দুনিয়ায় পরিবেশ দূষণ দীর্ঘদিন ধরে চলে এলেও গত দুই-তিন দশকে এর ভয়াবহ দিক খুব স্পষ্টভাবে দেখা দেয়ায় এই দূষণ একেবারে বন্ধ করা না হলেও কমিয়ে আনার জন্য বিশ্বজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাষ্ট্র পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর ফলে ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটোতে জাপান এবং ইউরোপের সব গুরুত্বপূর্ণ দেশই কার্বন ডাই-অক্সাইড কমিয়ে আনার জন্য এক চুক্তি করে। কিন্তু সেই চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত স্বাক্ষর করেনি, যদিও এই তিন দেশই সব থেকে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড ছেড়ে থাকে। তবে দ্রুত পরিবেশ দূষণ পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকায় শেষ পর্যন্ত চীন ও ভারত এবং পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শিল্প-কারখানায় এই গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সম্মত হয়। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত পরিবেশ সম্মেলনে ২০০৫ সালের লেভেল থেকে ২৬-২৮ শতাংশ গ্যাস নির্গমন কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়, যাতে করে সারা বিশ্বে শিল্প-পূর্ব যুগের থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা যায়।
চীন হচ্ছে সব থেকে বেশি পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গতকারী দেশ। তার পরই স্থান হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এ দুই দেশ মিলে দুনিয়ায় মোট কার্বন ডাই-অক্সাইডের ৪০ শতাংশ নির্গমন ঘটিয়ে থাকে। কাজেই এদিক দিয়ে প্যারিস পরিবেশ চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা এক বড় রকম ক্ষতিকর ব্যাপার। জাতিসংঘের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত ০.৩ ডিগ্রি তাপ বাড়িয়ে রাখবে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি জয়লাভ করলে প্যারিস পরিবেশ চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করবেন। কারণ এই চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাখ লাখ কোটি ডলার ক্ষতি হবে। যার প্রকৃত অর্থ তেল ও কয়লা ব্যবসায়ীদের লাভ কম হবে এবং প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে না। এজন্য তিনি আওয়াজ তোলেন, America First। আসলে তার এই আওয়াজের মর্মার্থ হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও কয়লা স্বার্থ ফার্স্ট। তাদের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই তিনি এ কাজ করেছেন। পরিবেশ সমস্যাকে তিনি ‘ধাপ্পাবাজি’ আখ্যায়িত করে প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার স্বার্থের অগ্রাধিকারের কথা বলে আমেরিকার জনগণকে বড় রকম ধাপ্পা দিয়েছেন।
১ জুন ট্রাম্প এভাবে প্যারিস চুক্তি থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তারা বলেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে বাইরে আসার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও তারা চুক্তি অনুযায়ীই চলবে। নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে জনবহুল রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবে এবং অন্যান্য রাজ্যের প্রতিও তারা এই বিরোধিতার আহ্বান জানিয়েছে। প্যারিস চুক্তি থেকে বের হওয়ার এক অজুহাত হিসেবে ট্রাম্প বলেন, তিনি প্যারিস নয়, পিট্স্বার্গের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এর জবাবে পিট্স্বার্গের মেয়র এক টুইট বার্তায় বলেছেন, তিনি তাদের জনগণ, তাদের অর্থনীতি ও তাদের ভবিষ্যতের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে প্যারিস চুক্তির নিদের্শই অনুসরণ করবেন!
সমগ্র মানবজাতি এবং আমাদের এই ধরিত্রী এখন এক বিপজ্জনক পরিবেশ সংকটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কার্বনের কারণে দুনিয়ার উত্তাপ বাড়ছে এবং এই উত্তাপ বৃদ্ধি এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর বরফ গলতে শুরু করেছে। এর ফলে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধি সারা দুনিয়ার সমুদ্র উপকূলকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। কিন্তু এর ফলে সব থেকে বড় বিপদ হবে প্রশান্ত, অ্যাটলান্টিক, ভারত মহাসাগর থেকে নিয়ে অন্য সাগরগুলোতে অবস্থিত হাজার হাজার দ্বীপ দেশগুলোর। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি এক পর্যায়ে গেলে সেগুলো পানির তলায় চলে যাবে অর্থাৎ নিশ্চিহ্ন হবে। এর ফলে কী বিপর্যয় দেখা দেবে সেটা বোঝার অসুবিধা কারও নেই।
কার্বন নির্গত হওয়ার পরই পরিবেশ দূষণের দ্বিতীয় প্রধান কারণ বনভূমি ও গাছপালা ধ্বংস। যেভাবে এখন বিশ্বজুড়ে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, এটা এক মারাত্মক ও বিপজ্জনক ব্যাপার। কারণ বিশ্বে যে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদিত হয় তার একটা বড় অংশ গাছ টেনে নেয় এবং অক্সিজেন ছাড়ে। বনভূমি উজাড় করার ফলে পরিবেশে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমছে না, কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। এর ফলে মানুষসহ প্রাণীকুলের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে হুমকি, যাকে বলা চলে তাদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে হুমকি। সারা দুনিয়া এখন প্রকৃতপক্ষে এই হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা প্যারিস চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে বিপর্যয় যে আরও দ্রুত ঘনিয়ে আসবে এতে সন্দহ নেই।
বিশ্বে পরিবেশ দূষণের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প-কারখানাগুলো থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হওয়া নিয়ে যথার্থভাবে যে আলোচনা, চুক্তি ইত্যাদি হচ্ছে, গ্যাস নির্গত হওয়ার যে বিরোধিতা হচ্ছে, সে রকম কিছুই বনভূমি ও গাছ ধ্বংসের ক্ষেত্রে নেই। অথচ গাছ ধ্বংস পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু তাই নয়, এর ফলে হাজার হাজার প্রাণী, যাদের বনভূমিতে বসবাস, ইতিমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং যা কিছু বাকি আছে তারাও নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। বেশি দূরে যেতে হবে না, আমাদের এই বাংলাদেশেও যেভাবে এই ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে তার দিকে তাকালেও পরিস্থিতির ভয়াবহতা চোখে পড়বে। বাংলাদেশ ছিল পাখির দেশ। অজস্র প্রজাতির পাখি এখানে ছিল। তার সঙ্গে ছিল প্রজাপতি, ফড়িং ইত্যাদির মতো পতঙ্গ। বাংলাদেশকে এখন প্রায় পক্ষীশূন্যই বলা চলে। বিশাল বড় বড় গাছে ছিল যাদের বাস, সেসব পাখি আর দেখাই যায় না। কারণ তাদের আবাসস্থল গাছগুলো পাইকারিহারে কেটে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম, মধুপুর, সুন্দরবনসহ বনভূমি উজাড় হচ্ছে। বড় বনভূমির বাইরে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেসব গাছ আছে সেগুলোও কেটে ফেলা হচ্ছে। এমনকি অনেক শত বছর বয়সী গাছও রেহাই পাচ্ছে না! সারা বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বনভূমির জন্য বিখ্যাত সব থেকে বড় মহাদেশ আফ্রিকায় যে ব্যাপক আকারে দীর্ঘদিন ধরে গাছপালা কেটে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, তাতে মহাদেশটি দ্রুত বৃক্ষশূন্য হচ্ছে। বনভূমি উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার পশুপাখি, সরীসৃপ ইত্যাদি প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হচ্ছে। একই ঘটনা ঘটছে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজান বনভূমিতে। সে অঞ্চল প্রায় উজাড় হয়ে শেষ হওয়ার মতো অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ধরিত্রীর পরিবেশ যেভাবে বিপন্ন হচ্ছে তার কোনো চেতনা রাষ্ট্রীয় নেতা ও জনগণের মধ্যে নেই। এর ফলে তার বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন নেই। তা প্রতিরোধের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির চিন্তা কোথাও নেই।
এই সংক্ষিপ্ত লেখা শেষ করার আগে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা দরকার। স্টিফেন হকিং, যাকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে নিউটন ও আইনস্টাইনের সমতুল্য বলা হয়ে থাকে, পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়ে মাঝে মাঝে কথা বলেন। কিন্তু কিছুদিন থেকে তিনি এ প্রসঙ্গে যেসব কথা বলছেন তা বোধগম্য নয় এবং সমর্থন করাও অসম্ভব। তিনি বিজ্ঞানীদের প্রতি বিশেষভাবে আহ্বান জানাচ্ছেন অন্য কোনো গ্রহে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থার জন্য, যাতে ধরিত্রী বসবাসের অযোগ্য হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ সেখানে গিয়ে বসবাস করতে পারে এবং তার দ্বারা মানবজাতি রক্ষা পায়! এখনও পর্যন্ত কোনো গ্রহে পানি, বাতাস, ভূমি ইত্যাদি মনুষ্য বসবাসের যোগ্য কিনা তার হদিস যেখানে নেই, সেখানে এই আহ্বানের কী মূল্য থাকতে পারে? পরিবেশ পরিস্থিতির অবনতি যেভাবে ঘটছে তাতে বিভিন্ন দেশ যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেয় তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই সমগ্র প্রাণীকুলসহ মানুষ জাতি ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হবে। এই সময়ের মধ্যে কোটি কোটি মানুষ তো দূরের কথা, এক ডজন মানুষের জন্যও কি অন্য গ্রহে গিয়ে বসবাসের মতো অবস্থা তৈরি করা সম্ভব? তাছাড়া পৃথিবী থেকে অন্য গ্রহে যাওয়ার ব্যবস্থাও কি সহজ! এ অবস্থায় অন্য গ্রহে বসতি স্থাপনের কথা স্টিফেন হকিংয়ের মতো এত বড় মাপের একজন বিজ্ঞানী কীভাবে বলছেন তা বোঝার উপায় নেই। সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, তিনি অন্য গ্রহে মনুষ্য বসবাসের ব্যবস্থার জন্য আহ্বান না জানিয়ে এই ধরিত্রীকে রক্ষার জন্য দুনিয়ার বিজ্ঞানী এবং লেখক-সাহিত্যিক, বিশেষত সব ধরনের বিজ্ঞানীদের প্রতি যদি আহ্বান জানাতেন পরিবেশ দূষণের বিরোধিতার জন্য, কার্বন ডাই-অক্সাইডের নির্গমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য, তাহলে অনেক বেশি কাজ হতো। তার আহ্বানের একটা বড় রকম ইতিবাচক ভূমিকা থাকত। তিনি নিজে একটি বিবৃতি তৈরি করে তার প্রতি সমর্থনের জন্য বিজ্ঞানী এবং বিশ্বের জ্ঞানী-গুণীদের কাছে আহ্বান জানাতে পারতেন। এর ফলে বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের ওপর একটা চাপ সৃষ্টি হতো। বিশ্বব্যাপী এর বিরুদ্ধে বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণভাবে জনগণ এক্ষেত্রে প্রতিরোধ আন্দোলনে খুব সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারতেন। কিন্তু হকিং সেদিকে না গিয়ে যেভাবে মানবজাতিকে রক্ষার চিন্তা করছেন এবং আহ্বান জানাচ্ছেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে প্যারিস চুক্তি থেকে বের হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ তার তরফ থেকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। এই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের জন্যও তিনি আহ্বান জানালে এর একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব জনগণ তো বটেই, এমনকি রাষ্ট্রনেতাদের ওপরও পড়ার কথা। কিন্তু কোথায় সেই আহ্বান?
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন