বাংলাদেশে কেন গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ জমে? কেন গণতন্ত্রের যাত্রাপথ এত কণ্টকাকীর্ণ? এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব কঠিন এবং বিস্তারিত উত্তর দেয়ার অভিপ্রায়ে এ ছোট লেখাটি রচিত নয়। এ সম্পর্কে শুধু কিছুটা আলোকপাত করাই এর লক্ষ্য। যে এলাকা আজ বাংলাদেশরূপে চিহ্নিত, ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তা ছিল কলকাতা মহানগরীর পশ্চাৎভূমি। কলকাতার চার পাশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কৃষিজাত কাঁচামাল এবং কলকাতার নাগরিকদের খাদ্যপণ্য সরবরাহ করাই ছিল এ অঞ্চলের ‘দায়িত্ব’। এখানে গড়ে ওঠেনি উল্লেখযোগ্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গড়ে ওঠেনি গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যবসায়ী শ্রেণী। ব্যবসায়ীদের প্রায় সবাই ছিল বাইরের, হিন্দু মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের। পাশ্চাত্যে যখন সামন্তবাদের সমাপ্তি ঘটে, তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে নতুনভাবে এক সামন্ত শ্রেণী সৃষ্টি করে ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এটা করা হয় নিজেদের প্রভুত্ব স্থায়ী করার লক্ষ্যে, অনেকটা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি অনুসরণ করে। এ কারণে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টি মুসলমান হলেও সামন্ত জমিদারদের বেশির ভাগ ছিলেন অমুসলিম।
এ অঞ্চলের বেশির ভাগ বাসিন্দার শিক্ষা-দীক্ষার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না তাদের সরকারি কার্যালয়ে কোনো চাকরি। ব্যবসা-বাণিজ্যে ছিল না তেমন কোনো ভূমিকা। কৃষি ছিল তাদের জীবিকার মাধ্যম। এমনই এক পরিস্থিতিতে এ অঞ্চলে দেখা দেয় আধিপত্য-অধীনতাসূচক এক সামাজিক সম্পর্ক, যা অর্থনৈতিক ডিসিপ্লিনে প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট বা পোষক-আশ্রিত সম্পর্করূপে চিহ্নিত। কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক জনপদে এ সম্পর্ক অত্যন্ত স্বাভাবিক। অভাব-অনটনের সময়ে, অনাবৃষ্টি-অতিবৃষ্টি, বন্যায় দুর্দৈবকালে, মহামারী-মন্বন্তরের নির্মম মুহূর্তগুলোয় কৃষকদের প্রয়োজন হয় পোষকের, যিনি অর্থ দিয়ে দরিদ্র কৃষকদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করে, উৎপাদিত পণ্যের বিনিময়ে দাদন দিয়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেন। কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে পারেন। পোষকরা এসব মুহূর্তে এগিয়ে আসেন। কেননা, তাদেরও প্রয়োজন কিছু আশ্রিত, যারা তাদের শর্তহীন আনুগত্য প্রদর্শন করে, সময়ে-অসময়ে হাতে লাঠি ধরে এবং পোষকের কাছ থেকে যে সহায়তা তারা লাভ করেছে, তা হাজার গুণে পুষিয়ে দিয়ে পোষকের হাতকে শক্তিশালী করে তোলে। কোনো সময়ে আশ্রিতদের কেউ কোনো অপরাধ করলেও আনুগত্যের বিনিময়ে পোষক তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন। এ সম্পর্ক গ্রামাঞ্চলে অনেকটা স্থায়ী।
দ্রুত পরিবর্তনহীন বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে আধিপত্য-আনুগত্যের এ সম্পর্ক ক্রমে বিস্তৃত হয়ে জাতীয় সমাজকে গ্রাস করেছে। গত শতকের মধ্যভাগে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে জমিদারি উচ্ছেদ হলে, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিছুসংখ্যকের শিক্ষাগ্রহণ, এমনকি হিন্দু মহাজন ও মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের দেশত্যাগের পর এ অঞ্চলে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হলেও এ সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ছেদ পড়েনি, বরং এককালের ভূমিমালিকদের অবস্থান গ্রহণ করেছেন আধুনিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত কিছু পেশাজীবী, নব্য ধনিক শ্রেণীর কিছু প্রতিনিধি, শিল্পপতি, বণিক, কিছু রাজনীতিক এবং উচ্চপদের কিছু সরকারি কর্মকর্তা। সাধারণ মানুষের কিছু প্রয়োজন হলে তারাই তা দিতে পারেন। আকালে তারাই কিছু করতে পারেন। আশ্রিত সাধারণ মানুষের মনে এ ধারণা দিতে পোষকের ভূমিকায় তারা অবতীর্ণ হয়েছেন। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষমতার দণ্ডধারীদের অনুগ্রহপুষ্ট হয়ে, দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় কর্মরত উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন স্তরে বিন্যস্ত হয়ে প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
এক অর্থে, রাজনৈতিক দলেও এ সম্পর্কের সুস্পষ্ট অভিব্যক্তি। দলের শীর্ষনেতা, দলের নি¤œস্তরের নেতাকর্মীদের পোষক। দলের নি¤œস্তরের নেতাকর্মীরা সেই পোষকের আশ্রিত। পোষকের সাথে তাদের সম্পর্ক অনেকটা আধিপত্য-আনুগত্যের। দলীয় নেতাদের দিকে দৃষ্টি দিন, তাদের কাজকর্ম ও আচার-আচরণ বিশ্লেষণ করুন, এমনকি নির্বাচনের সময় তাদের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার পর্যালোচনা করুন, সিদ্ধান্ত আপনার। জাতীয় স্বার্থে কোথায় রাস্তাঘাট বা ব্রিজ-কালভার্ট বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মিত হওয়া উচিত, তা না করে সাধারণ মানুষের ভোট পাওয়ার জন্য তারা তাদের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নের কথা বলেন; তাদের রাস্তাঘাট তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা নির্মাণের। ওই সব স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা থেকে পাস করা তরুণ-তরুণীদের চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আকাল বা মঙ্গা দেখা দিলে খাদ্যের বিনিময়ে কর্মকাণ্ডের কথা বলেন। শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আশ্রিতদের কথার প্রতিধ্বনি করেন। আশ্রিতদের কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে শীর্ষ নেতারা চোখ বন্ধ করে থাকেন। সঙ্ঘাত-সন্ত্রাস-অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও তারা চুপ থাকেন, যদি সেই সন্ত্রাসী বা অপরাধীরা দলকে ক্ষমতাসীন করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সহজ কথায়, পোষক চান ক্ষমতার দণ্ড। আশ্রিতরা তাদের শর্তহীন আনুগত্যের মাধ্যমে সেই পথ সহজ করে তোলে। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের দলীয়করণ আর পক্ষপাতিত্বের নীতির মূলে রয়েছে পোষক-আশ্রিত সম্পর্কের অশুভ প্রভাব।
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এবং এটাও কোনো মহলের বিনা প্রতিবাদে, তারও মূল নিহিত রয়েছে এই সম্পর্কের অভ্যন্তরে। আইনের প্রাধান্যের পরিবর্তে ব্যক্তির আধিপত্যের মূলেও রয়েছে এটি। এই পরিপ্রেক্ষিতে জবাবদিহিতা অর্থহীন। অর্থহীন নীতিমালা ও কার্যক্রমের স্বচ্ছতাও। পাশ্চাত্যেও পোষক-আশ্রিত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল দীর্ঘ দিন; প্রায় হাজার বছরের মতো। ভূমির সাথে ভূমিতে বসবাসকারীরাও ছিল সামন্ত প্রভুর দখলে। সেই সমাজব্যবস্থায় ছিল না সাম্যের চেতনা। ছিল না স্বাধীনতা-স্বাতন্ত্র্যের কোনো অনুরণন। ছিল না সৌভ্রাতৃত্বের বিন্দুমাত্রও। ছিল শুধু পোষকের আধিপত্য; আর ছিল নীরবে সেই নির্দেশ পালন করার মানুষজন। সেই কর্কশ বালুরাশিতে গণতন্ত্রের চিহ্নহ্নহ্নমাত্র ছিল না।
সেই পাশ্চাত্যে আজ গণতন্ত্রের সোনালি ফসলের পরিপূর্ণ গোলা। এটি সম্ভব হয়েছে দীর্ঘকালীন পরিসরে সামাজিক জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে। তেরো শতক থেকে পনেরো শতক সময়কালে রেনেসাঁর প্রাণবন্যায় অবগাহন করে সমগ্র ইউরোপ নতুনভাবে উজ্জীবিত হয় আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদার মহান মন্ত্রে। তার সম্মতি ছাড়া কাউকে শাসন করার কোনো অধিকার নেই কারো- এই দীক্ষা লাভ করে নতুনভাবে। রিফরমেশনের ফলে ভিন্নমত ও পথের অনুসারীরা পারস্পরিক সহনশীলতার স্বর্ণসূত্রে আবদ্ধ হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম, ব্রিটেনের গৌরবময় বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লবের মতো ঐতিহাসিক গণ-আন্দোলনের সাফল্যে জনগণের মনে এই প্রতীতি দৃঢ় হয় যে, সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যই মুখ্য। এভাবে পাশ্চাত্য প্রবেশ করে ‘আলোকিত যুগে’ নতুন আত্মবিশ্বাস, নতুন আত্মমর্যাদা এবং নতুন মর্যাদাবোধ নিয়ে। শিল্প বিপ্লবের ফলে নতুন নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি হয়, যারা শুধু শাসনব্যবস্থায় অংশ নেয়ার দাবিতে অটল থাকল না, সাথে সাথে সাংগঠনিক দক্ষতার ডালাও সাজিয়ে আনল। আবেগের পরিবর্তে যুক্তিকে প্রাধান্য দিয়ে, ভূখণ্ডের সাথে একাত্মতা প্রতিষ্ঠা করে, এক ধরনের জাতীয়তাবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, জনগণের সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে নতুন যুগে। এই প্রেক্ষাপটেই গণতন্ত্রের বিকাশ অপরিহার্য হয়ে ওঠে ইউরোপ, তথা পাশ্চাত্যে। বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন। হাজারো বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ হয়ে পাশ্চাত্য যেভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে একের পর এক ধাপ অতিক্রম করে, আধুনিকতার আলোতে সমুজ্জ্বল হয়েছে, বাংলাদেশের তেমন সুযোগ হয়নি। যে রেনেসাঁ পুরো ইউরোপের শিল্পকলা-সংস্কৃতি সাহিত্যের নব নব দিগন্ত উন্মোচন করেছে; সাধারণ মানুষের মনে প্রচণ্ড আত্মশক্তির বিকাশ ঘটিয়েছে এবং মানুষকে প্রখর আত্মমর্যাদার রঙে রাঙিয়েছে, বাংলাদেশে তেমন কিছু ঘটেনি। বহু ধর্মের দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে মতাদর্শ পর্যায়ে পারস্পরিক সহনশীলতা উদ্রেককারী কোনো ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি, বরং ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়। দীর্ঘ দিনের পরাধীনতার অমানিশার সমাপ্তিপর্বে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে, স্বাধীনতা লাভের উচ্ছ্বাস কাটতে না কাটতেই বিভিন্ন জনপদে সাধারণ মানুষ ক্লিষ্ট হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়।
তা সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রমণ্ডলে বাংলাদেশ একটা ব্যতিক্রমধর্মী দেশ। ১৭৭৬ সালের আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের মতো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে। জননেতারা ছাড়াও বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিল সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ। তারও আগে ঘটেছিল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। ফরাসি বিপ্লবের সাথে এর তুলনা চলে না বটে, কিন্তু গণমানুষের বিপুল অংশগ্রহণের ফলে সেই গণ-অভ্যুত্থানে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। ওই গণ-অভ্যুত্থানসহ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জনগণের অংশগ্রহণের প্রকৃতি ছিল একটু ভিন্ন। ওই সব বিপ্লবাত্মক আন্দোলনে বাংলাদেশের জনগণ অংশ নেয় পাকিস্তানি শাসকদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, তাদের নির্মমতাকে প্রত্যাঘাত করতে, ক্ষমতাদর্পী শাসকদের দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূলক প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপন করতে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাকিস্তানি শাসকদের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, ক্ষমতাশ্রয়ী, ঔপনিবেশিক নীতি ও কার্যক্রম। এর লক্ষ্য ছিল চিহ্নিত শত্রুকে দেশ থেকে বিতাড়ন করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনতা অর্জনের পর কিভাবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে কার্যকর করা হবে, সে লক্ষ্যে কোনো সচেতন বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন হবে, কিভাবে শাসকদের সঠিক পথে পরিচালনা করতে হবে, অধিকার সংরক্ষণের জন্য কোন লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গি সহায়ক হবে, এ সম্পর্কে সচেতনতার পাঠ তাদের সম্পূর্ণ হয়নি। তা ছাড়া দেশের অনিশ্চিত অর্থনীতিও তাদের সে পাঠ গ্রহণে সহায়তা করেনি, বরং স্বাধীনতার পর এক দিকে যেমন গণমানুষের প্রত্যাশ্যা ও আকাক্সক্ষা আকাশচুম্বী হয়েছিল, অন্য দিকে তেমনি দুর্বল অর্থনীতি তাদের ক্ষমতাধরদের আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। জনসাধারণ নেতাকর্মীদের মুখাপেক্ষী হয়ে যতটুকু সম্ভব সুযোগ গ্রহণ করেছেন। নেতাকর্মীরা শীর্ষ নেতাদের বশংবদ হয়ে সুযোগ গ্রহণ করেছেন। নেতার ব্যর্থতা প্রকট হয়ে উঠলেও তারা মুখ বন্ধ রেখেছে। প্রতিবাদ করার সাহস হারিয়েছে, বরং ছোট নেতারা বড় নেতাদের অনুগত থেকে যা কিছু অর্জন করার, তা করেছে। এ অবস্থা আর যা-ই হোক গণতন্ত্রের জন্য কোনোক্রমেই সহায়ক হয়নি।
এ দুরবস্থা থেকে মুক্তির পথ তো বেশি নেই। তবে সবচেয়ে সহজ ও সরল পথ হলোÑ বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার ব্যাপক বিস্তৃতি। যদি জনগণ একবার বিশ্বাস করে, তাদের সম্মতি ছাড়া তাদের শাসন করার কারো অধিকার নেই; তাদের সম্মতি ছাড়া তাদের ওপর কর ধার্য করার অধিকার কারো নেই; তাদের ভোট তারাই দেবে, যাকে খুশি তাকে দেবে; তা হলেই গণতন্ত্রের প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়। জনগণের মনে যদি এই বিশ্বাস একবার দৃঢ় হয় যে, সব রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস তারাই এবং এই ক্ষমতা তাদের কল্যাণেই শুধু ব্যবহৃত হবে, অন্য কারো জন্য নয়; তা হলেই গণতন্ত্রের ক্ষেত্র উর্বর হয়ে উঠবে।
কিন্তু এককভাবে কোনো ব্যক্তির পক্ষে আধুনিক গণতন্ত্রে কোনো ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। সামাজিক সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই তা সম্ভব। অন্য কথায়, রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামো, কার্যক্রম ও প্রক্রিয়া পরিবেশ সর্বাগ্রে গণতান্ত্রিক হওয়া একান্ত প্রয়োজন। গণতান্ত্রিকব্যবস্থা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাথে এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এক দিনে সৃষ্টি হয় না। হয় না এক যুগেও। দীর্ঘ দিনের নিরলস প্রচেষ্টায় তা সম্ভব হয়। সম্ভব হয় সচেতনভাবে সংগঠিত সৃজনশীল এক সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। তা ছাড়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দায়িত্বশীলতা, আপসকামিতা ও জবাবদিহিতার বিকাশ অবশ্য প্রয়োজনীয়। পাশ্চাত্যে শুধু জনগণের শিক্ষা ও সচেতনতার ওপর জোর দেয়া হয়। আমাদের দেশে এক দিকে যেমন প্রয়োজন জনগণের শিক্ষা ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি, অন্য দিকে তেমনি প্রয়োজন নেতা-নেত্রীর দায়িত্বশীলতা এবং তাদের সৃজনশীলতা।
সামন্ত যুগের মন দিয়ে গণতান্ত্রিক যুগের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কাঠামো তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সেই কাঠামোয় প্রাণের সঞ্চার এখনো হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের কর্তৃত্ববাদী মনের উত্তাপে গণতন্ত্রের কাঠামোগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে শুষ্ক, বিবর্ণ কাষ্ঠখণ্ডের মতো।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন