নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের সহায়তায় ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয় সত্ত্বেও এবং এ দুইকেই আবার ব্যবহার করার ষোলআনা সম্ভাবনা সত্ত্বেও আগামী নির্বাচনে নির্বাচনী মিত্র সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তার চিন্তা এখন আওয়ামী লীগকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ভোট পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য মিত্রের চরিত্র যাই হোক, আওয়ামী লীগের যে তাতে আপত্তি ও অসুবিধা নেই, এটা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাদের সমঝোতা থেকে পরিষ্কারভাবেই বোঝা যায়। ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলদের সঙ্গে সুবিধাবাদী সমঝোতা এটাই তাদের প্রথম নয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময় তারা জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল।
পরে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে তারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার করে নিজামীসহ তাদের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দিলেও তারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দলটির বিচার করেনি! এ ব্যাপারের সঙ্গে যদি তাদের প্রকৃত কোনো আদর্শিক সম্পর্ক থাকত তাহলে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় যাওয়ার পর তারা জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারের ব্যবস্থা করত। কিন্তু তারা তা করেনি। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, গণহত্যা ইত্যাদির কথা বলে তারা যেভাবে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার করে তাদের নেতাদের ফাঁসি দিয়েছে এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মানবিকতা ইত্যাদির কোনো সম্পর্কই যে নেই এটা গাধাবুদ্ধির মানুষের পক্ষেও বোঝা সহজ।
এখন তারা আগামী নির্বাচনে হেফাজতে ইসলামের লোকজন ও সমর্থকদের নিজেদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহারের জন্য তাদের সঙ্গে এক বিপজ্জনক সমঝোতা করেছে। এই সমঝোতার বিপজ্জনক দিক লক্ষ্য করে আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তাদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের বিবৃতি, সংবাদপত্র সাক্ষাৎকারে তাদের বিচলিত বক্তব্য বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এখানে লক্ষ্য করার বিষয়, এই সুবিধাবাদী এবং আওয়ামী লীগের থেকে নানাভাবে সুবিধাভোগী এই বুদ্ধিজীবীরা জনগণের ওপর আওয়ামী লীগ যেভাবে সর্বক্ষেত্রে তাদের শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, কঠোর হস্তে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে বিরোধী পক্ষের সভা-সমিতি-মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং অন্যান্যভাবে ব্যাপক হামলা করে, সেসবের বিরুদ্ধে এই বুদ্ধিজীবীদের কোনো সময় প্রতিবাদ করতে দেখা না গেলেও ‘সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী’ এই বুদ্ধিজীবীরা হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন! এটা এক উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। কারণ এর থেকে আওয়ামী লীগের অবস্থার শোচনীয়তার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ও ভোট দেয়ার ব্যাপারে অনেক ‘অসাম্প্রদায়িক’ ব্যক্তিকেই বলতে শোনা যায়, সরকার থেকে আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দিলে তার জায়গায় সাম্প্রদায়িকতাবাদী বিএনপি ক্ষমতায় আসবে এবং তার ফলে দেশের সর্বনাশ হবে! কিন্তু জামায়াতে ইসলামী থেকে নিয়ে অন্য সাম্প্রদায়িকতাবাদী সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রী ও সমঝোতা বিএনপি যেভাবে করে এসেছে, তার থেকে আওয়ামী লীগের এই একই ধরনের মৈত্রী ও সমঝোতার তফাৎ কী? কোন হিসেবে আওয়ামী লীগ বিএনপির থেকে কম সাম্প্রদায়িক? শুধু ক্ষমতার গদিতে বসে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’, অসাম্প্রদায়িকতার বুলি আউড়িয়ে গেলেই কি আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক ভাবতে হবে? মুক্তিযুদ্ধের কোন চেতনা থেকে জামায়াতে ইসলামী, খেলাফতে মজলিস, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধন ও সমঝোতা করা যায়?
একথা কি ভুলে যাওয়ার উপায় আছে যে, ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল খেলাফতে মজলিসের নেতা শায়খুল হাদিস মওলানা আজিজুল হকের সঙ্গে এক পাঁচ দফা চুক্তি করেছিলেন, যার এক দফা ছিল ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগ ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন করে ইসলামবিরোধী বক্তব্য দানকারীদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি পর্যন্ত দেবে? এ অবস্থায় আওয়ামী লীগকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র একমাত্র স্বত্বাধিকারী হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করলেই হবে না, তারা এটা বলতে কী বোঝায় সেটাও জনগণের কাছে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে। এ দাবি কি এখন আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে করবেন?
আওয়ামী লীগ আগে হেফাজতে ইসলামের মূল ভিত্তি কওমি মাদ্রাসাকে জঙ্গি তৈরির কারখানা হিসেবে চিত্রিত ও ঘোষণা করলেও দু’দিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, কওমি মাদ্রাসাগুলো জঙ্গি তৈরির কারখানা নয়! (যুগান্তর, ২৩-০৪-২০১৭, পৃষ্ঠা-৭; সমকাল, ২৩-০৪-২০১৭, পৃষ্ঠা-১৭)। অর্থাৎ তারা ধোয়া তুলসীপাতা!! আওয়ামী লীগ নিশ্চয় আশা করছে যে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ ধারক-বাহক হিসেবে ‘অসাম্প্রদায়িক’ বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জনগণের সমর্থনের সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম ও তাদের মতো ধর্মীয় সংগঠনের সমর্থকদের ভোট নিজেদের ঝুড়িতে ফেলে আবার সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীন হবে।
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ স্বত্বাধিকারী হিসেবে নিজেকে অহরহ প্রচার করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ধারণা আগামী নির্বাচন হবে ধর্মযুদ্ধের মতো একটা ব্যাপার। শুধু তাই নয়, তাদের নিশ্চয়ই ধারণা যে, এই আসন্ন ধর্মযুদ্ধে ভোটারদের মধ্যে ধর্মের সপক্ষ শক্তির পাল্লাই ভারি! কাজেই এ নির্বাচনে জয়যুক্ত হওয়ার জন্য যারা দলে ভারি তাদের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা বেশি দরকার! এই গাঁটছড়া বাঁধতে গিয়ে যদি অসাম্প্রদায়িকতার গাঁটছড়া আলগা হয়ে যায় তাতে অসুবিধা নেই!! কাজেই এই নির্বাচনী ধর্মযুদ্ধে আওয়ামী লীগ এখন বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী!!
তবে আওয়ামী লীগের এই ধারণা সত্ত্বেও আসন্ন নির্বাচন কোনো ধর্মযুদ্ধ হবে, এটা মনে করার কারণ নেই। দেশের লোক এখন আগের থেকে অনেক বেশি নামাজ, রোজা ইত্যাদি ধর্মকর্ম করলেও নির্বাচনে ধর্ম কোনো হিসাবযোগ্য বিষয় হবে এর কোনো ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মানুষ লুণ্ঠনজীবী শ্রেণীর একের পর এক সরকারের অধীনে জীবন কাটিয়ে এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার’ বুলি যেমন তাদের কাছে অন্তঃসারশূন্য এবং অপ্রাসঙ্গিক, তেমনি যারা ধর্মের লেবাস পরে রাজনীতি করেন তাদের মুখোশও জনগণের কাছে আজ উন্মুক্ত। এ কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অথবা ধর্ম- কোনো আওয়াজ দিয়েই মানুষকে প্রভাবিত ও আকর্ষণ করে ভোটের বাক্স ভারি করা যাবে না।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এই উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা জনগণের, তাদের শ্রমের ফসলই হল বাংলাদেশের উন্নয়ন। কিন্তু এর ছিটেফোঁটা জনগণের কাছে এলেও এর বিশালবিপুল অংকই হস্তগত করেছে এবং করে চলেছে লুণ্ঠনজীবী শ্রেণীর বিভিন্ন অংশ- ব্যবসায়ী, শিল্প মালিক, সরকারি আমলা-কর্মচারী, শাসক শ্রেণীর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী বিশেষত ক্ষমতাসীন অংশ, ভূমিদস্যু, কালোবাজারি, চোরাচালানি, মাদক ব্যবসায়ী, এমনকি নব্য মধ্যশ্রেণীভুক্ত ও প্রধানত সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ধরনের শিক্ষিত ব্যক্তি ও সংস্কৃতিকর্মী। বাংলাদেশের যা কিছু উন্নয়ন সব এরাই লুটপাট করছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সারা শরীরের রক্ত যদি মুখে এসে জমা হয়, তাহলে তাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না।
বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। সামান্যসংখ্যক লোকের হাতে এখন যেভাবে দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, তাতে এদেশের উন্নয়ন নিয়ে লাফালাফি অথবা উচ্চকণ্ঠ হওয়ার কিছু নেই। বঞ্চিতদের যে ক্ষোভ অভিব্যক্তির কোনো পথ না পেয়ে সমাজজীবনে উত্তাপ সৃষ্টি করে রেখেছে, সেটাই হবে আগামী নির্বাচনে এক নির্ধারক ব্যাপার। নির্বাচন যদি মোটামুটি নিরপেক্ষ হয় এবং নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ যদি বড় আকারে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের নেতিবাচক ভোটই নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে, যা পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণভাবে দেখা গেছে। এসব বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রতিক্রিয়াশীল কতকগুলো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আওয়ামী লীগ কোনো প্রকৃত রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়নি। এর মধ্যে তাদের শোচনীয় অবস্থার প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন