কলামটির শুরুতেই কলাম লেখক, একজন রাজনৈতিক কর্মী নিজের জন্য এবং তার সহকর্মীদের জন্য পাঠককুলের কাছে দোয়া ও শুভেচ্ছা কামনা করছেন। মানুষের যেমন জন্মদিন আছে, একজন রাজনৈতিক কর্মীরও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ দিবস থাকে। ওই উপলক্ষেই এই কলামটি।
রাজনীতি এবং মানুষ কী বলে?
মনে করুন, কোনো জায়গায় গল্প করছি। কোনো কুলখানিতে গেলাম অথবা কোনো বিয়ের দাওয়াতে, অথবা কোনো মিশ্র ক্ষুদ্র সমাবেশে গল্প চলছে। এ-কথা সে-কথা উঠবেই। রাজনীতির কথা উঠতে বাধ্য। দশ-বারোজন যদি আড্ডায় থাকে, পরিচিত বা রাজনৈতিক বিষয়ে মোটামুটি সচেতনÑ এমন কেউ জিজ্ঞাসা করবে : ‘আপনাদের দলের মহাসচিবের কোনো খবর কি পাওয়া গেল?’ একজন না একজন বলবেনই : ‘খামাখাই রাজনীতি করছেন, বড় বড় দলের বাইরে পাবলিক যাবেও না আবার বড় দলগুলো ছাড়া কিছু হবেও না। আপনারা ছোট দল অযথাই সময় নষ্ট করছেন।’ আরেকজন বলবে, ‘রাজনীতি-ফাজনীতি দিয়ে কিচ্ছু হবে না, খামাখাই সময় নষ্ট, যা হওয়ার তা ইন্ডিয়ার কথামতোই হবে।’ আরেকজন বলবেন, ‘আরে সব কাজ কি শুধু ইন্ডিয়া করায়, চায়না আছে না, আমেরিকা আছে না, দেখো না রোহিঙ্গাদের নিয়ে কী হচ্ছে?’ অন্য একজন হয়তো বলে উঠবেন, ‘পাকিস্তানের নাম বাদ দিচ্ছেন কেন? ওদের জ্বালায় কি দেশে শান্তি আছে?’ উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে একটু ঠাণ্ডা মেজাজের একজন হয়তো বলবেন : ‘ইবরাহিম ভাই, রাজনীতি আপনার জন্য নয়; মিছা কথা বলতে হবে, চাঁদাবাজি করতে হবে, তেল মারার পাইপ বসাতে হবে; আপনি এগুলো করতে পারেন না; সুতরাং এটা ছেড়ে দেয়াই ভালো।’ তখন আরেকজন ওই দু’জনকে থামাবেন এবং বলে উঠবেন : ‘লিডার, ওদের কথায় মন দিবেন না, আট-দশ বছর লাইগা আছেন, লাইগা থাকেন; আগাইয়া যান; ভয় পাবেন না; আল্লাহ একটা রাস্তা বের করে দেবেনই।’
আবার কেউ বলবেন, ‘ইলেকশনে যে গেলেন না, এখন ঠেলাটা সামলান; দেশটাই নিয়া গেল ওরা।’ কেউ হয়তো খোঁচা দেবে, ‘ওদের আন্ডারে নির্বাচনে যাওয়া মানে, নাকে খত দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করা। সাবধান থাকবেন।’ সর্বশেষজন হয়তো বলে বসবেন, ‘নির্বাচনে না গিয়ে কী করবে, খেজুরের গুড় বেচবে নাকি?’ সম্মানিত পাঠক, বিভিন্ন জনের পক্ষ থেকে কোন ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায়, তার একটা অতি হালকা নমুনা দিলাম। তবে এটা অবশ্যই নিবেদন করে রাখতে হবে যে, রাজনৈতিক কর্মী ইবরাহিম সুপরিচিত হওয়ার পেছনে টেলিভিশনের টকশোগুলো এবং পত্রিকার কলামগুলোর অবদান আছে।
রাজনীতির সংজ্ঞা কী?
রাজনীতির সংজ্ঞাটা নিয়ে চিন্তা করি। বাংলায় শব্দ হলো রাজনীতি; ইংরেজিতে শব্দ হলো পলিটিকস। অনেক আগে একটা জোকস বা কৌতুক ছিল। ঢাকা মহানগরের একটা জায়গা থেকে প্যাসেঞ্জার উঠল রিকশায়; বলল : বিশ্ববিদ্যালয়ে চলো। রিকশাওয়ালা বলল, চিনি না। প্যাসেঞ্জার কথাটা ভেঙে বলল, ইউনিভার্সিটি চলো। রিকশাওয়ালা বলল, এইডা চিনি। আপনারা সাহেব মানুষ, জায়গার নাম বদলান ক্যান?’ ওই রকমই আরেকটি জোক বা কৌতুক হলো, কেউ একজন বলছেন : ‘রাজনীতি কঠিন হয়ে গেছে, রাজনীতির ভেতরে পলিটিক্স ঢুকে গেছে।’ পাঠক চিন্তা করুন। শেষের কৌতুকের মানে হলো, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের ধ্যানধারণায় ‘পলিটিক্স’ শব্দটি নেতিবাচক শব্দ। এই শব্দের মাধ্যমে কূটিলতা বোঝায়, প্রতারণা বোঝায়।
রাজনীতির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে কেউ বলেন, (যদিও পৃথিবীতে দেশে দেশে আগের দিনের মতো রাজা এখন নেই বললেই চলে) রাজনীতি হলো রাজাদের নীতি; বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীতে বলতে পারিÑ রাজা না থাকলেও রাজার স্থলে দেশের শাসক গোষ্ঠীর নীতি। অন্য অনেকে বলেন, রাজাদের নীতি নয়, বরং নীতির মধ্যে যেটা ‘রাজা’, সেটাই রাজনীতি। অর্থাৎ অনেক বিষয়ে অনেক রকমের নীতি থাকতেই পারে; সর্বোত্তম নীতিই রাজনীতি। দুই প্রকারের লোকের, দু’টি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করলাম। কোনো একটাকে বাদ দিলাম না বা কোনো একটাকেই শুধু গ্রহণ করলাম না। আদর্শ সংজ্ঞা কী হবে জানি না। তবে একটা সংজ্ঞা প্রস্তাব করলাম : শাসকগোষ্ঠী দেশের মানুষের জন্য যে নীতির ওপর নিজেরা চলবেন, যে নীতিতে মানুষকে চালাবেন, সেটাই রাজনীতি। যা হোক, রাজনীতির সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করা কিংবা এই সম্পর্কিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গূঢ়-তত্ত্ব আলোচনা করা আজকের কলামের উদ্দেশ্য মোটেই নয়। কিন্তু আলোচনাটাকে পাঠকের কাছে হৃদয়গ্রাহী করতে হলে একটা না একটা সংজ্ঞা বেছে নিতেই হবে।
রাজনীতি কঠিন
রাজনীতি আসলেই কঠিন, যদি রাজনীতির মধ্যে নীতিটাকে মানতে চান। সে নীতি কী? নীতিটা হলো জনগণের খেদমত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ; জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে গমন; পার্লামেন্ট তথা জনগণের প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের ভালো-মন্দ নির্ধারণ। প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করি; নীতিটা কী? নীতিটা হলো, নিজে সৎ থাকো, সততাকে উৎসাহিত করো, মেধাকে উৎসাহিত করো এবং দক্ষতাকে উৎসাহিত করো। প্রশ্নটা আবার করি। নীতিটা কী? নীতিটা হলো, মানুষকে একত্র রাখা, মানুষকে উৎসাহিত রাখা, মানুষকে উজ্জীবিত রাখা, মানুষকে শ্রমমুখী করা, মানুষকে সততামুখী করা এবং পৃথিবীর বুকে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার তাগাদা সৃষ্টি করা; নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্যকে লালন করা এবং সুদূর আগামীর দিকে দৃষ্টি প্রসারিত রাখা। এরূপ নীতিতে বহাল থেকে রাজনীতি করা খুবই কঠিন।
রাজনীতি সহজ
রাজনীতি একদম সহজ যদি নীতি না মানা হয়। মানুষ ধারণা করুন যে, রাজনীতিবিদেরাই দেশ চালান এবং চালাবেন। অর্থাৎ রাজনীতিবিদের হাতে ক্ষমতা থাকবে। ক্ষমতা থাকলে নিয়মনীতি ভঙ্গ করা যাবে, খাতির করা যাবে, চুরিচামারি-ডাকাতি করা যাবে, দখল-বেদখল করা যাবে। তাহলে টার্গেট ঠিক করতে হবে, কোন রাজনীতিবিদের পেছনে এখন সময় দিলে, ভবিষ্যতে তার ‘প্রতিদান’ পাওয়া যাবে। ঠিক করুন, কোন রাজনীতিবিদকে খরচের জন্য টাকা-পয়সা দিলে আগামী দিনে তিনি আপনার একটা ‘বন্দোবস্ত’ করে দেবেন। যদি আপনি ২০০০ সালে টার্গেট করে থাকেন, তাহলে দু’চার বছর পর তার ফল পেয়েছেন; যদি কেউ ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ না করে। যদি আপনি ২০০৫ সালে টার্গেট করে থাকেন, তাহলে তার ফল ২০০৯ থেকে পেয়েই যাচ্ছেন। যদি আপনি এখন ২০১৭-এর শেষ মুহূর্তে টার্গেট করেন, তাহলে এর ফল পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বর্ষাকালে গাছের চারা লাগানো হয়; দুই-চার বছর পর ওই গাছে ফল আসে। বৃক্ষমেলায় গেলে এমন গাছও দেখা যায় যেটাতে ফল ধরে আছে; বড় টবের মধ্যে গাছটি। দাম বেশি হবে; কিন্তু সেটিকেই এনে যদি আপনার বাগানে লাগান, তাহলে ফল সাথে সাথে পাবেন। অনুরূপ, এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের যদি নগদ তেল দেয়া যায়, তাহলে নগদ ফল পাওয়া যাবে। এরূপ তেল দেয়া এবং নগদ ফল আশা করা মোটেই নীতির মধ্যে পড়ে না। তাই বলছিলাম রাজনীতি একদমই সহজ, যদি নীতি অমান্য করতে প্রস্তুত থাকেন।
আমার রাজনীতির প্রেক্ষাপট
দশ বছর আগের কথা। কোনো পাঠক যদি এ প্রসঙ্গে একটু বেশি জানতে চান, তিনি আমার লেখা ‘মিশ্র কথন’ বইটির শেষের তিনটি অনুচ্ছেদ পড়তে পারেন। ২০০৭ সালে এসে, হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতি ভালোও হয়নি বা মন্দও হয়নি। যা হওয়ার তা ক্রমান্বয়ে হয়ে আসছে। এ রকম একটা পরিস্থিতিতেই, ২০০৭ সালে, সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- রাজনীতি করব। এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে প্রেক্ষাপটের অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছি। মহান আল্লাহর দয়ায় বিখ্যাত ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে এবং পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি কাকুলে সফল ও মেধাবী ছাত্র ছিলাম। মহান আল্লাহ তায়ালার দয়ায় ১৯৭১ সালে একজন কর্মঠ ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। আল্লাহর অসীম রহমতে সেনাবাহিনীতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব সফলভাবে পালন করেছি।
উপসংহার হলো, আমার চরিত্র ও চিন্তায় উদ্যম এবং সাহস সর্বদাই ছিল। উদারপন্থী ইসলামী চিন্তাচেতনায় বড় হয়েছি ছোটকাল থেকেই। অতএব দ্বীন ইসলামের শাশ্বত শান্তির বাণী, কল্যাণের বাণী, ভ্রাতৃত্বের বাণী আমার চিন্তায় ও চেতনায় সর্বদাই ঢেউ খেলত। ১৯৯৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অকালীন অবসরে চলে গেলেও, চারিত্রিক বা মানসিক বৈশিষ্ট্যগুলো বহাল ছিল। এরূপ প্রেক্ষাপটে অবসর নেয়ার পর থেকেই লেখালেখি করছি; ২০০২ সাল থেকে টিভিতে যাই। লিখতে গেলে বা বলতে গেলে, প্রিয় কিংবা অপ্রিয় উভয় ধরনের কথা বলতেই হয়। নাগরিক সমাজের একজন ছিলাম; তখন দেশের রাজনীতির সার্বিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা করতাম; আলোচনা ও সমালোচনা করতাম। তখন অনেকেই আমাকে উদ্দেশ করে বলতেন : বলা সহজ, লেখা সহজ, সমালোচনা সহজ; কিন্তু বাস্তবে কাজ করে দেখানো কঠিন। যদি সাহস থাকে এবং মনে করেন, পারবেন, তাহলে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির মাঠে এসে করে দেখান। সেই থেকেই রাজনীতির মাঠে। কোনো আমলের কোনো সরকারের কোনো প্ররোচনায় বা উৎসাহে কিংবা কোনো প্রকারের সহায়তায় বা আহ্বানে রাজনীতিতে আসিনি। আমাদের দল, নিজেদের সিদ্ধান্তেই নিজেরা রাজনীতি করছি।
ক্ষুদ্র দলের ছায়ায় রাজনীতি করার সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই আছে। দশ বছর ধরে দল পরিচালনা এবং নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত শর্তগুলোকে বহাল রাখা বেশ কষ্টের কাজ, খুবই ত্যাগ স্বীকারের ব্যাপার। শিল্পপতিরা ও ব্যবসায়ীরা সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলকে। ক্ষুদ্র বা ছোট দলগুলো কোনোমতেই শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের আগ্রহের তালিকায় পড়ে না; না পড়ারই কথা। তার মধ্যে যদি ক্ষুদ্র বা ছোট রাজনৈতিক দল সরকারবিরোধী অঙ্গনে থাকে, তাহলে সেই ছোট দলের ‘খবর আছে’! বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদবাক্য আছে, ‘তেলা মাথায় তেল দেয়া’। রাজনীতি এবং শিল্পাঙ্গনের মধ্যে যে ইন্টারঅ্যাকশন, সেখানে এই প্রবাদবাক্যটি বেশি প্রযোজ্য। স্বাভাবিকভাবে ছোট দলগুলোর মাথায় তেল থাকে না; অতএব নতুন কেউ তেল দেয় না। এ কথা জেনেই এবং মেনেই, এই সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেই কয়েকটি ছোট দলের মধ্যে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিও অগ্রসর হচ্ছে।
শৈশব থেকে কৈশোরে আসা (দল)
৪ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে ঢাকা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয় অবস্থিত ইমপেরিয়াল হোটেলের দুটো তলা মিলিয়ে আমাদের সম্মেলন হয়েছিল। ১২০০-এর অধিক মেহমান অংশ নেন। সেদিনই আমাদের দল, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির কথা, ঘোষণা করা হয়। সে দিনই ঘোষণাপত্র, গঠনতন্ত্র এবং প্রথম কমিটি ঘোষিত ও প্রচারিত হয়। ওই আমলের বেশির ভাগ সঙ্গী-সাথী এখনো সঙ্গে আছেন। প্রখ্যাত বক্ষব্যাধি চিকিৎসক ও জিয়া পরিষদের এককালীন সভাপতি ডাক্তার ইকবাল হাসান মাহমুদ; সিলেটের সন্তান ফেলো চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট কাহির মাহমুদ; পিরোজপুরের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আজাদ মাহবুব (সেই ১৯৭০ সাল থেকে রাজনীতি করছেন); চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশের একজন জাতীয় ক্রীড়াব্যক্তিত্ব শাহজাদা আলম; মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইলিয়াস (যিনি কৈশোরে এবং তারুণ্যের প্রথম অংশে মওলানা ভাসানীর সাথে রাজনীতি করেছেন);- এরা সবাই এখন পার্টির স্থায়ী কমিটিতে। মহিলাদের রাজনীতিতে উৎসাহিত করার নিমিত্তে একজন মহিলাও স্থায়ী কমিটিতে আছেন, ‘ফোরকান ইবরাহিম’। ২০০৭ সালের ১৭ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন থেকে নিবন্ধন পেয়েছিলাম। নিবন্ধন পাওয়ার ৪০ দিনের মাথায় ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনে আমাদের দল অংশগ্রহণ করেছিল; ৩৬টি আসনে আমাদের প্রার্থী ছিলেন। মূল লক্ষ্য ছিল দলকে নির্বাচনমুখী করা এবং নির্বাচনের ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতা অর্জন করা। নবীন দল, জিততে পারবে না এটা স্বাভাবিক ছিল। গত দশ বছরে দল বড় হয়েছে, পরিচিতি বেড়েছে; বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে দলের গুরুত্ব বেড়েছে কি কমেছে সেটা জনগণ বিচার করবেন। তবে বিক্ষুব্ধ মনের একটি কথা বলতেই হবে : বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির কর্মঠ ও দল-অন্তঃপ্রাণ মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান গত তিন মাস নয় দিন যাবত (২৭ আগস্ট রাত ১০টার পর থেকে) অপহরণ করা অবস্থায় আছেন; ইংরেজি ভাষায় ‘এনফোর্সড ডিস-অ্যাপিয়ারেন্স’- পলিটিক্যাল অপহরণ।
জোট-পরবর্তী বিনিয়োগ
২০১১ সালের শেষ দিকে বিএনপির পক্ষ থেকে মহাসচিব আমাদের দফতরে মেহমান হয়ে এসেছিলেন এবং চারদলীয় জোটে যোগদানের আমন্ত্রণ দিয়েছিলেন। আমরা স্বাগত জানিয়েছিলাম। পরে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হয়। সেই থেকে ছয় বছরের অধিক কাল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে আছি। শ্রম অথবা মেধা অথবা কর্মী অথবা সব কিছুরই একটু একটু দিয়ে আমরা জোটে অবদান রেখে যাচ্ছি। জোটে যাওয়ার সময় থেকেই নির্বাচনী আসনভিত্তিক পরিশ্রম ও সময় বিনিয়োগ করে আসছি। থাকি ঢাকা মহানগরের মহাখালী ডিওএইচএসে তথা ঢাকা-৫ আসনে, কিন্তু আমি সময়, মেধা, শ্রম ও রাজনৈতিক খরচ বিনিয়োগ করছি চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায়, অর্থাৎ চট্টগ্রাম-৫ আসনে। জোট ঘোষণার পর থেকে, আমাদের দলসহ জোটের অন্য দলগুলোর বহু নেতাকর্মীই আসনভিত্তিক রাজনীতিতেও মনোযোগ দিয়েছেন। কারো জন্য আসন হয়তোবা সুনিশ্চিত, অন্যদের জন্য হয়তো দোদুল্যমান।
জোটের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বড় তাগাদা
২০-দলীয় জোট বর্তমানে একটি শক্তিশালী অবস্থানে আছে; যদিও জোটের সবগুলো দলই নিবন্ধিত নয়। ২০-দলীয় জোট সর্বাবস্থায় জনমুখী, গণমুখী, গণতন্ত্রমুখী, উন্নয়নমুখী, নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক জোট। ২০১৪ সালে বিএনপির নেতৃত্বে ২০-দলীয় জোট সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল; স্পর্শকাতর পরিবেশেও কল্যাণ পার্টি জোটের প্রতি অনুগত ছিল। আগামী নির্বাচন এখন থেকে ১২ মাস পরে হবে নাকি ১০ মাস পরে হবে নাকি চার মাস পরে হবে, জানি না। জোটের শীর্ষতম নেতা বেগম জিয়ার ওপর মামলা-হামলার কোনো শেষ নেই। জোটের সবচেয়ে বড় দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা, মামলা ও জুলুমের কোনো শেষ নেই। এরূপ পরিস্থিতিতে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় বা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে একটি অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন। জোটের শীর্ষ নেত্রী তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা, এই পরিবেশ সৃষ্টির তাগাদা দিয়েই যাচ্ছেন। আমরাও দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সরকার করে যাচ্ছে অবহেলা।
বড় দলের সহায়তা অপরিহার্য
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নির্বাচনমুখী দল। একই সাথে, আমরা রাজনৈতিক শৃঙ্খলাপন্থী দল। দু’মাস আগে নির্বাচন কমিশনে সংলাপের দিন আমরা আমাদের রাজনৈতিক ও সংবিধান সম্পর্কিত বক্তব্য তুলে ধরেছি। সেই বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে পত্রিকায় কলাম লিখেছি (নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ২০ সেপ্টেম্বর ও ২৭ সেপ্টেম্বরের কলাম দ্রষ্টব্য)। আমরা জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু তার পরেও কথা থেকে যায়। একলা আমাদের পক্ষে অনেক কাজ করা সম্ভব নয়। আমাদের সদিচ্ছা যত বড়ই হোক না কেন, যত ব্যাপকই হোক না কেন, আমাদের সাধ্য ও সুযোগ সীমিত। এটা বাস্তব যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, সবচেয়ে বেশি
ক্যারিশম্যাটিক নেতা হচ্ছেন বেগম জিয়া। দ্বিতীয় জনপ্রিয় নেতা হচ্ছেন শেখ হাসিনা। স্কুলের একটা ক্লাসে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে যেমন ফার্স্ট বয় এবং সেকেন্ড বয় কর্তৃক প্রাপ্ত মোট নম্বরের মধ্যে অনেক তফাৎ থাকতেই পারে, তেমনই বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার মধ্যে এই মুহূর্তে বিশাল ও বিরাট তফাৎ। যা হোক, হঠাৎ করে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অঙ্গনের কালচার বদলানো সম্ভব নয়। হঠাৎ নৈতিকতাকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। তবে আমরা- বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি উদ্যমী; তাই সাহস হারাইনি। আমাদের নীতিবাক্য হলো, ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’। জোটের মধ্যে থেকেও আমরা নিজেদের নীতিতে অটল আছি।
রাজনীতির ভিত্তি কল্যাণ
আমাদের দলের রাজনীতির ভিত্তি পবিত্র কুরআনের সূরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতের উচ্চারণ এরূপ : ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।’ এই অতি বিখ্যাত আয়াতটির বঙ্গানুবাদ নয়, ভাবার্থ দিচ্ছি : ‘মহান আল্লাহ, তাঁর রাসূল মুহাম্মদ সা:কে পাঠিয়েছেন সব সৃষ্টিজগতের জন্য রহমতস্বরূপ।’ পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত আরবি শব্দ রহমতের নিকটতম বাংলা প্রতিশব্দ মঙ্গল, কল্যাণ, দয়া, মায়া, উসিলা, উপকার। অর্থাৎ মহান আল্লাহর বন্ধু রাসূলুল্লাহ সা: হলেন কল্যাণের প্রতীক ও বাহক, কল্যাণের ধারক। আমরা যারা তাঁর উম্মত, আমরাও কল্যাণের উদ্দেশ্যে রাজনীতি করব।
অতএব কল্যাণ করতে হলে, পদ্ধতিগতভাবে বা প্রক্রিয়াগতভাবে পরিচিত বা বিদ্যমান পরিবেশে থেকেই আগাতে হবে। উপযুক্ত জায়গায় যেতে পারলে পরিবেশ এবং পদ্ধতি বদল করা সম্ভব। আমরা মনে করি, সেই উপযুক্ত জায়গা পার্লামেন্ট। অতএব পার্লামেন্টে যাওয়া প্রয়োজন। যাওয়ার পর বিভিন্ন কথা উপস্থাপন করা যাবে সেখানে। দেশব্যাপী প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, ঢাকাকেন্দ্রিক সরকারের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ভৌগোলিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ, দুর্নীতি-দমন প্রসঙ্গে কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত ইত্যাদি পার্লামেন্টে গিয়ে উপস্থাপন সহজ এবং গ্রহণযোগ্য। আমরা সেই লক্ষ্যে গত দশ বছর কাজ করে যাচ্ছি। ৪ ডিসেম্বর ২০১৭ আমাদের দলের দশ বছর বয়স পূর্ণ হয়েছে। এই উপলক্ষে আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়েছে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ১০ ডিসেম্বর। কলামের অবয়ব সীমিত রাখার জন্য, আজকের কলামে দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক বা নৈতিকতার অবস্থা কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থাসহ অনেক কিছুই আলোচনায় আনতে পারলাম না; আশা করি, ওই আলোচনা সভায় সেগুলো উঠে আসবে।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন