অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশ বিগত চার দশকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অনেক ঐতিহাসিক অর্জন বাংলাদেশের সুকীর্তির ভাণ্ডারে সঞ্চিত হয়েছে। যে একুশে ফেব্রুয়ারি এ জাতির আকাশছোঁয়া শহীদ মিনারের জন্ম দিয়েছে, আমাদের সেই অর্জন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বসভ্যতার এক গৌরবজনক অধ্যায়ে রূপান্তরিত হয়েছে। সঙ্ঘবদ্ধ জনসমষ্টি হিসেবে এই জনপদে আমাদের বসবাস প্রায় চার কী সাড়ে চার হাজার বছরের। বাস করেছি পরাধীন, বঞ্চিত, অবহেলিত, নির্যাতিত ব্রাত্যজন হিসেবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জনপদের চার দিকে নিজেদের নির্মল রক্ত ঝরিয়ে সৃষ্টি করেছি স্বশাসনের অধিকার, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এখনকার মহামন্দার কালে যখন বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে ছটফট করছে তখনো আমাদের সন্তানেরা, হোক অশিক্ষিত অথবা আধাশিক্ষিত, প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ লাখ, বিশ্বের ১৭০টি রাষ্ট্রে নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বাংলাদেশে সেই মহামন্দার উত্তাল তরঙ্গের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে অনতিক্রম্য দেয়াল হিসেবে। তাই তো কথায় কথায় বলি- বাংলাদেশ হলো এক অমিত সম্ভাবনার দেশ। এখানকার উর্বরতম মাটিতে যেখানে বছরে তিনটি ফসল ফলে অনায়াসে। এখানকার নদ-নদী, হাওর-বাঁওড় কারো রোমশ নিষ্ঠুর হাতে যদি প্রাণ না হারায় তাহলে একটু পরিচর্যায় রূপান্তরিত হতে পারে স্বর্ণখনিতে। মাটির নিচে যে সম্পদ লুকিয়ে রয়েছে তা-ও অকিঞ্চিৎকর নয়। মাটির ওপর বসবাসকারী মানুষেরা মানব উপাদান হিসেবে কারো থেকে কোনোভাবে ন্যূন নয়। এ দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যারা সন্দিহান তাদের করুণা করি।
তবে কিছু সমস্যা রয়েছে এবং এই সমস্যাগুলোর বেশির ভাগই রাজনৈতিক। এগুলোর সমাধান হওয়া অত্যন্ত জরুরি। স্বশাসন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে এ জাতি, কিন্তু স্বশাসনকে সবার জন্য অর্থপূর্ণ করার জন্য যা অপরিহার্য অর্থাৎ সুশাসন তার আশীর্বাদ এ জাতি এখনো লাভ করেনি। সুশাসন এবং গণতন্ত্র কিন্তু হাত ধরাধরি করে চলে। একটি পিছিয়ে পড়লে অন্যটি তাকে সহায়তার হাত বাড়ায়।
১. বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। প্রথম, রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংগঠিত হতে হবে। বিভিন্ন পর্যায়ে দলের নেতৃত্ব সুনির্দিষ্ট হতে হবে দলীয় নেতাকর্মীর রায়ে, নির্বাচনের মাধ্যমে। বর্তমানে তা হচ্ছে না। দু-একটি দল ছাড়া প্রায় সর্বক্ষেত্রে দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতানেত্রী উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে যারা রয়েছেন তারা শীর্ষ নেতার মনোনীত। উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে এমনটি দেখা যায় না। দ্বিতীয়, গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করতে হলে দলীয় নেতাকর্মীর মন-মানসকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিসমৃদ্ধ হতে হবে। সহিষ্ণুতা এবং সমঝোতার মানসিকতা এ ক্ষেত্রে মণিকাঞ্চনস্বরূপ। উন্নত গণতান্ত্রিক সমাজে নেতা হলেন একজন আপসকামী, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণকারী, যোগাযোগে দক্ষ, অগ্রবর্তী ভাবনায় উদ্দীপ্ত, জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন কর্মকর্তা। বাংলাদেশে কিন্তু নেতা হলেন পরম পরাক্রমশালী দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, সব কিছুতে চূড়ান্ত রায় দানকারী, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, নির্জন প্রকোষ্ঠে বসবাসকারী, মহামহিম আদেশ দানকারী শ্রদ্ধেয় এক মহান কর্মকর্তা। এই অবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। তৃতীয়, গণতন্ত্র হলো নিয়মতান্ত্রিক সীমিত সরকার আর সংসদীয় গণতন্ত্র মূলত দ্বি-দলীয় কাঠামোর (Bi-partisan) সংগঠিত সরকার। এই ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রযুক্ত হয় আইনি কাঠামোয়, ব্যক্তির নির্দেশে নয়, ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছায় তো নয়ই। তাই এখানে হিংসা-প্রতিহিংসার কোনো জায়গা নেই। চতুর্থ, আইনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। সাথে সাথে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগের জন্য একরাশি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। পঞ্চম, গণতন্ত্রে যেহেতু ব্যক্তিগত ক্ষমতা (Personalized) প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই, তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃত্বব্যঞ্জক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন সরকারি কর্মকর্তাদের মেধা, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগদান, দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে নয়। ষষ্ঠ, গণতন্ত্র একটি পরিপূর্ণ প্রত্যয়, আংশিক কোনো প্রত্যয় নয়। তাই গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করতে হলে শুধু কেন্দ্রে অথবা শুধু প্রান্তে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় এর প্রয়োগ হলে চলবে না। সমগ্র সমাজ, কেন্দ্র ও প্রান্ত মিলিয়ে গণতন্ত্রের প্রসার ঘটাতে হবে। অন্য কথায়, কেন্দ্রে তো বটেই, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকেও গণতান্ত্রিক এবং শক্তিশালী করতে হবে।
২. বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছিল ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে। এবারে আরো শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। সরকারও জানে, জানে রাষ্ট্র বিষয়ে চিন্তা ভাবনাকারীরাও যে, নির্বাচিত হলেই সরকার গণতান্ত্রিক হয় না। নির্বাচন হলো কোনো জনসমাজকে গণতন্ত্রের মহাসড়কে টেনে নেয়ার প্রকৃষ্ট মাধ্যম। নির্বাচিত সরকার গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে। এক, এ জন্য প্রয়োজন হয় দেশে আইনের রাজত্ব সংগঠন করা। দুই, দেশব্যাপী নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ের সংগঠনকে প্রাণবন্ত করা। তিন, জনগণের অধিকার সংরক্ষণের সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। চার, এই লক্ষ্যে অধিকার সংরক্ষণের জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান দেশে তৈরি হয়েছে তাদের শক্তিশালী করে কর্তৃত্বব্যঞ্জক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা এবং সর্বাগ্রে দেশে সুশাসনের প্রয়োগ ঘটানো। পাঁচ, বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে দক্ষ, অভিজ্ঞ, মেধাবী এবং পেশাদারী কর্মকর্তা সমন্বয়ে সংগঠিত করতে হবে। সরকারের অনুগত ব্যক্তি অথবা দলীয় সংগঠনের নেতানেত্রী সমন্বয়ে নয়। ছয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলীয় কর্মীদের সংশ্লিষ্ট করে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা বিষাক্ত রাজনীতির জন্ম দেবে এবং কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের মান ভীষণভাবে অবনত হবে। সাত, র্যাব (RAB)-এর মতো এলিট বাহিনীকে কার্যকর করার পথে তাদের নিয়োগ, পদায়ন, প্রমোশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে দলীয় নীতি হবে বিষবৎ। আট, নির্বাচন কমিশনে ও অন্যান্য সাংবিধানিক সংস্থার ক্ষেত্রেও দলীয় মানসিকতা পরিহার করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। তা ছাড়া দেশের যেসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় সংস্থা রয়েছে তাদের কার্যকর করা। গণতান্ত্রিক সমাজে জনপ্রতিনিধি সমন্বয়ে যেসব সংস্থা সংগঠিত রয়েছে তাদের কার্যকর ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় সংসদ কার্যকর হলে সংসদের কমিটিগুলো দেশের প্রশাসন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতে বাধ্য করতে পারে।
উল্লিখিত কমিটিগুলো দেশের প্রশাসন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে পারে। উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো গৃহীত হলে এবং যে সমাজে আমরা বাস করি সেই সমাজটিকে আলোকিত করতে পারলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত অনেকটা প্রান্তিক বাংলাদেশ শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হবো। এ জন্য চাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি, সুদূরপ্রসারী এক Vision। চাই জাতীয় ঐক্য। চাই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভিসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন