পশ্চিমবঙ্গের ভানু বন্দ্যোপধ্যায়ের একটি কৌতুকের ক্যাসেট অনেকেই শুনেছেন। এক লোক তার উকিলের কাছে যায় আর মামলা নিয়ে ক্রমবর্ধমান টেনশনের কথা জানায়। উকিল বারবার আশ্বস্ত করে, ‘চিন্তা কোরো না, আমার ওপর ভরসা রাখো।’ উকিল মহাশয়ের ওপর এভাবে ভরসা করতে করতে একদিন ফাঁসির হুকুম হয়ে যায়। সেই সুখবর উকিল মহাশয়কে জানালে বলেন, ঝুইলা পড়ো, আমি তো আছিই। নেক্সট ... বাংলাদেশের মানুষকে একই কিছিমে দুইটা রশিতে ঝুইলা পড়তে পরামর্শ দিচ্ছেন হাইব্রিড এবং নরমাল উভয় ব্রিডের নেতানেত্রীরা। প্রথম রশিটি হলো রামপালের কয়লা বিদ্যুৎ কারখানা। দ্বিতীয় রশিটি হলো, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন ও সার্চ কমিটি। একটিতে ভরসার জায়গা জাতির পিতার কন্যা, যিনি দেশের ক্ষতি হবে এমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবেন না। নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিয়ে একইভাবে আমাদের পরম ভরসার জায়গা প্রেসিডেন্ট মো: আবদুল হামিদ। খুশিমনে এই দুই রশিতে ‘ঝুইলা’ পড়া ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর নেই।
এই দুটির মধ্যে আজকের লেখার বিষয়বস্তু মূলত রামপালের কয়লা বিদ্যুৎ কারখানা নিয়ে। দেশবাসীকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, এটা এমন আলট্রা মডার্ন পদ্ধতিতে করা হবে যে সুন্দরবনের কিচ্ছু হবে না। Ultra Super Critical বা USC তাপবিদ্যার একটি নির্দোষ টার্ম। এই শব্দটি এখন এক ধরনের ভেলকি বা বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। সত্তর দশকের শেষ দিকে স্কুলজীবনে সদর উদ্দীন স্যার নামে এক মজার শিক্ষককে পেয়েছিলাম। সেই স্যারের বলা একটি গল্পের সাথে সুপার ক্রিটিক্যালের ভেলকি চমৎকারভাবে মিলে যাচ্ছে।
এক গ্রামে এক চতুর বালক ছিল। চাতুর্যপূর্ণ কথা দিয়ে সে গ্রামের সব মানুষকে ভড়কে দিত। তার মনে হলো লেখাপড়া শিখলে তার এই বুদ্ধির প্রখরতা আরো বেড়ে যাবে। গ্রামে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে রাজধানী শহরে গমন করে। কিন্তু বুদ্ধির আগে যাদের চিকনাবুদ্ধি হয়ে যায়, তাদের তো আর লেখাপড়ার প্রয়োজন হয় না। রাজধানীতে গেলেও কোনো স্কুলে ভর্তি হয়নি।
সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি দ্বিতীয় ধাপের দূষণ একটু কমিয়ে আনলেও প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ পরিবহন ক্ষেত্রে এবং তৃতীয় ধাপে বর্জ নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘সুপার ক্রিটিক্যাল’ মেকানিজম কোনো কাজেই আসবে না। অথচ এই শব্দটি দিয়ে দেশের মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এই প্ল্যান্টটি চালাতে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টনের মতো কয়লা পোড়ানোর প্রয়োজন পড়বে। গড়ে একটি জাহাজে ৫০ হাজার টন কয়লা বহন করলে বছরে ১০০টি জাহাজ অর্থাৎ প্রতি সপ্তাহে দু’টি মাঝারি সাইজের সমুদ্রগামী জাহাজ আকরাম পয়েন্টে আসতে হবে। আকরাম পয়েন্ট থেকে ছোট জাহাজ বা বার্জে করে রামপালে প্ল্যান্টের কাছে নেয়া হবে। এসব ছোট জাহাজের ধারণক্ষমতা দুই হাজার টন করে হলে একটি বড় জাহাজ খালি করতে ২৫টি ছোট জাহাজ লাগবে। অর্থাৎ সপ্তাহে ৫০টি জাহাজ ১০০ বার আকরাম পয়েন্ট থেকে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে চলাচল করবে। এসব জাহাজ থেকে ছড়িয়ে পড়া ধুলা-ময়লা-তেল-আবর্জনা কিংবা চলাচল পথে সৃষ্ট শব্দ ও আলো পুরো এলাকার জীববৈচিত্র্যকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। লেখার কলেবর বড় হয়ে যাবে বলে সেসবের বিস্তারিত বর্ণনায় যাচ্ছি না।
যারা জাহাজের ব্যবসা কিংবা জাহাজসংক্রান্ত কাজে জড়িত তারা জানেন যে কয়লা একটা অত্যন্ত ময়লা কার্গো বা ডার্টি কার্গো হিসেবে গণ্য হয়। ছাই ফেলতে যেমন ভাঙা কুলা, তেমনি কয়লা বহনেও পুরনো এবং ভাঙাচোরা জাহাজই বেশি ব্যবহার করা হয়।
সরকারের প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছে এগুলো ডায়মন্ডের মতো ঢেকেঢুকে লোডিং এবং ডিসচার্জ করা হবে। সমুদ্রগামী জাহাজের হোল্ড পরিবহনের সময় ঢাকা থাকবে সত্য কিন্তু সেই জাহাজ যখন আকরাম পয়েন্টে এসে লাইটারিং বা ছোট জাহাজে নামানো হবে তখন তা উন্মুক্ত করেই তা করা হবে। জাহাজকে যত ক্রিটিক্যাল, সুপার ক্রিটিক্যাল কিংবা সতীসাধ্বীই বানানো হোক- এই কাজটি কাপড় খুলেই করতে হবে। শরীর পুরো ঢেকে করা যাবে না।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটের ছোট জাহাজ বা বার্জগুলোর অবস্থা সবারই জানা রয়েছে। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম যে এগুলোকেও আন্তর্জাতিক মানের সতীসাধ্বী বা সরকারের চাপামত ‘আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল’ বানানো হবে। তার পরেও ন্যূনতম দু’বার এদের গায়ের কাপড় খুলতে হবে। একবার আকরাম পয়েন্টে, অন্যবার প্ল্যান্টের গুদামে রাখার সময়। কাজেই সরকারের পক্ষ থেকে যে ঢাকনা দেয়া কনভেয়র বেল্টের কথা বলা হচ্ছে, তা এই প্রসেসের সব জায়গায় ব্যবহার করা সম্ভব হবে না।
এ সব কিছুর কারণে জাহাজকে স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে গণ্য করা হয়। নারীদের মতো জাহাজের বেশ কিছু জায়গা ওয়াটার টাইট করে রাখতে হয়। তাকে সর্বদা পেইন্ট বা লিপস্টিক মেরে রাখতে হয়। ঢেকে রাখলে যত সুন্দর লাগে- খুলে রাখলে তত অসুন্দর লাগে, তত পরিবেশ দূষণ করে। বলা হয়ে থাকে, 16 biggest ships of the world create as much pollution as all the cars in the world. অর্থাৎ পৃথিবীর ১৬টি বৃহত্তম জাহাজ যে পরিমাণ পরিবেশদূষণ করে, তা সমগ্র বিশ্বের সব মোটরগাড়ি মিলেও করে না। কাজেই এই পরিবেশদূষণের রানী জাহাজকে সুন্দরবনের যত কাছে নেয়া হবে, ততই তার ক্ষতি হবে। আগেই বলেছি, এই জাহাজগুলো হবে পুরনো। জাহাজ যত পুরনো হয় তার দূষণমাত্রা তত বেড়ে যায়।
পরিবেশদূষণের এই হিসাব হলো পরিবেশবিষয়ক সব নিয়মকানুন মেনে চলার পর। আর যেখানে নিয়ম না মানাই নিয়ম, সেখানে কী হবে- তা আল্লাহ মালুম।
আমার উনিশ-বিশ বছরের সমুদ্র জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ইউরোপ আমেরিকার উপকূলে কেউ সামান্য কালো ধোঁয়া বা এক ফোঁটা তেল ফেলার কথা কল্পনাতেও আনতে পারে না। ওখানে গেলে সবাই সচেতন নাগরিক হয়ে পড়ে। অথচ সেই অফিসাররাই তৃতীয় বিশ্বের বন্দরগুলোতে এসে বুদ বুদ করে কালো ধোয়া বা গলগল করে তেল কিংবা অন্যান্য পলুটেন্ট পানিতে নিক্ষেপ করে দেয়। তৃতীয় বিশ্বে অনেক ভুয়া কোম্পানি বা এজেন্ট রয়েছে, যারা জাহাজের গার্বেজ বা তেল সযত্নে ডিসপোজাল করার ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদান করে। ইউরোপ বা বিদেশী কোনো বন্দরে পোর্ট স্টেইট কন্ট্রোল অফিসার যখন কয়েক বছর রাজধানীর কোনো দোকানে ফুটফরমায়েশ খেটে কিছু পয়সা উপার্জন করে। তা দিয়ে সস্তা পুরনো এক সেট কোট প্যান্ট কিনে নেয়। গ্রামে ফেরার আগে শহরের একটি স্কুলের পাশে যায়। সেই স্কুলে শিক্ষক তার ছাত্রদেরকে ইংরেজি ব্যাকরণ পড়াচ্ছিলেন। সেখান থেকে preposition, conjunction এবং interjection-সহ এই ধরনের কিছু বোম্বাশটিক ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করে নেয়।
গ্রামে এসে এই কয়েকটি শব্দ দিয়ে পুরো গ্রামকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। একজনকে বলে, এই ব্যাটা তোরে preposition করে ফেলব। আরেকজনকে বলে, এই ব্যাটা তোর conjunction ছুড়ে ফেলব। অন্যজনকে ধমক দেয়, তোকে interjection-এ পাঠিয়ে দেবো।
এই চতুর বালকটির মতো সরকার দেশের মানুষকে অজ্ঞান করেছে। সুন্দরবনের পাশে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ নিয়ে যখনই দেশের মানুষ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে তখনই সরকার এবং সরকার সমর্থক কিছু তথাকথিত বিশেষজ্ঞ আন্ডার ক্রিটিক্যাল, ক্রিটিক্যল এবং সুপার ক্রিটিক্যাল শব্দ উচ্চারণ করে জনগণের মাথা গুলিয়ে দিতে চায়। সারা বিশ্বের পরিবেশবিদ ও পরিবেশবিজ্ঞানীদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠাকে ক্রিটিক্যাল ও সুপার ক্রিটিক্যাল শব্দ দিয়ে ঢেকে ফেলতে চায়।
সুন্দরবন নিয়ে জনগণকে preposition, conjunction এবং interjection করে ছাড়ছে। এই কাজে ব্যবহার করছে কুশিক্ষিত মতলববাজ কিছু বিশেষজ্ঞকে।
খুব সহজ কথায় বলা যায়, এ ধরনের প্ল্যান্ট করলে কয়েকটি জায়গায় পরিবেশদূষণের কথা বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথম হলো কয়লা পরিবহনের ক্ষেত্র। দ্বিতীয় পর্যায়ে সেই কয়লা পোড়ানোর সময়। তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে লাখ লাখ টন অ্যাশ বা ছাই ডিসপোজাল বা নিরাপদে নিষ্কাশন করা। জিজ্ঞেস করে, জাহাজে সৃষ্ট ময়লা (Garbage) বা নষ্ট তেল (Sludge) কোথায় ফেলেছ? তখন বাংলাদেশের মতো কোনো দেশের ডিসপোজাল কোম্পানির সেই সার্টিফিকেট বুক ফুলিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়।
এটা হিউম্যান টেন্ডেন্সি। সাদা-কালো-ধলো-বাদামি সবাই এই টেন্ডেন্সি অনুযায়ী কাজ করে।
সারা দেশে যেখানে আইন কানুনের কোনো বালাই নেই, সেখানে হঠাৎ করে সুন্দরবনের রামপালে কিংবা আকরাম পয়েন্টে কিছু ফেরেশতা চলে আসবে কিংবা ইউরোপ আমেরিকার মতো নিয়ম মানা হবে- এটা দুনিয়ার সবচেয়ে নির্বোধ লোকটিও বিশ্বাস করবে না। কাজেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ‘এই করেঙ্গা, সেই করেঙ্গা’ বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার কিছুই করা হবে না। এই কাজের জন্য প্ল্যান্টের ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান ও সাবকন্ট্রাক্টররা সস্তা, সহজ ও লাভজনক পদ্ধতিই অনুসরণ করবেন। পরিবেশ রক্ষার জন্য নির্ধারিত ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কেমিক্যালের পয়সা হবে দুই পয়সা কামানোর উপায়। কারণ কোনো অডিটরের বাবাও এটা ধরতে পারবে না।
পরিবেশমন্ত্রী বলেছেন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সার্বক্ষণিক পরিবীক্ষণের জন্য পরিবেশ অধিদফতর, বিপিডিবিসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বয়ে মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে।
কাজেই এই উকিলের কথায় ‘ঝুইলা’ পড়ার আগে আরেকটি বিষয় স্মরণ করলে ভালো হবে।
আমরা দেখেছি, একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে আমাদের প্রেসিডেন্ট সব দলের সাথেই সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্টের হিউমারাস স্বভাবের জন্য জাতির আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল মাপের একটা প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু সার্চ কমিটি করেছেন নাসিম, তোফায়েল ও কাদেরদের সব ক্রিটিক্যাল সুবিধা বিবেচনা করেই। ষোলো কোটি জনগণ এবং বাইরের আরো কয়েক কোটি সতর্কদৃষ্টির সামনে এই কাজটি করতে যে দেশের প্রেসিডেন্টের বিবেকে একটুও লাগেনি- সেখানে সব লোকচক্ষুর আড়ালে, সুন্দরবনের গহিন জঙ্গলে পরিবেশ অধিদফতরের অত্যন্ত সাধারণ মানের একজন মাঠকর্মকর্তার বিবেকের তাগিদ জেগে উঠবে- সেটা বিশ্বাস করতে একটু কষ্ট হয় বৈকি। কাজেই কোনো মহান পিতার কন্যা নহে, সেই পিতার পিতামহ আশ্বস্ত করলেও এই সুন্দরবনকে আর বাঁচানো যাবে না।
দুই .
এ দেশের মিডিয়া ও শিক্ষিত সমাজ বামপন্থীদের বিশেষ সমীহের চোখে দেখে থাকেন। এ দেশে অনেক কাগুজে বাঘের সৃষ্টি হয়েছে এই সমীহ থেকে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় এদের নখ তেমন ধারালো না হলেও এদের গর্জনে অনেক কাজ হয়। বিশেষ করে এদের গর্জনে বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী ঘরানার লোকজন মারাত্মক ভয় পায়। তবে বামপন্থীদের জীবন কৌটাটি নিজের কব্জায় থাকায় আওয়ামী লীগের কাছে এরা তেমন কোনো পাত্তা পায় না।
সুন্দরবন রক্ষার জন্য রামপালের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বে রয়েছেন বাম ঘরানার প্রফেসর আনু মুহাম্মদ। বিএনপিসহ জাতীয়তাবাদী ঘরানার লোকজন এতে সম্পৃক্ত হতে চাইলে আনু মুহাম্মদেরা কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে তাদেরও সরিয়ে রাখছেন। সুন্দরবন রক্ষার জন্য হরতালের দিনে একজন স্মার্ট ও যুবতী চালকের পেছনে মোটরসাইকেলে বসে মহড়া করেছেন আনু মুহাম্মদ। এতে গান্ধীর মতো নিজের ইন্দ্রিয় জয় কিংবা অমৌলবাদের সত্যায়ন হবে সত্য কিন্তু তাতে সুন্দরবন কতটুকু রক্ষা হবে সেই সন্দেহ থেকেই যায়। ফলে এই আন্দোলনটি এ দেশের বামপন্থীদের একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাস হিসেবেই রয়ে গেছে। অথচ এটি আমাদের জীবন-মরণ সমস্যা। সবাইকে সাথে নিয়েই এই আন্দোলনটি শুরু করা জরুরি।
বিশ্ব পরিবেশবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইউনেস্কোও বারবার তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখানেও ড. ইউনূসের কালো হাত ও কালো টাকার প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। ইউরোপ, আমেরিকার অনেক নাম না জানা সংস্থা টাকা ছাড়াই সরকারের পক্ষে সাফাই গান, সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করেন, আমাদের ডমেস্টিক মিডিয়া সোৎসাহে সেই খবর প্রচার করে। কিন্তু জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো যখনই সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা করেন তখনই তা ড. ইউনূস বা অন্য কারো টাকা খেয়েই তা করেন।
সরকারের সাথে সংযুক্ত পরিবেশবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বড় পরিবেশ বিজ্ঞানী পৃথিবীতে আর কেউ নেই এবং জাতির পিতার কন্যার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক এই দেশে আর নেই। এই দু’টি কথার ওপর ঈমান রেখে বিষ পান করলেও কিচ্ছু হবে না।
রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পটি সুন্দরবন এলাকা থেকে দেশের অন্যত্র সরানো যাচ্ছে না কেন? এই ‘রাজাকারী’ প্রশ্নটি আজ দেশের ছোট বড় সবার মনেই উঁকি দিচ্ছে। এটা কি শুধু ইন্ডিয়ার আর্থিক স্বার্থে নাকি অন্য কোনো বড় স্বার্থও এর পেছনে কাজ করছে?
এই ভূখণ্ডটি এমনিতেই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের হুমকিতে রয়েছে। দেশের উপকূলীয় এলাকার এক বিরাট অংশ তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সুন্দরবন ধ্বংস হলে এই কাজটি আরো ত্বরান্বিত হবে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কমিয়ে এই দেশটিকে রক্ষা করছে সুন্দরবন। সুন্দরবন ধ্বংস হলে এর পরিবেশগত ক্ষতির পরিমাণ আমরা কল্পনাতেও টানতে পারব না।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বরাবরের মতো নগদ লাভ তো রয়েছেই, ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ৫০ শতাংশ মালিকানা। তা ছাড়া এই দেশের পরিবেশগত বিপর্যয় ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক এবং সামরিক হুমকি অনেকটা কমিয়ে আনবে।
জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান নামক দেশটি ভারতের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিভক্তির মাধ্যমে ভারতের সেই মাথাব্যথা অনেকটা কমে গেলেও টেনশন পুরোপুরি দূর হয়নি। স্বাধীনতা লাভের তিন বছরের মধ্যেই যেভাবে ভুট্টোকে ডেকে এনে শেখ মুজিব তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, তা দেখে ইন্ডিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল। যে ঘৃণাটি জিইয়ে রাখার দরকার ছিল যুগ যুগ ধরে, তা এই দু-তিন বছরেই উবে গেল দেখে ইন্ডিয়া দারুণ হতাশ হয়ে পড়েছিল। এক পাকিস্তান ভেঙে এখন দুই পাকিস্তানের দুঃস্বপ্ন তাদের তাড়া করে ফিরেছে। ১৯৭৫ সালে ১৬ আগস্ট ইন্ডিয়ান হাইকমিশনার যখন খন্দকার মোশতাকের সাথে সাক্ষাৎ করেন, তখন তার হাসিটি সম্ভবত এ কারণেই এতটুকু বিস্তৃত হয়েছিল। নতুন প্রজন্মের এই ছবিগুলো দেখা দরকার এবং তা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করা দরকার।
আজ শেখ মুজিবের ছবিকে ব্যবহার করে দেশের স্বার্থ যেভাবে বিকিয়ে দেয়া হচ্ছে, মুজিব বেঁচে থাকলে তা সম্ভব হতো না।
ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দু’টি দেশ পাকিস্তান আর বাংলাদেশ আর কখনোই এক হতে পারবে না। বাস্তবতার নিরিখে এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। একজন পাগলও এখন পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সংযুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখবে না। তার পরেও এ দেশের কিছু বিশেষ ব্যক্তি পাকিস্তানকে নিয়ে সর্বদা দুঃস্বপ্ন দেখেন, জলাতঙ্কের মতো পাকিস্তানাতঙ্ক ছড়ান। মূলত দুই পাশে দুই পাকিস্তান নিয়ে ইন্ডিয়ার দুঃস্বপ্ন আর টেনশনটিই এদের মধ্যেই সঞ্চারিত হয়ে পড়েছে।
চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক যে জায়গায় পৌঁছে গেছে, সেটাও ইন্ডিয়ার টেনশন বাড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালও চীন-পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বাংলাদেশকে ভেসাল স্টেইট বানিয়ে ফেললেও চীনের সাথে লিংক পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশের সরকারকে পাপেট বানিয়ে ফেললেও জনগণের মধ্যে ইন্ডিয়ানবিদ্বেষ দিন দিন আরো বেড়ে যাচ্ছে।
এমতাবস্থায় পরিবেশগত বিপর্যয় ও জলবায়ুর কারণে এ দেশের বিরাটসংখ্যক মানুষ ইউরোপ আমেরিকাসহ অন্যত্র মাইগ্রেট হতে বাধ্য হলে ইন্ডিয়া ‘আনহ্যাপি’ হবে না। তা ছাড়া একটি দেশ প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কখনোই সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে না। নিজেদের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তারা কখনোই প্রতিবেশীর জন্য হুমকি হতে পারবে না। এ কারণেই ইন্ডিয়ার দরকার সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এ দেশে গণতন্ত্র চালু থাকলে কখনোই রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে সুন্দরবন ধ্বংস করা যাবে না। কাজেই এই প্যাকেজটি শুরু হয়েছে তথাকথিত এক-এগারো থেকেই। এক-এগারোর রোডম্যাপ ধরেই এখনো আমরা হাঁটছি। কেউ কেউ এই প্রকল্প বন্ধ করতে নরেন্দ্র মোদির কাছে আহ্বান জানান। এই রোডম্যাপ ধরে চলে যারা রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের স্বপ্ন দেখছেন তারা মূলত বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
কাজেই বিএনপিসহ সব বিরোধী পক্ষের প্রতি একটাই আবেদন, যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দেশ ও জাতিকে বাঁচান। দেশ বাঁচলে, জাতি বাঁচলে দেশের জনগণই আপনাদের ক্ষমতায় বসাবে- রামপাল প্রকল্পের পেছনের কোনো গোপাল আপনাদের কখনোই ক্ষমতায় বসাবে না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন