বরফখণ্ডের অগ্রভাগ ও অনিশ্চয়তা
২০১৮ সাল নির্বাচনের বছর। এই বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে কোনো একটা সময় আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এটাই বাংলাদেশের সংবিধানের দাবি। একজন কলাম লেখক হিসেবে আমি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন থাকতে চেষ্টা করি। একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সচেতন থাকাটি আমার জন্য প্রায় অপরিহার্য বাধ্যবাধকতা। বাংলাদেশ এখন একটি বিশেষ সময় পার করছে। এই বিশেষ সময়টির নাম স্পর্শকাতর সময় বা কঠোর সময় বা কঠিন সময় বা ক্রান্তিকাল বা বিপদসঙ্কুল সময় বা নাজুক সময়। এরূপ একটি সময় আবির্ভূত হওয়ার জন্য অনেক কারণ বা উপাত্ত দায়ী। তার মধ্যে অন্যতম একটি কারণ বা উপাত্ত হলো রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বাই-প্রোডাক্ট বা শাখা হলো অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা। মোদ্দা কথা হলো, অনেক প্রকারের অনিশ্চয়তা আমাদের গ্রাস করেছে। আমরা শুধু রাজনৈতিক আঙ্গিকের যৎকিঞ্চিৎ, একেবারেই আইসবার্গের টিপের মতো একটি অংশকে নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস নিচ্ছি। সম্মানিত তরুণ পাঠকদের জন্য নিবেদন করে রাখছি যে, আইসবার্গ মানে বিশাল আকৃতির বরফখণ্ড যেটি বড় বড় মহাসাগরগুলোর উত্তর অংশে ভাসমান থাকে এবং বরফখণ্ডটির মোট আকার বা আকৃতির ৯ ভাগের আট ভাগ পানির নিচে লুক্কায়িত থাকে ও ৯ ভাগের এক ভাগ মাত্র পানির ওপরে ভাসমান থাকে বা দর্শনীয় থাকে। ইংরেজি পরিভাষায় ‘টিপ অব দি আইসবার্গ’ বলতে বোঝায় ওই ভাসমান ৯ ভাগের এক ভাগের অগ্রভাগকে। বিশাল বরফখণ্ডের সুনির্দিষ্ট একটি অংশকে নিয়ে আজকে আলোচনা করলাম; সুনির্দিষ্ট আরেকটি অংশকে নিয়ে আরেক দিন আলোচনা করব।
৩২ দলীয় জোট? অন্যান্য সম্ভাব্য জোট
গত তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কিছু খবর আমাদের পত্রপত্রিকায় এসেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি খবরের শিরোনাম ছিল ‘ঐক্যের পথে ৩২ দল’ (১৮ এপ্রিল ২০১৮ বুধবার ‘যুগান্তর’ পৃষ্ঠা-১ ও ১৪)। ওই দীর্ঘ গঠনমূলক রিপোর্টটি আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেন; হয় যুগান্তর পত্রিকার আর্কাইভসে গিয়ে অথবা আমার ওয়েব সাইট www.generalibrahim.com.bd-এ গিয়ে মেনুতে ‘জাতীয় ইস্যু’ কিক করলেই রিপোর্টটি পড়তে পারবেন। যুগান্তরের ভাষ্য মোতাবেক বর্তমান ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আরো ১২টি দল হালকাভাবে বা কঠোরভাবে যুক্ত হতে পারে। এ দিকে, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এবার নির্বাচনে যাবেই যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। জাতীয় পার্টির মতে, যদি বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তাহলে জাতীয় পার্টি মহাজোটের অংশ থাকবে, তথা বর্তমান মতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে জোটবদ্ধ থাকবে; অপর পে যদি বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে না যায় তাহলে জাতীয় পার্টি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করবে এবং হয় সরকার গঠন করবে, নয় শক্তিশালী বিরোধী দল হবে। ইসলামি দলগুলোর মধ্যে এবং বাম ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও জোটবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা এখনো চূড়ান্তভাবে হ্যাঁ বা না পর্যায়ে যায়নি। এরূপ পরিস্থিতিতে, আগামী নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সমীকরণ কোনপর্যায়ে গিয়ে ঠেকে সেটা কেউ নিশ্চিত নয়। তবে নিশ্চিত যে, নির্বাচনের আগে আন্দোলন অনিবার্য। কিসের জন্য আন্দোলন? সংপ্তিতম উত্তর। নিরপে বা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে; নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে। যেটা সম্ভাব্য ৩২ দলীয় জোটের জন্য প্রযোজ্য, সেটা বিদ্যমান ২০ দলীয় জোটের জন্যও প্রযোজ্য হওয়ার কথা। অর্থাৎ আন্দোলন এবং নির্বাচন একটির সাথে আরেকটি গিট্টা দেয়া।
বিএনপিই সব বিষয়ে প্রধান
এটা গেল জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন সম্পর্কে বর্ণনা বা বিশ্লেষণ। বড় বড় দু’টি জোটের মধ্যেও বিভিন্ন রকমের সমীকরণ আছে। সরকারি জোটের অভ্যন্তরে সমীকরণ সহজতর এবং ম্যানেজ করাও সহজ। সরকারের প্রধান প্রতিপ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মধ্যে সমীকরণ তুলনামূলকভাবে কঠিনতর। ২০ দলীয় জোটের মধ্যে, এই জোটের প্রধান শরিক বিএনপিই প্রধান নীতিনির্ধারক, বিএনপিই প্রধান অনুঘটক, বিএনপিই প্রধান সমন্বয়ক, বিএনপিই সরকারি নিপীড়নের প্রধান টার্গেট, বিএনপিই প্রধান বৈরিতা মোকাবেলাকারী এবং বিএনপিই রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পুরোধা সংগ্রামী দল। এ কথা বলা সত্ত্বেও বলতেই হবে যে, প্রত্যেকটি বিশেষণ যেগুলো এইমাত্র উচ্চারিত, সেগুলো যৎকিঞ্চিৎ হলেও অন্যান্য শরিক দলের জন্যও প্রযোজ্য। যে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোট এই মুহূর্তে মোকাবেলা করছে, এরূপ চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের ৪৬ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট মোকাবেলা করেছে কি না সন্দেহ। পরের অনুচ্ছেদে যথাসম্ভব নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখ করছি; বিস্তারিত আলোচনা মোটেই নয়।
সাম্প্রতিক ৮টি চ্যালেঞ্জ
প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো- দলটির চেয়ারপারসন তথা জোটের শীর্ষতম নেত্রী প্রসঙ্গে। তিনি কারাগারে অন্তরীণ; তার সাথে সামাজিক দেখা-সাক্ষাৎ এক-আধটু সম্ভব হলেও রাজনৈতিক সাক্ষাৎ প্রায়ই অসম্ভব; অতএব চেয়ারপারসনের কাছ থেকে প্রত্যভাবে দিকনির্দেশনা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রসঙ্গে। তিনি বিদেশে বাধ্যতামূলকভাবে অবস্থানরত; বাংলাদেশে তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ একান্তই টেলিফোন বা বিবিধ প্রকারের বার্তানির্ভর, অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফরকারী ঘনিষ্ঠজনদের মাধ্যমে; সরকার তার নির্দোষ যোগাযোগগুলোতেও বাধা সৃষ্টি করেই চলেছে; অতএব ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকেও দলের জন্য আদেশ-নির্দেশ প্রাপ্তি কষ্টকর ও সময়সাপে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো স্ট্যান্ডিং কমিটি প্রসঙ্গে। ২০ দলীয় জোটের হৃৎপিণ্ড হলো বিএনপি এবং বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের শীর্ষতম কমিটির নাম হলো স্থায়ী কমিটি বা স্ট্যান্ডিং কমিটি; সেই স্ট্যান্ডিং কমিটির ১৯ জন সদস্যের মধ্যে আদি থেকেই দু’টি পদ শূন্য; পদাধিকারীদের মধ্যে চেয়ারপারসন কারাগারে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদেশে, জনাব সালাহউদ্দীন বিদেশে; অন্যদের মধ্য থেকে অসুখ-বিসুখ বা সুবিধা-অসুবিধা সব কিছু যোগ-বিয়োগ করে সক্রিয় নেতৃত্ব দেয়ার জন্য মজুদ আছেন ১২ জন (মতান্তরে আটজন)। অতএব নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের শীর্ষ স্থানটি ক্ষুদ্রাকৃতির সমতল হয়েছে। চতুর্থ চ্যালেঞ্জ বিএনপির নেতাকর্মী প্রসঙ্গে। ২০ দলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি এবং অন্যতম উল্লেখযোগ্য শরিক হলো জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি ও জামায়াতের কয়েক লাখ নেতাকর্মী প্রসঙ্গে, সরকারি উদ্যোগে লাখ লাখ মামলা দেয়া হয়েছে। ওইসব মামলা থেকে জামিন নিতে অথবা মামলার গ্রেফতার থেকে বেঁচে থাকতে নেতাকর্মীদের দিবানিশি পরিশ্রম করতে হয়, ঘরবাড়ি ছেড়ে মুসাফির হতে হয় এবং ভিটাবাড়ি বা ব্যবসা বিক্রি করতে হয়। এরূপ প্রোপটে নেতাকর্মীরা, নতুন মামলার আতঙ্ক থেকে মুক্ত বা গ্রেফতার হওয়ার আতঙ্ক থেকে মুক্ত হতে পারছেন না। পঞ্চম চ্যালেঞ্জ হলো ২০ দলীয় জোট নিয়ে। গত সপ্তাহের কলামে এ প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম কিন্তু মতামত দিইনি বা বিস্তারিত আলোচনা করিনি। চেয়ারপারসন বেগম জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ও আগ্রহে সৃষ্টি হওয়া এবং মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের সহযোগিতায় লালিত পালিত ও সক্রিয় হওয়া, ২০ দলীয় জোট যেমনটি আছে তেমনটি থাকবে নাকি ছোট করা হবে নাকি বর্ধিত করা হবে, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ; লণ হচ্ছে বর্ধিত করার। ২০ দলীয় জোটের ২০টি শরিকের মধ্যে ৯টি বা ১০টি শরিক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, অন্য ১০টি বা ১১টি শরিক অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি অতীতের সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং কয়েকটি অভিজ্ঞতাবিহীন। একাধিক বৈশিষ্ট্যের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনে সংসদীয় আসন বরাদ্দ প্রসঙ্গে চাহিদা বা অনুরোধ বা দাবি বা আবদার কিছুটা ভিন্ন হতে বাধ্য; সেই ভিন্নতাকে কী নিয়মে একোমোডেইট করা হবে, এটাই একটি চ্যালেঞ্জ। ষষ্ঠ চ্যালেঞ্জ হলো জোটগতভাবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন মোকাবেলা করা; নির্বাচনী প্রচারে জোটের সর্বশক্তি সেখানে নিয়োগ করা এবং সাফল্য আনা তথা সাফল্য আনতে না পারলেও সম্ভাব্য পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। সপ্তম এবং এই মুহূর্তে উল্লেখের জন্য যোগ্য শেষ চ্যালেঞ্জ হলো, মতাসীন রাজনৈতিক সরকার বা মতাসীন রাজনৈতিক জোটের পক্ষ থেকে বিএনপি বা ২০ দলীয় জোটকে ভাঙার নিমিত্তে বা দুর্বল করার নিমিত্তে পরিচালিত সম্ভাব্য নীরব আগ্রাসন মোকাবেলা করা তথা দল ও জোটের ঐক্য সুরতি রাখা। প্রধান শরিক বিএনপি এ প্রসঙ্গে সচেতন এবং অন্য শরিকেরাও জোটের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় এই পর্যন্ত উত্তীর্ণ। তার পরেও বলতে হয়, এই অনুচ্ছেদে উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলোকে আলাদা আলাদা করে মোকাবেলা করা মুশকিল। কারণ একটির সাথে আরেকটি সম্পৃক্ত।
ভালনারেবিলিটি বা ভঙ্গুরতা (বা ভেদ্য বা জেয়)
পাহাড়ি অঞ্চলে খাড়া রাস্তা অনুসরণ করে গাড়ি ওঠার সময় গাড়ির ইঞ্জিনের ওপর চাপ পড়ে; গাড়ি দুর্ঘটনাক্রমে রাস্তার খাদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে; ইঞ্জিন যদি দুর্বল হয় বা ড্রাইভার যদি অপরিপক্ব হয় তাহলে বিপদ একদম কাছেই ঘুরঘুর করে; এটা হলো গাড়ির ভালনারেবিলিটি। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে এবং মার্চ মাসে শিশুরা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয় বেশি; কারণ তখন ঠাণ্ডা কমছে গরম আসছে; শিশুদের শরীরের প্রতিরা মতা যেহেতু কম, সেহেতু তারা হঠাৎ ঠাণ্ডা বা গরমের আক্রমণে কাবু হয়ে যায়; এটা হলো শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ভালনারেবিলিটি। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমানকে অপহরণ করা হয়েছিল ২৫ আগস্ট ২০১৭ রাত ১০টার পর কোনো একসময়। সেই সময় বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির অন্য নেতারা অপহরণ বা গুম আতঙ্কের শিকার ছিলেন তথা পার্টি ভালনারেবল ছিল। আমিনুর রহমান অপহরণ হওয়ার পর অন্যান্য ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু নেতাও অপহরণ আতঙ্কে ভুগেছিলেন অর্থাৎ তারা ভালনারেবল ছিলেন। ভালনারেবল শব্দটি ইংরেজি, কিন্তু হুবহু বাংলা অর্থ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয় এবং সেই বাংলা শব্দটি ওই অনুভূতি প্রকাশ করে না যেটা আমি প্রকাশ করতে চাচ্ছি। এই মুহূর্তে বিএনপি বা ২০ দলীয় জোট কিছু কিছু আঙ্গিকে ভালনারেবল, আমি সেটাই বোঝাতে চাচ্ছি। অতএব সাবধানতা বা সচেতনতা প্রয়োজন।
আন্দোলনের ব্যাপ্তি
আন্দোলনের মাধ্যমে দেশনেত্রীকে কারামুক্ত করা হবে নাকি আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে কারামুক্ত করা হবে, নাকি উভয় প্রোগ্রামের মাধ্যমে কারামুক্ত করা হবে, এটি একটি সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে এই মুহূর্ত পর্যন্ত সর্বজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত হলো : আন্দোলনের মাধ্যমেই মুক্ত করা হবে। এক দিকে তৃণমূলের আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রাখা প্রয়োজন, অপর দিকে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ল্যবস্তুকে সামনে রাখা প্রয়োজন; এবং উভয়ের সমন্বয়েই দলীয় বা জোটগত কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন। পার্লামেন্টে বসা এবং বসার পর পার্লামেন্টারি রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে দেশনেত্রীকে মুক্ত করা; এটাও কোনো কৌশল কি না বা কৌশল হতে পারে কি না সেটাও কিছুসংখ্যকের মতে একটা আলোচনাযোগ্য বিষয়; যদিও আমার ব্যক্তিগত সম্মতি নেই। সাথে সাথে এটাও উল্লেখযোগ্য এবং অনুধাবনযোগ্য যে, যদি আইনি লড়াই ও আন্দোলন উভয় প্রক্রিয়ায় দেশনেত্রীকে মুক্ত করা না যায় তখন কী করা হবে? ২০ দলীয় জোটের তথা প্রধান শরিকের কোটি কোটি ভক্ত ও সমর্থক এবং লাখ লাখ কর্মীর মনের ভেতরের প্রশ্ন এইটি। যদিও প্রশ্নটি জনসমে উপস্থাপন করলাম, তথাপি এই প্রশ্নগুলোর প্রত্য উত্তর দেয়া প্রায় অসম্ভব ও অবাস্তব এবং রাজনীতির মাঠে এ রকম প্রত্য উত্তর আশা করাটাও অবাস্তব।
জোটগুলোর শক্তি-সামর্থ্যরে সূচক
রাজনীতির অঙ্গনে, রাজনৈতিক দলগুলোর শক্তি-সামর্থ্য মাপার জন্য অনেক সূচক আছে। যদিও সেগুলো, নিখুঁতভাবে স্বর্ণ মাপার মতো একুইরেট সূচক নয়। ওইরূপ সূচকগুলোর বিশ্লেষণে, ২০১৪ সালের আগে আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগের যেই সামর্থ্য ছিল, অনুরূপ শক্তি সামর্থ্য এখন আছে কি নেই, বা বেশি আছে না কম আছে, এটি আলোচনাযোগ্য বিষয়। অনুরূপভাবে ওই আমলের ১৮ দলীয় জোটের শক্তি-সামর্থ্যও, ওই আমলের তুলনায় এখনকার ২০ দলীয় জোটে কি বেশি না কম, সেটাও আলোচনাযোগ্য বিষয়। আলোচনা করা হবে কি হবে না এটা হলো সিদ্ধান্তের বিষয়। আওয়ামী লীগ বা মহাজোট প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেবেন আওয়ামী লীগ বা মহাজোটের নেতারা। ২০ দলীয় জোটের প্রসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেবেন বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের নেতারা। আলোচনা দুই প্রকার; যথা প্রকাশ্য এবং অপ্রাকাশ্য। অপ্রকাশ্য বলতে বোঝায় ঘরোয়া বা অভ্যন্তরীণ পরিবেশে মিডিয়ার নাগালের বাইরে। অতএব মহাজোট বা ২০ দলীয় জোট তাদের অতীতের সবলতা ও দুর্বলতা এবং বর্তমানের সবলতা ও দুর্বলতা আলোচনা করবে কি না এবং করলেও প্রকাশ্যে করবে না অপ্রকাশ্যে করবে, সেটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার। তবে এটাও বলে রাখি যে, এ ধরনের আত্মসমালোচনা প্রকাশ্যে কম করাই রেওয়াজ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ : উত্তর আফ্রিকা : ব্রিটিশ বাহিনীর ঘুরে দাঁড়ানোর প্রোপট
আমি যেহেতু সেনাবাহিনীতে ছিলাম, সে জন্য সামরিক ইতিহাস থেকে একটি উদাহরণ টানছি। পাঠক সম্প্রদায়ের বেশির ভাগই অ-সামরিক বা বে-সামরিক ব্যক্তি তথা সামরিক ইতিহাস বা যুদ্ধ-বিগ্রহের ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে পরিচিত নন। সে জন্য আমি এই অনুচ্ছেদটি যতটুকু সরলভাবে লেখা সম্ভব, তত টুকু সরলভাবেই লিখেছি। পাঠক এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত ঘটনা পড়ার পর, ঘটনা থেকে যদি কোনো শিা বা উপসংহার আবিষ্কার করেন তাহলে ওইগুলো, বাংলাদেশের এই মুহূর্তের রাজনৈতিক অঙ্গনের যেখানে উপযুক্ত মনে করেন সেখানে প্রয়োগ করতে পারেন। আমি খুবই সচেতন যে, রাজনীতির মাঠ প্রথাগত যুদ্ধত্রে নয়, কিন্তু যুদ্ধত্রে বটে; সে জন্যই উদাহরণটি দিচ্ছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যেই তিনটি দেশের জোট আগ্রাসী ভূমিকায় ছিল তারা হলো জার্মানি, ইতালি ও জাপান। জার্মানি প্রথম দুই বছরে জয় করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, তার সামনে তখন চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে নতুন করে জয় করা নয় বরং যা জয় করা হয়েছিল সেটাকে রা করা। আরেকটু খোলাসা করে বলি। যদি সম্ভব হয় পাঠক যেন ভূমধ্যসাগর (ইংরেজিতে মেডিটেরেনিয়ান সি)-এর উত্তরের এবং দক্ষিণের ভূখণ্ডটির মানচিত্র সামনে রাখেন অথবা কল্পনা করেন। ভূমধ্যসাগরের উত্তরে ইউরোপ, দক্ষিণে উত্তর আফ্রিকা। জার্মান বাহিনী উত্তর আফ্রিকার পশ্চিম দিক থেকে শুরু করেছিল তাদের আক্রমণ। তিউনেশিয়া দিয়ে শুরু করে লিবিয়া হয়ে ইজিপ্ট বা মিসরের সীমান্ত অতিক্রম করে মিসরের রাজধানী কায়রোর কাছাকাছি চলে এসেছিল। ওই সময় উত্তর অফ্রিকায় যুদ্ধরত ব্রিটিশ বাহিনী, জার্মানির আক্রমণের মুখে পিছু হটতে হটতে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল। লন্ডনে অবস্থিত বিলাতের বা ইংল্যান্ডের সরকার তখন চোখে-মুখে ধোঁয়া দেখছিলেন। লন্ডনে বসে প্রধানমন্ত্রী স্যার উইনস্টন চার্চিলের সর্বদলীয় সরকার যত বড় হুকুমই দিক না কেন, যত বেশি অস্ত্র, গোলাবারুদ বা দ্রব্যসামগ্রীই সরবরাহের বন্দোবস্ত করেন না কেন, সেগুলো ব্যবহার করে সরেজমিন জার্মান বাহিনীর মোকাবেলা করবে, ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী তথা সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকেরাই।
আমি যেই সময়ের কথা বলছি সেই সময় উত্তর আফ্রিকায় জার্মান বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল এরউইন রোমেল (পরে ফিল্ড মার্শাল রোমেল)। ওই সময় রোমেলের নাম শুনলেই, রণাঙ্গনের ব্রিটিশ সৈন্যগুলো হকচকিত হয়ে যেত। এরূপ বিপদগ্রস্ত ব্রিটিশ বাহিনীকে পুনরুজ্জীবিত করে জার্মান বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করার জরুরি প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই প্রয়োজনীয়তায় সবচেয়ে বড় উপাত্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়কত্ব তথা সেনাপতির গুণাবলি। ব্রিটিশ সরকার বিদ্যমান অধিনায়ককে পরিবর্তন করে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মন্টগোমারিকে অধিনায়ক নিযুক্ত করেছিল। ভগ্ন-মনোবলসম্পন্ন এবং হতাহতের বিশাল সংখ্যার কারণে দুর্বল আকৃতির উত্তর আফ্রিকায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর, মন্টগোমারি প্রথমে নিজে একটি আত্মসমালোচনা প্রস্তুত করেন তথা নিজেদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করেন; অতঃপর সহকর্মীদের মধ্যে যারা জ্যেষ্ঠ তাদের নিয়ে সেই আত্মসমালোচনাকে পরিপক্বতা দান করেন; অতঃপর শিা বা উপসংহারগুলো কাজে লাগান। অফিসার ও সৈনিকদের সামনে প্রথম বক্তৃতায় মন্টগোমারি ব্রিটিশ বাহিনীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন : ‘ব্রিটিশ বাহিনী এই অবস্থান থেকে আর এক পা-ও পিছে যাবে না; আমি ব্রিটিশ বাহিনীকে পিছে যাওয়ার জন্য আদেশ দিতে এখানে আসিনি; যত বড় কৌশলগত প্রয়োজনই হোক না কেন, আমি কোনো প্রকারের কৌশলগত পশ্চাৎপসরণের জন্য আদেশ দেবো না; আমার আদেশ হলো এখানেই যুদ্ধ করে এখানেই প্রাণ দেবো; হয় আমাদের মৃত দেহের ওপর দিয়ে শত্রু এগিয়ে যাবে অথবা শত্রুর মৃতদেহের ওপর দিয়ে আমরা এখান থেকেই সামনের দিকে পা বাড়াব।’ বলে রাখা ভালো, মন্টগোমারি ধর্মীয় বিশ্বাসে খ্রিষ্টান ছিলেন এবং আচরণে ও নৈতিকতায় নিবেদিতপ্রাণ খ্রিষ্টান ছিলেন। তিনি প্রত্যেক রাতেই বাইবেল পড়তেন। ইতিহাস স্যা দেয়, মন্টগোমারির নেতৃত্বেই ব্রিটিশ বাহিনী ঘুরে দাঁড়িয়েছিল এবং জার্মানদের হাত থেকে উত্তর আফ্রিকা পুনরায় জয় করে নিয়েছিল। ইতিহাসে মন্টগোমারির পরিচয় হলো ফিল্ড মার্শাল ভাইকাউন্ট মন্টগোমারি অফ এল-আলামিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন। একই প্রকারের ঘটনা ছিল, জাপানি আক্রমণের মুখে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিপর্যয়, দণি-পূর্ব এশিয়ায়। সেখানে বিপর্যস্ত ব্রিটিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন তৎকালীন লেফটেন্যান্ট জেনারেল উইলিয়াস স্লিম (পরে ফিন্ড মার্শাল স্লিম)। দণি-পূর্ব এশিয়া তথা বার্মা ফ্রন্টেও একই ধরনের শিা ও উপসংহার উদ্ভাসিত হয়েছিল।
লেখক : মেজর জেনারেল (অব.); চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন