয়ালু।’ অনেক ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদগ্রন্থ ঘেঁটে শুধু দু’টি অনুবাদগ্রন্থ থেকে উপরের অনুচ্ছেদে দু’টি অনুবাদ উপস্থাপন করলাম। কিন্তু আমার বিশ্বাস, সময় বা যুগের তারতম্যে উপস্থাপনায় ভিন্নতা থাকলেও, শব্দচয়নে ভিন্নতা থাকলেও, মর্ম এক। পবিত্র কুরআনের অপর নাম ফোরকান, অর্থাৎ পার্থক্যকারী।
কিসের মধ্যে পার্থক্যকারী? সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী। পবিত্র কুরআনের আরেকটি নাম কালামুল্লাহ বা কালাম-আল্লাহ অর্থাৎ মহান আল্লাহর কথা। সেই মহান আল্লাহ মানুষের নিকট, বিশেষত বিশ্বাসীগণের নিকট উপস্থাপন করছেন তাঁর সম্মানিত বন্ধুকে, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর বন্ধুকে। ইংরেজি পরিভাষায় বলা যায়, ‘আল্লাহ ইজ ইনট্রোডিউসিং হিজ ফ্রেন্ড টু অ্যামনকাইন্ড, পার্টিকুলারলি টু দি বিলিভার্স।’ পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দ্যোতনায়, বিভিন্ন উপমায়, মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সম্মানিত বন্ধুকে মানবজাতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই উপস্থাপনাটি বা এই ইনট্রোডাকশনটি শুধু ওই দিনের জন্য প্রযোজ্য নয়, যে দিন আয়াতটি নাজিল হয়েছিল। এই উপস্থাপনাটি সর্বজনীনভাবে সর্বকালের জন্য। এই বিশ্বের যেখানে বসেই একজন পাঠক কুরআনের এই আয়াত পড়ুন না কেন, আয়াতটি তাঁর জন্যই প্রযোজ্য। রাসূল শব্দের আভিধানিক অর্থ বার্তা বাহক, ইংরেজি ভাষায় মেসেঞ্জার। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য বার্তা নিয়ে এসেছেন মুহাম্মাদ সা:; তাই তিনি আল্লাহর বার্তা বাহক তথা মেসেঞ্জার তথা রাসূল। দ্বীন ইসলামের প্রথম দিন থেকেই রাসূল বলতে মুহাম্মাদ সা:কেই বোঝানো হয়, তাই তিনি রাসূলুল্লাহ সা:। যে রাসূল আমাদের কষ্টে কষ্ট পান, আমাদের উদ্বেগে উদ্বিগ্ন থাকেন, সেই রাসূল সম্বন্ধে জানাটা কি আমাদের জন্য যুক্তিসঙ্গত নয়? তাই ১৫ নভেম্বরের কলামে আবেদন রেখেছি, আজকের কলামেও আবেদন রাখছি, আসুন, আমরা জানতে চেষ্টা করি। তা হলেই আমাদের ভালোবাসা দৃঢ়তর হবে, তা হলেই আমাদের আনুগত্য দৃঢ়তর হবে।
ইতিহাসের আলোতেই যাপিত রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবন
বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ সা:কে জানার আরো অনেক প্রয়োজন আছে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, মানুষের পক্ষে যেকোনো বিষয় জানা সহজতর হয়ে এসেছে। ইতিহাসকে সময়ের বা যুগের প্রসঙ্গে অনেক ভাগে ভাগ করা হয়। যথা- আধুনিক বা সাম্প্রতিক বা কনটেমপোরারি, মধ্যযুগীয় বা মেডিইভল, প্রাচীন বা অ্যানশিয়েন্ট। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর জীবন ব্যাপ্ত ছিল ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দ, ৬৩ বছর। এর মধ্যে প্রথম ৪০ বছর তিনি জীবনযাপন করেছেন এবং ব্যস্ত ছিলেন মক্কা নগরীতে। তৎকালীন মক্কা একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল। মক্কার মানুষ মূর্তি পূজা করত এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য যে, সমগ্র আরবের উপাসনার কেন্দ্রীয় নগরী ছিল মক্কা। এটাও সত্য যে, মক্কার মানুষ সচেতন, ইতিহাসপ্রেমিক ও সাহিত্যপ্রেমিক ছিল। ৪০ বছর বয়সে রাসূল সা: নবুয়তপ্রাপ্ত হন এবং এর পরবর্তী ১৩ বছর মক্কাতেই কাটান। ইতিহাসবান্ধব পরিবেশে, সাহিত্যবান্ধব পরিবেশে মহানবী সা:-এর জীবনের প্রথম ৫৩ বছর কাটে। তাই তাঁর মক্কা-জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ রেকর্ড বা বর্ণনা বা সাক্ষ্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জীবিত আছে। ৫৩ বছর বয়সে, নবুয়তের ১৩তম বছরে মহানবী সা: মদিনায় হিজরত করেন। এ ছিল ইতিহাসের মোড় ঘুরানো একটি ঘটনা। এ ঘটনাটিকে এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলিকে দু’টি সম্প্রদায় আলাদা আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করেছেন। প্রথম সম্প্রদায় হলো মক্কাবাসী অবিশ্বাসীরা এবং দ্বিতীয় সম্প্রদায় হলেন মদিনার মূল অধিবাসীরা, যাদের মধ্যে গিয়ে মহানবী সা: স্থিত হলেন। দু’টি সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য ভিন্ন।
মক্কার মানুষদের উদ্দেশ্য ছিল, মুহাম্মাদ সা:কে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করা যেন তিনি মক্কার প্রতি হুমকি হতে না পারেন বা হুমকি হতে চেষ্টা করলেও তাঁকে দমন করা যায়। মদিনার অধিবাসীদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেনি, তাদের উদ্দেশ্য ছিল অনেকটা এ রকম যে, মানুষটি ভিন্ন জায়গা থেকে এসেছে এবং কী করে দেখি। মদিনা জীবনের চার-পাঁচ বছরের মাথায় তৎকালীন পারস্য সাম্রাজ্য এবং রোমান সাম্রাজ্য মদিনায় বিকাশমান নতুন রাষ্ট্রের প্রতি দৃষ্টি দেয়। অতএব, সেই সময় থেকে তিনটি ভিন্ন সম্প্রদায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁকে অনুসরণ করছিলেন। এ জন্যই বিনা দ্বিধায়, বিনা বিতর্কে এ কথাটি স্বীকৃত যে, মহানবী সা:-এর জীবন ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ আলোকেই যাপিত হয়েছিল। তাই তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে, তাঁর জীবনী জানা খুব কঠিন নয়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সচেতন বা শিক্ষিত মানুষ জানতে পারছেন বলেই, মানুষ সেই কর্মময় জীবনে উৎসাহিত হচ্ছেন; সেই মহান ব্যক্তির প্রচারিত জীবন দর্শনে প্রভাবিত হচ্ছেন। সেরূপ উৎসাহ এবং প্রভাবের কারণেই বহু মানুষ দ্বীন ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। অতএব, আমরা যারা অটোমেটিক্যালি দ্বীন ইসলামে প্রবিষ্ট আছি, আমাদের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়, মহানবী সা:-এর জীবন ও কর্ম জানতে চেষ্টা করা, তাঁর জীবনের কর্মগুলোকে মূল্যায়ন করা এবং সেখান থেকে শিক্ষা নেয়া।
মহান আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় হুকুম
পবিত্র কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন দু’টি জায়গা থেকে মোট তিনটি আয়াতের অনুবাদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) উদ্ধৃত করছি। তৃতীয় সূরার নাম সূরা আলে ইমরান। এই সূরার ৩১ নম্বর আয়াতের বাংলা অনুবাদ : ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদিগকে ভালোবাসিবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করিবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ পবিত্র কুরআনের ৩৩তম সূরার নাম সূরা আল আহযাব। এই সুরায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বা নির্দেশ আছে। এই সূরার ৪৫ এবং ৪৬ নম্বর আয়াতের বাংলা অনুবাদ উদ্ধৃত করছি : ‘হে নবী! আমি তো তোমাকে পাঠাইয়াছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে। আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁহার দিকে আহ্বানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।’
জানার আরো প্রয়োজনীয়তা ও যুক্তি
প্রথমে ভালোবাসা ও অনুসরণ করা নিয়ে দু’টি কথা বলব। আল্লাহকে ভালোবাসার সাথে সাথেই রাসূল সা:কে অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। কথাটার অর্থ এ রকমও দাঁড়ায়, আমরা যদি রাসূল সা:কে অনুসরণ না করি, তার মানে দাঁড়াবে- আমরা আল্লাহকে ভালোবাসি না। এমন কোনো মুসলমান বা বিশ্বাসী কি পৃথিবীতে আছেন, যিনি বলবেন বা ঘোষণা দেবেন, তিনি মহান আল্লাহকে ভালোবাসেন না বা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ভালোবাসতে চান না? তাহলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই আমাদের অবশ্যই, পুনশ্চ : অবশ্যই, রাসূল সা:কে অনুসরণ করতে হবে। যাঁকে অনুসরণ করতে হবে বা যাঁকে অনুসরণ করব, তাঁকে জানার প্রয়োজন কত ব্যাপক এবং জরুরি, সেটা সম্মানিত পাঠক নিজেই মেহেরবানি করে কল্পনা করুন। মহান আল্লাহ তায়ালা নবী সা:কে পাঠিয়েছেন সাক্ষীরূপে। তিনি অনেক কিছুর সাক্ষ্য দেবেন; তার মধ্যে অন্যতম বিষয় হবে, তাঁর উম্মতের কর্ম। অতএব, ওই মহামানবকে জানা প্রয়োজন, যিনি আমাদের সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, নবীজী সা: সুসংবাদদাতা। তিনি আমাদের সৎকর্মের সুসংবাদ দিচ্ছেন, তিনি মহান আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর সৃষ্টি জগতের সুসংবাদ দিচ্ছেন; তিনি সুকর্মের সুফলের সুসংবাদ দিচ্ছেন। যিনি আমাদের এতগুলো সুসংবাদ দিচ্ছেন, তাঁকে জানা আমাদের জন্য অবশ্যই জরুরি; তাঁকে জানলেই আমরা সুসংবাদের প্রেক্ষাপট বুঝতে পারব। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সা: হচ্ছেন সতর্ককারী। তিনি আমাদের সতর্ক করেছেন; তথা সাবধান করছেন অনেক বিষয়ে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, শয়তানের প্ররোচনা থেকে যেন আমরা দূরে থাকি, আল্লাহর স্মরণ থেকে যেন আমরা কখনই বিরত না থাকি।
তিনি আমাদের সাবধান করে দিচ্ছেন, আমরা যদি আল্লাহর হুকুম করা পথে না চলি, তাহলে আমাদের জন্য কঠিন শাস্তি নির্ধারিত। অতএব, যিনি আমাদের সাবধান করে এতবড় উপকার করলেন, তাঁকে জানা আমাদের জন্য খুব বেশি প্রয়োজন। তাঁকে না জানলে আমরা সাবধানবাণীগুলোর প্রেক্ষাপট বুঝব না। সেই সুবাদেই আজকের এই কলামের মাধ্যমে আবেদন রাখছি- আমরা সবাই যেন রাসূলুল্লাহ সা:কে জানতে চেষ্টা করি। সুফিবাদ বা আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে জানার প্রসঙ্গ এখানে আনছি না। কারণ এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়; আজ তা উদ্দেশ্যও নয়। আমি এখানে শুধু আনছি জাগতিক জানা, দৃশ্যমান মাধ্যমে, দৃশ্যমানকে জানা।
জীবনী বই কোথায় পাবেন, কেন খুঁজবেন?
আমরা অনেক রকমের বই পড়ি। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেহেতু একজন সাবেক সৈনিক, তাই যুদ্ধবিদ্যা, যুদ্ধের ইতিহাস, যুদ্ধের কৌশল এবং বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনাসংক্রান্ত বইপুস্তক এবং বিভিন্ন যুদ্ধের সেনাপতিদের জীবনী পড়াটা আমার জন্য স্বাভাবিক। আমি এখন একজন রাজনৈতিক কর্মী। অতএব রাজনীতি দর্শন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের জীবনী, আমাদের দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের জীবনী, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা ইত্যাদি সংক্রান্ত বই পড়া খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের নিরাপত্তা তথা জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করি, বলি, লিখি, অতএব নিরাপত্তাসংক্রান্ত বই-পুস্তক পড়াই স্বাভাবিক। আপনি একজন চিকিৎসক, অতএব আপনি চিকিৎসা বিদ্যার ওপর বই পড়বেন। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের একজন অধ্যাপক, আপনার আগ্রহ বেশি থাকবে ইতিহাসের বইয়ের ওপরে। আপনি গলফ খেলেন; অতএব আপনি গলফসংক্রান্ত বই পড়বেন। কিন্তু আমরা সবাই মানুষ, আমরা সবাই বিবেকবান প্রাণী বা র্যাশনাল অ্যানিমেল।
আমরা যে মানবজাতির সদস্য, সেই মানবজাতির ইতিহাসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বা প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্বের জীবনী আমরা পড়ব না, তাঁর জীবনকে জানব না, এটা কি অস্বাভাবিক নয়? আমরা মুসলমান। আমাদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। জ্ঞান অর্জনের জন্য আমরা শত প্রকারের বই পড়ি। সুতরাং ‘যাঁকে আমরা অনুসরণ করব’ সেই রাসূল সা:-এর জীবনী আমরা কি পড়ব না? তাঁর জীবনী যদি না পড়ি তাহলে আমরা তাঁকে জানব কিভাবে? তাঁর জীবনী যদি না পড়ি, তাহলে সমালোচকদের জবাব দেব কিভাবে? অতএব, আমাদের সবার জন্য অপরিহার্য হলো, রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনী পড়া। জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলেছেন, পড়লে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে; জানলে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। বাংলা ভাষায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনীগ্রন্থের কোনো অভাব নেই। ১৫ নভেম্বর ২০১৭ এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত কলামে দু-একটি বইয়ের নাম দিয়েছি। আজ নাম দিচ্ছি না। শুধু বলছি, মেহেরবানি করে সন্ধান করুন, ভালো বই পাবেন। যারা ইংরেজিতে পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাদের জন্য ইংরেজিতে লেখা বইয়ের কোনো অভাব নেই। ইন্টারনেটে সার্চ দিলে অবশ্যই বহু বই পাওয়া যাবে। যেটা ভালো লাগে সেটা পড়ুন বা যেটি সহজলভ্য, সেটি পড়ুন। এই কলামের শেষে, আমার ইমেইল দেয়া আছে। যদি আমাকে ইমেইল করেন, তাহলে নিজেও চেষ্টা করব যেটা ভালো মনে করি, সেই বইটির সন্ধান দিতে।
রাসূলুল্লাহ সা: মানবতার প্রতিচ্ছবি
মহান আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা মোতাবেক, আমাদের ঈমানি চেতনা মোতাবেক, এই পৃথিবীতে আর কোনো নবী বা রাসূল আসবেন না। হজরত মুহাম্মাদ সা:-ই হচ্ছেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল এবং সব নবী ও রাসূলের ইমাম। পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য প্রেরিত; পবিত্র কুরআনের বক্তব্য সব মানবজাতির জন্য। মানবজাতির যেসব সদস্য পবিত্র কুরআনের বক্তব্যকে গ্রহণ করছেন, তাদের আমরা ‘মুসলমান’ বলছি। পৃথিবীর সবাই মুসলমান নয়। আবার মুসলমানদের মধ্যেও বিভিন্ন বিষয়ে মতের পার্থক্য আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমানদের কোনো-না-কোনো গোষ্ঠী বা জাতি বা সম্প্রদায় অপর কোনো-না-কোনো গোষ্ঠী বা জাতি বা সম্প্রদায়ের প্রতি আক্রমণাত্মক। আবার, সার্বিকভাবে পৃথিবীর অন্য ধর্মাবলম্বীরা, মুসলমানদের প্রতি বহু ক্ষেত্রেই নানাভাবেই বৈরী মনোভাব পোষণ করেন। ধর্মীয় বিশ্বাসের বিভিন্ন আঙ্গিক বাদ দিলেও, বস্তুগত অনেক বিষয়ের কারণে বিভিন্ন দেশের এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে মারাত্মক কঠিন সম্পর্ক বিরাজমান। উদাহরণস্বরূপ, ২৫ বা ৫০ বছর আগের দক্ষিণ আফ্রিকার কথা বলি। সেখানে কালো আর সাদা বর্ণের মানুষের মধ্যে কত বড় পার্থক্য ছিল তা আমরা ভুলিনি। ২৫-৩০ বছর আগে বসনিয়া হার্জেগোভিনায় মুসলমানদের ওপর আক্রমণের কথাও বলা যায়। সাম্প্রতিকতম উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারের উগ্রবাদী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত নারকীয় অত্যাচারের কথা চিন্তা করি। এসব ক্ষেত্রেই রক্তপাত ইতিহাসের পাতাকে কলুষিত করেছে। অথচ এখানে হওয়ার কথা ছিল ভালোবাসার সম্পর্ক, সুবিচারের সম্পর্ক। এগুলোই মানবতার বৈশিষ্ট্য। মহানবী সা: ছিলেন বিশ্ব মানবতার প্রতীক। তাঁর ঘনিষ্ঠতম সহচর তথা সম্মানিত সাহাবিরা ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতীক। তাই আমাদের সমষ্টিগত ও ব্যক্তিগত জীবনে মানবতাবোধ বা মানবিকতা এবং ন্যায়বিচারবোধ জাগ্রত রাখতে চাই। এ কারণে, মহানবী সা:-এর জীবন ও কর্মকে বোঝা আবশ্যক।
একটি উদাহরণ (ইনস্টিটিউট)
২০০২ সালে ঢাকা মহানগরে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছিল; সেটির পূর্ণ নাম ‘ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ অ্যান্ড প্রোপাগেশন অব দি টিচিংস অব হজরত মুহাম্মাদ সা:’। সংক্ষিপ্ত নাম হলো ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ সা:। পূর্ণ নামের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় : ‘হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনের শিক্ষাগুলোর গবেষণা ও প্রচারের প্রতিষ্ঠান।’ প্রথম আড়াই বছর আমি এর প্রেসিডেন্ট বা সভাপতি ছিলাম। তবে স্বচ্ছতার স্বার্থে বলে রাখা প্রয়োজন, এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ার পেছনে যিনি সবচেয়ে উদ্যমী, উৎসাহী এবং নির্বাহী ছিলেন তার নাম আহমদ শফি মাকসুদ। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই অনেক জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি এতে জড়িত ছিলেন এবং আছেন। নিজে একজন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মী হয়ে যাওয়ার সুবাদে, ইনস্টিটিউটের নিয়মিত কার্যক্রম থেকে দূরত্বে এসে গেছি, যদিও আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণটি দিলাম এ জন্য, আমাদের সুনির্দিষ্টভাবেই তথা পরিকল্পনা করেই মহানবী সা:-এর জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিক প্রথমে নিজেদের জানতে হবে, অতঃপর অন্যদের জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সূরা ইনশিরাহ’র চতুর্থ আয়াতে, মহানবী সা:-কে জানাচ্ছেন, ‘আমি আপনার নামকে, (তথা আপনার সুনাম মর্যাদা ও গুরুত্ব) সুমহান (তথা সুউচ্চ, সুবিস্তৃত, সর্বপ্রিয়) করে দিয়েছি।’ অর্থাৎ আমরা জানতে চেষ্টা করি বা না করি, আমরা সম্মান করি বা না করি, এতে মহান আল্লাহর বন্ধু নবী করীম সা:-এর কোনো ক্ষতি নেই। যদি না জানি, না বুঝি, যদি না অনুসরণ করি, ক্ষতিটা আমাদেরই। যদি প্রচার না করি, ক্ষতিটা আমাদেরই হবে। প্রেক্ষাপটেই আমি নিজেকে গুনাহগার, নগণ্য, অযোগ্য মনে করেই এই কলামের মাধ্যমে এই আহ্বানটি রাখলাম।
তরুণ পাঠকদের জন্য সাবধান বাণী!
আজকের লেখা শেষ করার আগে, একটি সাবধান বাণী উপস্থাপন করছি। সাবধান বাণীটি হলো, ইন্টারনেটের লেখকদের সম্বন্ধে, উইকিপিডিয়ায় লেখকদের সম্বন্ধে। উপযুক্ত জহুরি ছাড়া যেমন মণিমুক্তা চেনা মুশকিল, তেমনি হৃদয়ে সঠিক জ্ঞান ও ভালোবাসা না থাকলে অথেনটিক লেখকের লেখা তৈরি করাটাও দুষ্কর। বিধর্মীরা বা মুসলিমবিদ্বেষীরা, নিজ নামে বা মুসলমান নাম নিয়ে রচনা লেখেন এবং উপস্থাপন করেন। লেখা বা উপস্থাপন করাটা অপরাধ নয়; অপরাধ হলো ভুল তথ্য, ভুল রেফারেন্স, ভুল অনুবাদ, ভুল ব্যাখ্যা বা তির্যক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা। ইন্টারনেটে, মুসলিমবিদ্বেষী, মুসলিম ইতিহাসবিদ্বেষী, মুসলিম সংস্কৃতি বিদ্বেষী, কুরআন বিদ্বেষী, রাসূল সা: বিদ্বেষী, ন্যায় ও সত্য বিদ্বেষী এবং জ্ঞান অর্জন বিদ্বেষী ব্যক্তিরা ভুল তথ্য ও অপব্যাখ্যা মিষ্টি কথার আবরণে উপস্থাপন করে থাকেন। সমস্যাটি হলো এরূপ ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করা সবার জন্য সহজ নয়।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব:); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন