|
মিনার রশীদ
minarrashid@yahoo.com |
|
‘বংশতন্ত্র’ কতটুকু খারাপ কতটা অপরিহার্য?
06 April 2016, Wednesday
দেখা যায়নি। ফলে বিএনপির পরিবারতন্ত্রের ধ্বংস কামনা করে আওয়ামী লীগের পরিবারতন্ত্রকে পোক্ত করতে চাইছে কি না সে প্রশ্ন আসছে।
দুই.
মিডিয়ার একটি অংশের বিশেষ উৎসাহ ও সহযোগিতায় কিছু জরিপকারী বের হয়ে পড়েছেন। তারা জিয়ার বিএনপি থেকে খালেদার বিএনপি কতটুকু দূরে সরে গেছে তা মাপা শুরু করেছেন। শরীরে বিএনপির গন্ধ আছে এ ধরনের জরিপকারীর কৌশলগত মূল্য এ ক্ষেত্রে অপরিসীম। আত্মসমালোচনা বা আত্মপর্যালোচনা একটি রাজনৈতিক দলের জন্য নিঃসন্দেহে উপকারী। কিন্তু এখানেও ‘সব কিছু নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’। দলে পদ-পদবি অটুট থাকাবস্থায় এসব জরিপকারীর কেউ সংস্কারের কথা ভাবেন না বা জিয়ার আদর্শের প্রতি এ ধরনের মাত্রাতিরিক্ত আবেগ-ভালোবাসা প্রদর্শন করেন না। পদ-পদবি চলে গেলে কিংবা হাওয়া একটু উল্টো দিকে বহিবা মাত্রই সবাই সংস্কারবাদী হয়ে পড়েন কিংবা অতিমাত্রায় জিয়াপ্রেমিক সেজে যান।
তাদের সাথে নিয়ে এক-এগারোর পর থেকেই বিকল্প বিএনপি দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। সাবেক সিইসি শামসুল হুদা ছিলেন এসবের পালের গোদা। তিনি কার ইশারায় এ কাজে হাত দিয়েছিলেন তা আজ স্পষ্ট হয়ে পড়েছে। একটি রাজনৈতিক দলকে ভেঙে নিঃশেষ করার নির্লজ্জ প্রচেষ্টা তিনি সরাসরি চালিয়েছিলেন। সেই একই পালের কেউ কেউ এখন সুশীল সেজে জাতিকে ক্রমাগত জ্ঞান দান করে চলেছেন।
বিএনপিকে বিব্রত করতে এক টোকাইকেও ময়দানে নামানো হয়েছে। বিএনপির শিরনি খাওয়া দুই-দুইবারের মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে দিয়েও বিকল্প বিএনপি দাঁড় করানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রচেষ্টাই ফলপ্রসূ হয়নি। এমতাবস্থায় সহমর্মী হিসেবে জিয়ার এক অসুস্থ সহোদরকে পেয়ে মনে হলো তারা অমাবস্যার চাঁদ হাতে পেয়ে গেছেন।
এ দেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে জিয়ার এই ছোট ভাই আজীবন দূরে থেকেছেন। রাজনীতির গতিধারা সম্পর্কে তিনি যে খুব একটা ওয়াকিবহাল তা-ও মনে হচ্ছে না। রাজনীতি হলো একটা বহমান নদীর মতো। জ্যামিতির কোণ মেপে এর গতিপথ নির্ধারিত হয় না। রাজনীতির সেই গতিধারাকে খুঁজে বের করার মতো শারীরিক সক্ষমতা, মানসিক অবস্থা কিংবা পূর্ব অভিজ্ঞতা কোনোটিই তার নেই। যাদের ওপর ভরসা করে জাতির এবং নিজের জীবনের এই অসময়ে তিনি ভাইয়ের রাজনীতি খুঁজতে চাচ্ছেন তাদের সবাই সেই একই ঘরানার। তাদের একেকজন মতলববাজির এক চরম উদাহরণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। তার পাশে যে কয়টি চেহারা দেখা গেছে, তাদের সবার ভূমিকাই প্রশ্নবিদ্ধ। বেগম জিয়া বা তারেক জিয়ার আশপাশে থেকে যারা বিএনপির ক্ষতি করছে বলে তিনি অভিযোগ তুলেছেন, নিজের আশপাশে তিনি এর চেয়ে উন্নতমানের কাউকে জোগাড় করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার অনন্য গুণের মধ্যে এটাই ছিল যে, ক্ষমতায় থাকাবস্থায় তার কোনো আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে দেশবাসী কিছুই জানতে পারেনি। অথচ তার আগে বা পরের প্রায় সব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান একধরনের রাজতান্ত্রিক ভাবধারা সৃষ্টি করে গেছেন। জিয়া এখানে সত্যি অনন্য এবং অসাধারণ।
সমসাময়িক অন্যরা যেখানে দুর্ভিক্ষের প্রাক্কালে স্বর্ণের মুকুট পরিয়ে ছেলেদের বিয়ে দিয়েছেন, জিয়া সেখানে নিজের পুরনো শার্ট কেটে ছেলেদের শার্ট বানিয়ে পরিয়েছেন। এই ব্যাপারে তার ব্যক্তিত্ব অত্যন্ত মোহনীয় ও দৃষ্টিশক্তি প্রখর, জাগ্রত বা সতর্ক ছিল। জিয়ার অনেক বক্তৃতা বা কথার রেকর্ড আছে। কিন্তু কোথাও নিজের সততার কথা, ধার্মিকতার কথা বা নিজের ঢোল নিজে পেটানোর মতো কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। শ্রোতাদের তাক লাগানোর কথা কখনই শোনা যায়নি। তার মৃত্যুর পর তার জীবনের এসব ঘটনা জানা গেছে। তখন জাতি সম্যক টের পায় যে, আমরা আসলেই কী হারিয়েছি!
সেই জিয়ার দলকে বর্তমান অবস্থায় দেখে খারাপ লাগারই কথা। আগের এবং বর্তমানকালের মধ্যে তুলনাটিও সঙ্গত কারণেই চলে আসবে। সবাই জিয়ার সততার কথা বলে কিন্তু নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে সেই সততার প্র্যাক্টিস অনেকেই করেন না। সে জন্য কোনো তাগিদও অনুভব করেন না। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের মূল প্রবক্তা হিসেবে এই দলটি এবং তাদের কর্তাব্যক্তিরা আধিপত্যবাদী শক্তির মূল চক্ষুশূল হবে- এটাই স্বাভাবিক। নিজেদের স্বার্থেই আধিপত্যবাদী শক্তির দেশীয় দোসররা এই দলের মধ্যে পাওয়া কোনো তিলকে তাল বানিয়ে পরিবেশন করে। কিন্তু সেই তিলটিও যাতে সৃষ্টি হতে না পারে সেই প্রচেষ্টাটি এই দলের মধ্যে কতটুকু সক্রিয় ছিল বা এখনো আছেÑ তা নিয়ে প্রশ্ন উত্থিত হতেই পারে।
তিন.
বিএনপিতে কাজের লোক কমে গেছে, পরামর্শকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। পরামর্শ ভারাক্রান্ত এমন রাজনৈতিক দল পৃথিবীতে বোধহয় দ্বিতীয়টি নেই। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীকুলও বিএনপিকে অনবরত বুদ্ধি দিচ্ছেন। বিএনপির প্রতি অনবরত বুদ্ধি নিক্ষেপ করা বুদ্ধিজীবীরা আবার কয়েক কিছিমের রয়েছেন।
প্রথম পর্যায়ে রয়েছেন যারা আওয়ামী লীগের হানিফ এবং হাছান মাহমুদের বুদ্ধিজীবীয় সংস্করণ। তারা বিএনপির অবৈতনিক পরামর্শদাতার মতো। বিএনপি থেকে খালেদা এবং তারেককে মাইনাস করলেই বিএনপি ঠিক হয়ে পড়বে বলে তারা প্রকাশ্যেই বলেন। তারা যখন কথা বলেন তখন গণপ্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে থোরাই কেয়ার করেন। ছন্দ মিলুক আর না মিলুক, যুক্তি মিলুক আর না মিলুক হানিফ আর হাছান মাহমুদরা প্রতিপক্ষের দিকে সর্বদা কথার ফুলঝুরি ছুড়ে দেন। তারা বিএনপির জন্য তেমন কোনো হুমকি নয়। মোটা মাথার বিএনপি নেতা ও সমর্থকও তাদের পরামর্শের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে।
পরামর্শদাতাদের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছেন নিরপেক্ষ ঘরানার বুদ্ধিজীবীকুল। কৌশলে তারা আওয়ামী লীগেরও সমালোচনা করে। মুক্তিযুদ্ধের ভাবধারা তাদের জন্য একধরনের রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করে। যেখানে আওয়ামী লীগকে সরাসরি সমর্থন করা যায় না সেখানে তারা মুক্তিযুদ্ধকে টেনে আনেন। তারা গণতন্ত্র চান তবে শর্ত একটাইÑ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগকেই সর্বদা ক্ষমতায় থাকতে হবে। তারা যখন বিএনপিপ্রেমিক সেজে পরামর্শ দেয়, তখন বিএনপির অনেক জ্ঞানীগুণীরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। তাদের কাছে প্রায়ই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মনের কথা খুলে বলেন, যা তারা নিজেদের কমিটিতে আলোচনা করতে পারেন না।
পরামর্শদাতাদের তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছেন বিএনপির তথাকথিত উদার অংশ। তারা বিএনপির মধ্যে আওয়ামী লীগের ‘মাই ডিয়ার’ অংশ। তাদের ‘উদার’ পদবিটি আওয়ামী লীগেরই দেয়া। বিএনপির কর্মী ও নেতাদের বিভ্রান্ত করতে যে কাজটি উপরিউল্লিখিত দু’টি গ্রুপ দিয়ে করানো সম্ভব হবে না- সেই কাজটিই তাদের দিয়ে করানো হয়।
তাদের একজন ছিলেন দৈনিক দিনকালের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। ইদানীং বিএনপির প্রতি মুহুর্মুহু উপদেশ বর্ষণ করছেন। বিএনপি নিজের পায়ে কুড়াল মারছে এ ধরনের আর্তচিৎকার করে প্রায়ই বিএনপির অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তুলছেন তিনি। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির শিরনি এই মুন্সিরাই খেয়েছেন। এখন জিয়ার সহোদরকে তিনিই জিয়ার আসল দল পয়দা করতে সাহায্য করছেন।
এই মুন্সির অন্যতম এজেন্ডা জামায়াতের ‘খপ্পর’ থেকে বিএনপিকে বাঁচানো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন জামায়াতকে তাদের কৌশলগত মিত্র হিসেবে বেছে নেয়, তখন এ ধরনের কোনো মুন্সি আওয়ামী বলয় থেকে বের হননি। এই মুন্সিরা কার শিরনি খেয়েছেন তা নিজেরাই জানেন না।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াকে তারা কতটুকু জানেন বা কতটুকু চেনেন তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের কথা সংযোজন করেছিলেন এই জিয়াই। এখন প্রশ্ন, কোন জামায়াতের খপ্পরে পড়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া এই ভয়ানক কাজটি করেছিলেন?
ধর্মবিশ্বাস ও গণতন্ত্র এ দেশের মানুষের রক্তের সাথে মিশে গেছে। অনেকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই তিনি এই কাজটি করেছিলেন। পাকিস্তানের ভাবধারা দূর করার নামে যখন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও ভাবধারা মুছে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা শুরু হয়েছিল, তখন এ দেশের মানুষের মন থেকে হীনম্মন্যতা দূর করে প্রয়োজনীয় সাহসটি জুগিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া। এর পরিণাম তিনি জানতেন। জেনেই তিনি তা করেছেন। এ দেশবাসী তার নামের সাথে শহীদ শব্দটি জেনেশুনেই যোগ করেছে।
কবি নজরুল যেমন সাংস্কৃতিক মোড়লদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্ব কাব্যলক্ষ্মীর একটা মুসলমানী ঢঙ রয়েছে। তেমনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া রাজনৈতিক মোড়লদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিশ্ব রাজনীতির একটা মুসলমানী ঢঙ থাকতে পারে। সেই ঢঙটি তথাকথিত মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আজ থেকে ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশ বছর আগে জিয়ার সেই আদর্শটি বর্তমান টালমাটাল বিশ্বকে রক্ষা করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি একই কথা বলে গেছেন। জিয়া ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। বাংলাদেশের রাজনীতি ছিল ডান, বাম কিংবা পেছন দিকের। তিনিই প্রথম দেখিয়েছেন সামনের দিকের রাজনীতি।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন