|
মিনার রশীদ
minarrashid@yahoo.com |
|
লুট এবং দখল-বেদখলের রাজনীতি
26 January 2017, Thursday
ব্যাংকিংব্যবস্থা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ব্যাংকডাকাতিও শুরু হয়েছে। ডাকাতদের পরনে লুঙ্গির পরিবর্তে প্যান্ট দেখলেই আমাদের পত্রিকাগুলো শিরোনাম করে বসে- ফিল্মি কায়দায় ডাকাতি। অবশ্য ফিল্মি কায়দায় ব্যাংকডাকাতির সাথে একধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি বা খান্দানি ভাব জড়িয়ে আছে। অনেক বড় ঘরের সন্তানরাও এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
পুঁজিবাদের আস্তানা হিসেবে ব্যাংকডাকাতি করতে শৌখিন বামপন্থী ‘ডাকাত’রা ডাবল আনন্দ পেতেন। তাই এসব ডাকাতিকে সর্বহারার নামে গ্ল্যামারাস করে তুলেছেন। বর্তমান সরকারকে অনেকাংশে বামপন্থীরা দখল করে নিয়েছে। কোনো উদ্যোক্তাকে সুদখোর মহাজন ডেকে, আবার অন্য উদ্যোক্তাকে জঙ্গিবাদের সাহায্যদাতা অপবাদ দিয়ে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয়া হচ্ছে। যা হোক, এ দেশে ব্যাংকডাকাতির কিছু ঐতিহাসিক পটভূমিও রয়েছে।
১৯৭১ সালে এ দেশের মানুষ যখন পাকিস্তানি হানাদারদের তাড়াতে জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত, সেই সময়েই কারো কারো নজর ছিল তখনকার ব্যাংকগুলো লুটপাটের দিকে। কথিত আছে, এই মহামান্য ব্যক্তিরা বিশেষ ব্রিফকেস নিয়ে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে কলকাতায় বিশেষ অফিসে হাজির হতেন। সেই ব্রিফকেসকে কিভাবে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন, সেসব সরস বর্ণনা পরবর্তীকালে অনেকের স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে।
যা-ই হোক ধীরে ধীরে ব্যাংকডাকাতি, দখলের ধরন ও প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন এসে গেছে। গত দশ বছরে সারা বিশ্বে ইন্টারনেট ও মোবাইল প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল শব্দটি নিয়ে আমাদের মতো এমন হাস্যকর চেঁচামেচি পৃথিবীর কম জায়গায় হয়। অন্য কোন সেক্টর কতটুকু ডিজিটাল হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ব্যাংকডাকাতি এবং লুটপাটের জায়গাগুলো অ্যানালগ থেকে শতভাগ ডিজিটাল হয়ে পড়েছে। এখন ব্যাংকডাকাতি করতে অ্যানালগ যুগের ছালা, বস্তা কিংবা বন্দুকের দরকার পড়ে না। এখন শুধু ব্যাংকের কোনো শাখায় গচ্ছিত সেই দিনের টাকা ডাকাতি হয় না- পুরোটাই একরকম ডাকাতি হয়ে যায়। এই ব্যক্তিরা সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে এত ক্ষমতাধর যে এদের নাম নিতে ভয় পেয়ে জিভ কেটেছেন খোদ অর্থমন্ত্রী।
২০০৯ সালের পর নতুন ধরনের ব্যাংক দখল শুরু হয়ে গেছে। স্কুলের সাধারণ শিক্ষিকা থেকে শুরু করে প্রাক্তন ছাত্র-নেতারা কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা ছাড়াই বড় বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালক হয়ে গেছেন। ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। হলমার্কের তানভীরের মতো তিন হাজার টাকার গার্মেন্ট কর্মচারীকে কোনোরূপ কোলেটারেল ছাড়াই চার হাজার কোটি টাকার লোন দেয়া হয়েছে। এই পরিমাণটিকে আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন পি-নাট। সার্বিক লুটপাটের তুলনায় এটি ছিল আসলেই পি-নাট।
পত্রপত্রিকায় এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এগুলো নিয়ে লেখালেখির পর হলমার্কের মালিককে জেলখানায় আটকানো হলেও এর পেছনে যে উপদেষ্টার নাম এসেছিল তিনিসহ ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যদের কেশাগ্রও স্পর্শ করা যায়নি। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোও এই নামগুলো প্রকাশ করেনি। বরং সেই সব লুটেরাকে টকশোতে ডেকে জাতিকে বয়ান করার সুযোগ করে দেয়া হয়। আসলে এদের ভেতরের ঘিলা কলিজাও ডিজিটাল হয়ে গেছে। ফলে ঘেন্না পিত্তি লজ্জা শরম কিছু আর অবশিষ্ট নেই।
সরকারি ব্যাংকগুলো খাওয়ার পর নজর পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি।
এই সরকারের জমানায় গ্রামীণব্যাংক হয়ে পড়েছে ‘গরিবের ঘরে সুন্দরী বউ’য়ের মতো। যারা দুর্নীতি নিয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে এত দিন অন্যায্য তুলনা ( ঋধষংব বয়ঁধষরুধঃরড়হ ) করে এসেছেন, বেগম জিয়া এবং হাসিনাকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বলেছেন, তারাও এই বিষয়টির খুব গভীরে যেতে পারেননি। আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য প্রধান দু’টি দলই দায়ী হলেও রাজনৈতিক দর্শনে তাড়িত হয়ে ছলে বলে কৌশলে এভাবে প্রাইভেট প্রপার্টি হস্তগত করার বিষয়ে দুটি দলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আওয়ামী-ভাবাপন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার প্রচুর সম্পদ এ দেশে রয়েছে। বিএনপি তাদের দীর্ঘ সময়ের শাসনকালে তার একটাও দখল করেনি। এমনকি এরশাদের জাতীয় পার্টিরও এই বদনাম নেই।
গরিবের বউকে হস্তগত করার আগে সেই গরিবের চরিত্র ও অক্ষমতা সম্পর্কে বদনাম ছড়িয়ে দেয়া হয়। পাবলিকের চোখ তখন মোড়লের কুটনামির চেয়ে করিমের বিভিন্ন দোষত্রুটি বা অক্ষমতার ব্যাপারে আলোচনা নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজেদের অপকর্মকে বৈধ বা সমাজের কাছে সহনীয় বানানোর জন্য মোড়লগোছের লোকজন সালিস বসাতো। এখন ডিজিটাল যুগে সালিসের পরিবর্তে বসেছে সেমিনার বা গোলটেবিল আলোচনা। দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা সেই সব সেমিনারে উপস্থিত হয়ে জাতির কাছে বয়ান করেন এই দখলকর্মের মাধ্যমে জাতি কিভাবে উপকৃত হচ্ছে।
মশকরা শব্দটির সাথেই চরম মশকরা শুরু হয়ে গেছে। নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য বেগম খালেদা জিয়া তার কিছু প্রস্তাব সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতির কাছে পেশ করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বেগম জিয়া জাতির সাথে ‘মশকরা’ করছেন।
দেশের অর্থনীতি ও বিদেশী বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর অপকর্মটির বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিকদের যেভাবে প্রতিবাদ করার কথা ছিল, বাস্তবে তা হয়নি। এক ধরনের ফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে দেশের বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীর মাথা থেকে সব বুদ্ধি উধাও হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
এ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল তার ফেসবুকে লিখেছেন ভিন্নকথা।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরুণ গবেষক ও লেখক শাফকাত রাব্বি অনিকের ফেসবুক পোস্টিংটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দিয়েছে। তার পুরো লেখাটিই তুলে ধরলে পাঠকরা উপকৃত হতেন।
১. যেকোনো দেশের অর্থনীতি গতিশীল রাখার একটা মূল উপাদান হলো, সেই দেশের Ownership Law and Ownership Protection. মানে কোনো প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে বানানোর পরে কোনো দেশে সেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা কতটা নিরাপদ, তার ওপর সেই দেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ নির্ভর করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিনিয়োগবান্ধব ঙহিবৎংযরঢ় খধি এবং প্রোটেকশন পাওয়া যায় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সুইডেনসহ গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু দেশের অর্থনীতিতে। যে কেউ এই দেশগুলোতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বানায় এবং নিশ্চিত থাকতে পারে, সেই মালিকানায় সরকার কোনো দিন হাত দেবে না।
২. বিনিয়োগ দুই প্রকারের। একটা হলো ইকুইটি (Equity) বিনিয়োগ (যেমন শেয়ার কেনা), আর একটা হলো উবনঃ বা লোন বিনিয়োগ। বিদেশী সংস্থা বা ব্যাংক যখন debt investor হিসেবে আসে তখন তাদের ক্রেডিট কমিটি একটা রেটিং দেয়, ভালো রেটিং না থাকলে লোন পাওয়া যায় না। এই রেটিংয়ের ক্ষেত্রে বেসরকারি মালিকানা কতটা শক্তিশালী, তা গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। যেসব দেশে গত ২৫ বছরে সরকার কর্তৃক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণের ইতিহাস থাকে, সেসব দেশের বেসরকারি বিনিয়োগের রেটিং অনেক দুর্বল হয়। ৩. গ্রামীণব্যাংক বড় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক ইতিহাস বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের বিদেশী লোন কিংবা ইকুইটি মার্কেট অ্যাক্সেস করার সুযোগ দীর্ঘ দিনের জন্য কঠিন করে দিলো। এই ব্যাপারটা বোঝার মতো লোক বাংলাদেশে কম থাকা স্বাভাবিক। কেননা সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ পরিবেশ এখানে নেই। কিন্তু থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।
৪. একাধিক বিদেশী ইনভেস্টর ইতোমধ্যেই প্রাইভেট ব্যাংকে থাকা তাদের শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন। যারা ছেড়েছেন তাদের অনেকেই বড় প্রতিষ্ঠানের। তাদের অভিজ্ঞতা ব্যাংকিং সার্কেলে গল্প হিসেবে ঘুরতে থাকবে। ব্যাংকিং সার্কেলটা খুব ছোট এবং এই সার্কেল কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা সহজে ভোলে না।
ব্যাংক খেয়ে ফেলার মাধ্যমে ‘চেতনা’র বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরের যে দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতি হলো, তার ক্ষতি সংশ্লিষ্ট কারিগররা পোষাতে পারবে না।’
সত্যিই অনিকের এই বক্তব্যটি অনুধাবনের মতো মেধা অনেকের নেই। চেতনাজীবীদের দৃষ্টিতে অনিকের মতো তরুণ গবেষক ও লেখকরাও হয়ে পড়বেন বিতর্কিত। অথচ জাতির দুর্ভাগ্য, এই মাপের লোকদের হাতে পড়ছে সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করার চাবিকাঠি। বিভিন্ন সভা সেমিনারে এদের গলাবাজি সারা জাতিকে শুনতে হয়।
কয়েক বছর আগে শিপবিল্ডিংয়ে বাংলাদেশে একটি অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বর্তমান বিশ্বমন্দার কারণে তা আবার হোঁচট খেয়েছে। তখন নিজেও একজন বিদেশী উদ্যোক্তাকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য উৎসাহিত করেছি। বাংলাদেশের সস্তা শ্রম দিয়ে শ্রমঘন এই শিল্প কেমন লাভজনক হবে তা বুঝিয়ে বলি। আমার কথার জবাবে বলেন, তোমার সব কিছু ঠিক আছে। তোমার বর্ণিত হিসাব দেখে আমি দারুণভাবে উচ্ছ্বসিত! কিন্তু বলো, এই বিরাট লাভের টাকা তোমাদের দেশ থেকে ফেরত আনতে পারবো তো? আমার এই বিনিয়োগ যদি তোমাদের দেশের অন্য কোনো মাফিয়া গ্রুপ দখল করতে চায় তখন তোমাদের রাষ্ট্র এবং আইনকানুন তার কতটুকু প্রোটেকশন দিতে পারবে? আমার বিলিয়ন ডলার আরেকজন মিলিয়ন খরচ করে কুক্ষিগত করে ফেলবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
মজার ব্যাপার হলো, ইন্ডিয়া তাদের দেশের কোনো গ্রামীণব্যাংক কিংবা বেসরকারি মালিকানা এরূপ ছলে বলে কৌশলে কখনোই দখল করবে না। কারণ তারা ভালো করেই জানে, এর ফলে তাদের বিনিয়োগবান্ধব রেটিং নিচে নেমে যাবে। কিন্তু তারাই আবার আমাদের চেতনাকে শাণিত করে দেবে, উৎসাহ জোগাবে ব্যাংক দখল করে নিতে।
এসব হিসাব যাতে যুবসমাজের মগজে ঢুকতে না পারে তজ্জন্যে কেউ কেউ উদগ্রীব হয়ে আছেন দেশে জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়াতে। জিপিএ ফাইভের সংখ্যা বাড়িয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে যে বিপ্লব সৃষ্টি করা হয়েছে, তার পেছনের মাজেজা বোধ হয় এখানেই নিহিত রয়েছে। আসিফ নজরুলের উদ্বেগ এই নতুন প্রজন্মকে স্পর্শ করবে না, অনিক যা বোঝাতে চেয়েছেন বুঁদ হয়ে থাকা প্রজন্মের বড় অংশের মগজে এই হিসাব কখনোই ঢুকবে না। গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে ওরা সাধারণ মানের এক্সিকিউটিভ পর্যন্ত হতে পারবে না। কারণ একটা লাইনও শুদ্ধ করে লিখতে পারবে না অনেকে। আমরা এক্সিকিউটিভ আমদানি করব পাশের দেশ থেকে। কয়েক কোটি শ্রমিক গতর খেটে বাইরে থেকে যে ডলার আনবেন, কয়েক লাখ এক্সিকিউটিভ সেই পরিমাণ ডলার নিয়ে যাবে। রবিন হুড অর্থনীতি সে দিকেই দেশটিকে নিয়ে যাচ্ছে। এগুলো নিয়ে যারাই কথা বলবেÑ তারাই প্রতিপক্ষ।
আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় অবদান, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা। এগুলো মানবজাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণেই কোটি কোটি মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে। নিজেদের জান, মাল সব কিছুকে নিরাপদ ভাবতে পারে। সেই আশীর্বাদ এই হতভাগা জাতির জন্য অভিশাপ হয়ে পড়ছে।
কারণ রাষ্ট্র যদি রক্ষকের ভূমিকা থেকে ভক্ষক হয়ে পড়ে, তখন সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কেই প্রশ্ন দেখা দেয়। রাষ্ট্রশক্তিকে এই ধরনের অপকর্মে নিয়োজিত করলে আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণাটি মারাত্মক ধাক্কা খায়।
শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি ছাড়া একটি রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এ ধরনের সিভিল সোসাইটির অভাবে আমরা বোধ হয় চূড়ান্ত পরিণামের দিকে অগ্রসর হতে চলেছি। চারদলীয় জোট সরকারের সময় যে দুটি পত্রিকা কিছু না দেখেই বাঘ বাঘ বলে চিৎকার দিয়েছে, আজ সত্যিকারের বাঘ দেখেও সেই রাখাল বালকেরা চুপ।
সরকারের মানসিকতা অনেকটা সেই সুয়ো রানীর মতো, যিনি দুয়ো রানীর ছেলেকে পাঠিয়েছেন বাঘ শিকার করতে। সতিনের ছেলে কিংবা বাঘ যেটিই মরুক সেটিতেই লাভ।
এই হিসাব এবার পাল্টে যেতে পারে। কিছু ইস্যু সরকারের জন্য মারাত্মক গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এক দু’টি ব্যাংক যদি ধ্বংস হয়ে যায় তবে লুটেরা চরিত্রের আরেকটি নমুনা প্রতিষ্ঠিত হবে।
গ্রামীণব্যাংক ও কিছু ব্যাংক উভয়েই প্রচলিত ব্যাংকিং ধারার বাইরে বিশেষায়িত ব্যাংক। গরিব মানুষ যাদের টাকা নেই তারা আবার ব্যাংক করে কিভাবে? ব্যাংকিং মোগলদের এই ধরনের নাক সিঁটকানোর বিপরীতে ভিন্ন কিছু ব্যাংকিং-ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু দাঁড়িয়েই যায়নি, তারা আন্তর্জাতিক পরিসরে সুনাম ছড়ানো ব্যাংক এবং দেশের বৃহত্তম বেসরকারি ব্যাংক হয়ে পড়েছে।
কাজেই এটি যারা শুরু করেছেন বা আজকের পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, ভালো হোক কিংবা মন্দ হোক, এটি তাদের শুধু জাগতিক সম্পদ নয়, এটি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি। রাষ্ট্রশক্তির অপপ্রয়োগে বা ছলে বলে কৌশলে এটি তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অন্যায়, মহা অন্যায়।
আমাদের দেশের উন্নতি দেখে নাকি বিদেশীরা তাজ্জব(?) বনে গেছে! এই ‘তাজ্জব’ বনে যাওয়ার খবর আবার আমরা শুনি কর্তাব্যক্তিদের মুখে। প্রকৃতপক্ষে সারা বিশ্বের মানুষ তাজ্জব হচ্ছে অন্য কিছু দেখে।
ঢাকা থেকে পায়রাবন্দর পর্যন্ত ২৪০ কিলোমিটারের একটি রেলপথ তৈরি করতে খরচ ধরা হয়েছে ৭৫০ কোটি ডলার বা ৬০ হাজার কোটি টাকা। মাত্র ১০ হাজার টাকার একটা ভুঁইফোড় ব্রিটিশ কোম্পানির সাথে এই কাজের জন্য সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে রেলওয়ে। এতে দেখা যায়, কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ৩ কোটি ১২ লাখ ডলার বা প্রায় ২৪৫ কোটি টাকা।
দক্ষিণ এশিয়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক সিঙ্গেল ট্র্যাকের লাইন, সিগন্যালিং ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে খরচ হয় সর্বোচ্চ ২৩ কোটি থেকে ৩১ কোটি টাকা। কোথায় ২৪৫ কোটি আর কোথায় ৩১ কোটি !
কাজেই এই ‘উন্নতি’ দেখে বিদেশীরা অবাক না হলে আর কী দেখে হতবাক হবেন? মূলত পুরো দেশটিই যেন হয়ে পড়েছে গণিমতের মালের মতো।
minarrashid@yahoo.com
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন