|
মিনার রশীদ
minarrashid@yahoo.com |
|
অন্যের সোহাগে নিবেদন করা যায় না সবকিছু
18 May 2016, Wednesday
যাকে বলে একেবারে হাটে হাঁড়ি ভাঙা। সেই কাজ দুটিই করেছেন ভারতের দুজন নারী। এই নারীদের একজন একটি বই লিখেছেন এবং অন্যজন প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছেন। উভয়ের অভিযোগ দুটিই গুরুতর। অনেকটা খোলামেলা কামসূত্রের দেশ ভারতীয় সমাজও বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহন করছে না। নিজের বউকে শুধু জোর করে অন্য কেউ নিগ্রহ করলেই নয়, বিশেষ চুক্তি বা আন্ডারস্টেন্ডিংয়ের আওতায় সোহাগ করলেও তা মানা যায় না। রক্ত তখন শুধু মাথাতেই উঠে না, সেই রক্ত পারলে মাথার উপরে চুলের মধ্যেও ঢুকে পড়তে চায়।
সেই ধরনের কাজ যখন পরস্পরের সম্মতিতে ঘটে যায় তখন তা সামাজিক বিকৃতি ও নৈতিক পদস্খলনের চূড়ান্ত অবস্থা নির্দেশ করে। এই বিকৃতি মানব সমাজের সবচেয়ে পুরনো প্রতিষ্ঠান বিয়ে ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। এই অভিযোগটি করেছেন ভারতীয় নৌবাহিনীর এক অফিসারের প্রাক্তন স্ত্রী। তিনি অভিযোগ করেছেন যে স্বামী তাকে দিয়ে ওয়াইফ সোয়াপিং বা বউ অদলবদল কাজে জোর করে অংশগ্রহন করিয়েছেন। অনুমিত হচ্ছে, দাম্পত্যজীবনের এক ঘেয়েমি দূর করতে গিয়ে যে বিকৃত পন্থার তারা শরণাপন্ন হয়েছিলেন, তাতেও এক সময় একঘেয়েমি ধরে গিয়েছিল বলেই এই বিচ্ছেদ সকলের গোচরীভূত হয়েছে।
ভারতীয় মহিলা ফুটবল দলের প্রাক্তন ক্যাপ্টেন সোনা চৌধুরী তার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘গেইম ইন গেইম’ এ একই ধরনের আরেকটি বোমা ফাটিয়েছেন। যোগ্যতা বা প্রতিভা যাই থাকুক না কেন, কর্তা ব্যক্তিদের নারীত্বের এই বিশেষ সম্পদটি ঘুষ হিসেবে না দিলে কোনো মেয়েই নাকি ভারতের কোনো স্তরে খেলার সুযোগ পান না। বিষয়টি কেন এত জটিল হয়ে পড়েছে তা উপলব্ধি করতে বেগ পেতে হয় না। কারণ ১০ পয়েন্ট নিয়ে কোন সতী সাধ্বী রাজি না হলে ৯.৯ পয়েন্ট নিয়ে আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ বর্তমান বস্তুবাদী বা ভোগবাদী সামাজিক কাঠামো শুধু অনেক নারীলোভী পরিমলই সৃষ্টি করেনি, অনেক নম্বরলোভী ছাত্রীও সৃষ্টি করেছে।
নারী স্বাধীনতার নাম নিয়ে এরা নারীকে বা নারীত্বকে আরো কঠিন ও ভয়ঙ্কর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে ফেলেছে। যারা আবদ্ধ হচ্ছেন, তারাও এই জিঞ্জিরটির অস্তিত্ব সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন না। এরা বর্তমান ঝলমলে মার্কেট ইকোনোমি বা কলি কালের দেবদাসী। পুরুষতন্ত্রের এই চক্কর থেকে বের হওয়া নারীদের জন্য আসলেই কঠিন। নারীবাদীরাও আজব ভূমিকা পালন করে চলেছে। বাম এবং অন্য সকল দিকের পুরুষতন্ত্রকে ছেড়ে দিয়ে কিংবা নিজেরাই পুষ্ট করে শুধু ডান দিকের পুরুষতন্ত্রের দিকেই এরা নিজেদের আক্রমণাত্মক কামানটি তাক করে রেখেছে।
‘খেলার মধ্যে আরেক খেলা’ গ্রন্থের এই লেখিকা নিজেও একজন খেলোয়াড়, একই পথের যাত্রী। দেখতে শুনতে অত্যন্ত স্মার্ট এবং সুন্দরীও বটে। এই কারণেই এই সংবাদটি বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। একজন চিত্রনায়িকা যখন সুগার ডেডি বা চিনি বাবা হিসাবে চিত্র প্রযোজক বা পরিচালকদের কীর্তির কথা প্রকাশ করেন, তখন তা থেকে নিজেকেও বোধ হয় বাদ রাখেন না। কাজেই অনুমিত হয় যে নিজের হাতে যথেষ্ঠ প্রমাণ এবং সাপোর্টিং ডকুমেন্ট মজুদ না করে সোনা চৌধুরী এই সোনার জিঞ্জিরটি বিশ্ববাসীর সম্মুখে উন্মুক্ত করেননি।
এই দুটি সাড়াজাগানো অভিযোগের পর একই কিছিমের দাম্পত্য টানাটানির অনুরূপ তিন নম্বর উক্তিটি করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। তিনি জানিয়েছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য কারো নাক গলানোকে ভারত বরদাস্ত করবে না। কোন অথরিটি নিয়ে ভারত আমাদের হয়ে অন্যদের শাসান, তা অনেককে গোলক ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে।
পাকিস্তান ও তুরস্ক আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলিয়ে আমাদের বিক্ষুব্ধ করেছে। তার বিপরীতে ভারত আমাদের দেশের প্রতি এ কোন সোহাগ দেখাচ্ছে? নিজের বউ আর নিজের দেশ- এ দুটি জিনিস অন্যের সোহাগে নিবেদন করা যায় না।
মানবতা বিষয়টিকে কোনো ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখা যায় না। কাজেই পৃথিবীর কোথাও এই মানবতা বিঘ্নিত হলে অন্য জায়গা থেকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ভেসে ওঠে। মাওলানা নিজামীর মুত্যুদণ্ডের ব্যাপারে পাকিস্তান ও তুরস্ক যে কথা বলেছে সেই একই বিষয় নিয়ে জাতিসঙ্ঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং যুক্তরাষ্ট্র মুখ খুলেছে। তন্মধ্যে সরকার শুধু পাকিস্তানকে নিয়েই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। বাকিদের উদ্বেগ, উৎকণ্ঠাকে মনে হয় নীরবে হজম করে গেছে। তবে বন্ধু ভারত আমাদের হয়ে সকলকে লক্ষ্য করে এই হুঁশিয়ারিটুকু উচ্চারণ করেছে।
আমাদের দেশের প্রতি ভারতের এই সোহাগ দেখে চরম কষ্টের মাঝেও পরলোকগত শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব ও শেফালী ঘোষের দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া গানটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। শ্যামসুন্দর গিয়েছিলেন (চিটাগাং এর আঞ্চলিক থেকে বাংলানুবাদ ), আমার বউরে আমি কিলামু, আমি খাওয়ামু তুই তাতে নাক গলাস কেন? তেমনি ভারত আমাদের ‘কিলাইতেও’ পারবে, ‘খাওয়াইতেও’ পারবে। তাতে অন্যরা নাক গলাতে পারবে না। ভারতের সুর ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ হুবহু একই রকম। আমরা শুধু শ্যাম সুন্দরের পাশে থেকে শেফালী ঘোষের সুর ও ভঙ্গিতে আঙুল উচিয়ে মাঝে মাঝে বলব, হ্যাঁ হ্যাঁ- তুই তাতে নাক গলাস কেন?
একাত্তরে তারা আমাদেরকে অনেক ভাত খাইয়েছেন। কাজেই এখন কিলানোর অধিকার জন্মেছে। সেই অধিকার থেকেই আমাদের সব নদীর পানি প্রত্যাহার করে দেশটাকে মরুভূমি বানিয়ে ফেলেছে। আমাদের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধাগুলোকে একে একে চূর্ণ বিচূর্ণ করে রাজনীতি ও অর্থনীতির সব নিয়ন্ত্রণ করায়ত্ত করে ফেলেছে। এদেশে যতটুকু গণতন্ত্র ছিল সেটুকুও ধ্বংস করেছে। সবচেয়ে বড় কথা ডিভাইড এন্ড রুলের উদ্দেশ্যে সিঙ্গেল ইউনিটের চমৎকার জাতি রাষ্ট্রটিকে সর্বনাশাভাবে বিভক্ত করে ফেলেছে। তিক্ততা ও বিভক্তির বীজ রোপণ করে তার ফসলও ঘরে তুলেছে।
এতে আমাদের চরম ক্ষতি হলেও পরিণাম ফল ভারতের জন্যও শুভ হবে বলে মনে হয় না। ভারত তার চতুর্দিকে শত্রু না কমিয়ে বাড়িয়ে তুলছে। দেশটির জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক হবে প্রতিবেশীর মনের চাপা ক্ষোভটি উপলব্ধি করা। কোনো কিছু চেপে রাখলে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে তা রিলিজ হওয়ার উপায় খুঁজবেই। যত বড় শক্তিই হোক না কেন, প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করে কেউ টিকে থাকতে পারে না। বিকল্প শক্তি দাঁড়িয়ে পড়বেই।
একটা দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন না করে একটা দলের সাথে সম্পর্ক করে ভারত তার নিজের বিপদটিই কি টেনে আনছে না? ভারতের আশীর্বাদপুষ্ট দলটির প্রতি দেশের মানুষের আস্থা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। দলটি এসেট না হয়ে অচিরেই লায়াবেলিটিজ হয়ে পড়তে পারে। অনেকের ধারণা এই চিন্তা থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের ডা: ইমরানকে বিকল্প হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। গণমানুষের উদ্বেগ ও হতাশা ইমরানের মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে। তবে তাতেও কি শেষ রক্ষা হবে?
একটা দেশের সাথে অন্য দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বৈধ। কিন্তু একটা দেশের সাথে অন্য দেশের বিশেষ দলের বিশেষ সম্পর্ক অবৈধ। ভারতের এই ভুল নীতি তাকে প্রতিটি প্রতিবেশী থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। ইন্ডিয়ার করুণার কাছে বন্দী রাজ্য হিসেবে একসময় বিবেচিত ল্যান্ড লক্ড নেপালেও ভারতের এই পলিসি উল্টো ফল দিয়েছে। নেপাল এখন ভারতের স্বার্থের বিপরীতে গিয়ে চীনের সাথে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের নতুন খেলা বুমেরাং হয়ে পড়তে পারে।
ভারতের জাতপাতের কষাঘাতে এক তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে নকশাল আন্দোলন দানা বেঁধেছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এটাকে ভারতের জন্য পাকিস্তানের চেয়েও বড় হুমকি বলে উল্লেখ করেছিলেন। মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন খেলাকে ভারতের ভেতরের ৩০-৩৫ কোটি মুসলিম ভালোভাবে গ্রহণ করবে কি? বাংলাদেশ ভারতের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে- এই ধরনের কথা ইন্ডিয়ার অনেক মুসলিম নেতা বলাবলি শুরু করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে এই ধারণাটি আরো বড় পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাংলাদেশকে নিয়ে কোনো যুদ্ধের পরিস্থিতি পুরো উপমহাদেশকেই নতুন করে অস্থির করে তুলবে আর তাতে ভারতের ক্ষতিটিই বেশি হতে পারে। অতি চালাকের গলায় দড়ি- সেই কথাটি তখন দিল্লির জন্য সত্য হয়ে পড়তে পারে।
এ দেশের শান্তিকামী মানুষ সবার সাথে শান্তিতে থাকতে চায়। কোনো প্রতিবেশীর সাথেই কোনোরূপ অশান্তি জিইয়ে রাখতে চায় না। সার্বিক বিবেচনায় ভারতের জন্যও নিরাপদ হলো- সত্যিকার অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক সেই বাংলাদেশের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমেই এই এলাকার মানুষের জন্য একটি কল্যাণকর দক্ষিণ এশিয়া গড়া সম্ভব। কোনোরূপ চালাকির মাধ্যমে এটি অর্জন সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে বড় প্রতিবেশি দেশটি এক পা এগিয়ে এলে এ দেশের মানুষ দুই পা এগিয়ে যাবে।
minarrashid@yahoo.com
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন