|
মিনার রশীদ
minarrashid@yahoo.com |
|
‘চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে’
22 March 2016, Tuesday
সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান রবীন্দ্রভক্ত মানুষ। তিনি রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক ভাবনা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার ভক্তের শেষ পরিণতি নিয়ে একটি চমৎকার গীতিনাট্য লিখে গেছেন। এর কিছু অংশ নিম্নরূপ :
প্রহরী।
চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে,
চোর চাই যে ক’রেই হোক।
নহিলে মোদের যাবে মান ॥
শ্যামা।
নির্দোষী বিদেশীর রাখো প্রাণ,
দুই দিন মাগিনু সময়।
প্রহরী।
রাখিব তোমার অনুনয়।
দুই দিন কারাগারে রবে,
তার পর যা হয় তা হবে ॥
বজ্রসেন।
এ কী খেলা, হে সুন্দরী, কিসের এ কৌতুক।
কেন দাও অপমানদুখ,
মোরে নিয়ে কেন, কেন এ কৌতুক ॥
আমাদের রাজকোষ চুরির সাথে কবির ভাবনা চমৎকারভাবে মিলে গেছে। প্রথমেই এই চুরির কথা গোপন রাখা হলো। এক মাস পর ফিলিপাইনের একটি সংবাদপত্র খবরটি প্রকাশ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের ‘টনক’টি না নড়ে আর উপায় রইল না। খবরটি প্রকাশ করেছে সেই দেশটি, যে এই চুরি থেকে লাভবান হয়েছে। আর গৃহস্থ হিসাবে আমরা চুপ মেরে রইলাম।
গোপনে গোপনেই চোর হিসেবে পরদেশী এক বজ্রসেনকে খুঁজতে লাগলাম। সেই বজ্রসেনকে পেয়েও গেলাম। সে আর কেউ নয়, পরদেশী হ্যাকার। তখন ক্লান্ত স্বরে হ্যাকার বলছে, এ কী খেলা, হে সুন্দরী, কিসের এ কৌতুক।
কাকতালীয়ভাবে আমাদের একজন বড় নেত্রীর নামের বাংলা তর্জমা হলো সুশ্রী রমণী।
শুধু বিশেষজ্ঞরাই নন, আইটি সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান আছে যাদের, তারা জানেন এই জায়গায় হ্যাকাররা কখনোই প্রবেশ করতে পারেন না। আমাদের অর্থমন্ত্রী না বুঝে প্রথমেই মার্কিন ফেডারেল ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পরে বিষয়টি একটু মালুম করে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাই এই চুরির জন্য শতভাগ দায়ী। পরে হয়তো অন্য কারো ভয়ে বলেছেন, এটি তার অফিসিয়াল কথা নয়।
তিনি জানিয়েছেন, পরপর ছয়জন মানুষের হাতের ছাপ একটি বিশেষ প্লেনোটের ওপর পড়লেই কোন ট্রানজাকশন কার্যকর হয়। সাথে সাথে আছে বিশেষ কোড নম্বর। যে পদ্ধতিতে হাতের ছাপটি নেয়া হয়, তার নাম বায়োমেট্রিক্স পদ্ধতি। আঙুলের ছাপ, চোখের রেটিনা, ডিএনএ এগুলো হলো বায়োমেট্রিক ভেরিফায়ার। বিশ্বে হোমো সেপিয়ান বা মানুষের সংখ্যা এক ট্রিলিয়ন (এক হাজার বিলিয়ন) হলে তখনই শুধু দুজন মানুষের বায়োমেট্রিক চিহ্নগুলো এক হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর সাকুল্য মানুষের সংখ্যা মাত্র সাত বিলিয়ন। কাজেই এক মানুষের বায়োমেট্রিক চিহ্ন অন্য মানুষের সাথে মিলে যাওয়া অসম্ভব।
বিল ক্লিনটন যখন মনিকা কেসে ফেঁসে যান, তখন প্রথম দিকে তা অস্বীকার করেছিলেনন। কিন্তু বুদ্ধিমতি মনিকা তার ব্যবহৃত কাপড়ে তাদের ভালোবাসার কিছু নমুনা সংরক্ষণ করে রেখে দেন। সেই মহামূল্য দ্রব্য নিয়ে ডিএনএ টেস্ট করলে তার ডিএনএর সাথে মিলে যায়। তখনকার পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষটি নিমেষেই দু’টি হাত হাঁটুর ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। পৃথিবীবাসী জানতে পারল লোকচক্ষুর অন্তরালে এই হাত দু’টির ইন অ্যাপ্রোপ্রিয়েট নাড়াচড়া। হুমায়ূন আহমেদের অমর সৃষ্টি রহিমার মার উচ্চারণের মতো, ছি-ছি-ছি।
কাজেই যে ছয়জন মানুষের হাতের ছাপ প্রয়োজন, তাদের ছয়জনকেই যেখানে প্লেটটি রাখা আছে, সেখানে যেতে হবে। কোনো চোর সে রুমে প্রবেশ করলে কোনো কাজ হবে না। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মতো এই ছয়জনকে এক সাথে অবচেতন করে সেই রুমে নিয়ে যেতে পারলে এটা সম্ভব। কিন্তু তাদের চেতনা ফিরে পাওয়ার পর তাতো সবাইকে জানিয়ে দেয়ার কথা।
ফিলিপাইনে এই চুরির সাথে যে কর্মকর্তা জড়িত, তিনি জানিয়েছেন, তাকে গুলির হুমকি দিয়ে এই কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। একই গ্রুপ কি এখানেও একই ধরনের হুমকি দিয়ে কাজটি করিয়েছে?
কিছু প্রশ্ন জনমনে সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সে প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়া প্রয়োজন। নিজের জীবন, ইজ্জত কিংবা চেতনা রক্ষা করতে গিয়ে ষোলো কোটি মানুষ এবং তাদের ভবিষ্যৎ সব প্রজন্মকে অরক্ষিত করে ফেলছি কিনা, তা একটু ভেবে দেখা দরকার। ওয়ারলর্ডদের শাসিত আফ্রিকা মহাদেশের ব্যর্থ রাষ্ট্রসহ যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে যে ঘটনা ঘটেনি, এই হতভাগা দেশে সেই ঘটনাও ঘটে গেছে। যত ভয়ঙ্কর ও কঠিন হোক না কেন, এ কথাগুলো আমাদের উচ্চারণ করতেই হবে। এখানে মুখ বন্ধ করে রাখার কোনো অবকাশ নেই। ফিলিপাইনে এ ঘটনা প্রকাশিত না হলে আমরা তো জানতেই পারতাম না। কাজেই এ ধরনের চুরি আগে আরো হয়নি, তারই কি নিশ্চয়তা আছে? এখন যে রিজার্ভের কথা বলা হচ্ছে, তার হদিস নিয়েও সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। মানুষের ক্রমবর্ধমান আস্থাহীনতায় এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাজির গরুর মতো। কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সবার মনে জাগছে; অর্থমন্ত্রী যে ছয়টি হাতের কথা বলেছেন, সেই ছয়টি হাত এখন কোথায়? মানুষের হারানো আস্থা ফিরিয়ে আনতে এদের জাতির সামনে হাজির করা উচিত।
ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই হ্যাকিংয়ের দোহাই দিয়ে বিদেশী বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানাকে মৌখিক ভাবে নিয়োগ দেয়া হলো। জাতির প্রাণভোমরা হিসেবে বিবেচিত স্পর্শকাতর ব্যাংকের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব তিনি নিয়ে নিলেন। আগের সব ডাটা এবং সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও মুছে গেল!
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ডাটা মুছে গেলেও ফেডারেল ব্যাংকের ডাটা ও প্রমাণগুলো কিন্তু মুছে যায়নি। এই চুরি সারা বিশ্বের ব্যাংকিংব্যবস্থার ওপর মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করেছে। সন্ত্রাসবাদ যেমন মানুষের জানের ওপর হুমকি সৃষ্টি করেছে, তেমনি এই আর্থিক সন্ত্রাস যুক্তরাষ্ট্রের মালের ওপর হুমকি সৃষ্টি করেছে। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি সহজে ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না।
ফিলিপাইনের ব্যাংকিং ব্যবস্থার গোপনীয়তা আইন সংশোধনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চাপ রয়েছে। এমতাবস্থায় নিজেদের সিস্টেমের স্বচ্ছতা দেখাতে তারা এ ঘটনার একটা বিশ্বাসযাগ্য তদন্ত ও বিচার না করে থাকতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্র যে আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে সারা পৃথিবীর ওপর আর্থিক মোড়লিপনা করে যাচ্ছে, এই চুরি তাতে কিছুটা ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। কাজেই নিজেদের স্বার্থেই এই চুরির পেছনের সব ঘটনা এই বিশ্ব মোড়লকে বের করতেই হবে।
সব আলামত দেখে মনে পড়ছে কবি নজরুলের কবিতার সেই পংক্তি,
আসিতেছে শুভদিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন