|
বদরুদ্দীন উমর
test@gmail.com |
|
বাংলাদেশে চুরি, দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র
02 July 2017, Sunday
বাংলাদেশের অর্থনীতি বিষয়ে দু-একদিনের মধ্যে সংবাদপত্রগুলো কী লিখেছে দেখা যাক। ৩০ জুন তারিখে ইংরেজি দৈনিক Daily Star-এর প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম খবরের হেডলাইন হল- 'Bangladeshi Money is Swiss Banks, Deposits jump 20 pc in a year'। ওই দিনই দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে দেয়া দ্বিতীয় খবরের হেডলাইন হচ্ছে, ‘সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার বেড়ে ৫,৫৬০ কোটি’। এই খবরে বলা হয়েছে, ‘১৬ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ থেকে গত বছর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে পাচার হয়েছে পাঁচ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, যা ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রায় সমান। পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালের মতো দেশগুলো থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশের তুলনায় নস্যি। এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে ৯৩৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা বেশি পাচার হয়েছে। এই হিসাব ইঙ্গিত করে যে, বাংলাদেশ থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে যে হারে অর্থ পাচার বাড়ছে, তাতে আগামী বছরই ভারতকে টপকে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ পাচারকারী দেশের তকমা মিলবে বাংলাদেশের। অর্থ পাচার প্রতিরোধে সরকারের সব সংস্থার হাঁকডাকের মধ্যেই এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটছে।’
সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারের এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের সাধারণ সম্পাদকে যা বলেছেন সে বিষয়ে দৈনিক যুগান্তরের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সুইস ব্যাংকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কারও টাকা নেই। বরং এ টাকা বিএনপি নেতাদের। এমন দাবি করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ওই ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার পরিমাণ বাড়ানোর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর জড়িত থাকার প্রমাণ দিতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে এবং প্রয়োজনে সুইস ব্যাংকের কাছেও বাংলাদেশিদের অর্থের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ...ওবায়দুল কাদের বলেন, অর্থ পাচারের রেকর্ড আওয়ামী লীগের নেই।’ (০১.০৭.২০১৭)
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের এ বক্তব্যের পর আমরা এখন কী ধরনের দেশে বসবাস করছি, কী ধরনের শাসনব্যবস্থা এ দেশে বলবৎ আছে এটা নতুন করে ভাবনার বিষয়। বিএনপি যে ফেরেশতাদের দল নয় এটা সবাই জানেন। তারা আরও জানেন যে, বাংলাদেশে কোনো ফেরেশতার দল থাকলে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় যাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। বিএনপি আমলে হাওয়া ভবনের অর্থ কেলেংকারির অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে পাচারকৃত অর্থ ২০ শতাংশ বেশি হওয়ার সঙ্গে এখন বিএনপির কী সম্পর্ক? এ সময়ে যে অর্থ পাচার হয়েছে সেটা তো খুব স্পষ্টতই দুর্নীতির মাধ্যমে হস্তগত করা টাকা। আওয়ামী লীগের শাসনকালে বিএনপির পক্ষে তাদের এই দুর্নীতির সুযোগ কোথায় এবং তারা কীভাবে এই টাকা সুইস ব্যাংকে জমা করতে পারে? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সুইস ব্যাংকে এই টাকা জমা নিয়ে তারা তদন্ত করে আসামি বের করবেন এবং বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন তাদের কোনো লোক এই টাকা জমা দিয়েছে এটা প্রমাণ করতে পারলে তারা তার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবেন! একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য কীভাবে দিতে পারেন এটা ভেবে স্বাভাবিকভাবে বিস্মিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এসব দলের চরিত্র এবং চুরি-দুর্নীতির ঐতিহ্য বিষয়ে যারা জানেন, তাদের এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ক্ষমতার গদিতে বসে মন্ত্রী, এমপি, দলীয় নেতারা দেশের মানুষকে এখন গরু-ছাগল ছাড়া আর কিছু মনে করেন না। এই গরু-ছাগলদের মধ্যে দেশের অর্থনীতিবিদরাও আছেন! কারণ তারা বাংলাদেশে ব্যাংক লুটপাট থেকে হাজার রকম দুর্নীতির বিষয়ে যা বলে আসছেন তাতে ক্ষমতাসীন লোকদের দুর্নীতিপরায়ণতার কথা স্পষ্টভাবেই শুধু এখন নয়, অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, সুইস ব্যাংকে তদন্ত করে তারা বের করবেন কারা এই দুর্নীতি করেছে! এর থেকে অর্থহীন ও হাস্যকর কথা আর কী হতে পারে? যারা সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকা লুটের ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কিছু করেনি, কোনো উল্লেখযোগ্য তদন্তই যারা করেনি, যার জন্য কারও কোনো বিচার ও শাস্তি হয়নি, তারা সুইস ব্যাংকের দুর্নীতির তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেবে, এটা যে কোনো সৎ ও সুস্থ মস্তিষ্কের লোক বলতে পারে, তা ভাবাই যায় না। সোনালী ব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে কিছু যে করা হয়নি শুধু তাই নয়, অর্থমন্ত্রী সে প্রসঙ্গে বেপরোয়াভাবে বলেছিলেন, চার হাজার কোটি টাকা তো কিছুই নয়!! সোনালী ব্যাংক লুটপাটের পর বেসিক ব্যাংকেও খুব বড় ধরনের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। তারও কোনো সুরাহা হয়নি। উপরন্তু এসব ব্যাংকের পুঁজির ঘাটতি পূরণের জন্য তাদেরকে জনগণের ট্যাক্সের টাকা থেকে ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে!! কিন্তু সাধারণ সম্পাদকের কথা অনুযায়ী তাদের সরকার সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারকারী, লুটপাটকারীদের খুঁজে বের করে তাদেরকে অবশ্যই শাস্তি দেবে!!! শুধু তাই নয়, তার আগেই সুইস ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা সেগুলোতে টাকা পাচারকারীদের শনাক্ত করবেন!!! তিনি নিশ্চিত যে তার মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো লোক নেই, কাজেই এ জন্য বিএনপির পাচারকারীদের তারা অবশ্যই শাস্তি দেবেন। যারা এভাবে এসব কথা বলেন তারা এতটাই ক্ষমতামদমত্ত যে, তারা ভাবতেই পারেন না এসব কথা দেশের কোনো লোকই বিশ্বাস করে না, এমনকি তাদের দলের লোকও নয় এবং এর দ্বারা মানুষের মধ্যে তারা তাদের বিরুদ্ধে বড় আকারে ক্ষোভ সৃষ্টি করা ছাড়াও হাস্যরসেরও খোরাক জোগান।
সুইস ব্যাংকে পাচারকৃত টাকার মধ্যে যে গত কয়েক বছরের ব্যাংক লুটের টাকাও আছে এতে সন্দেহ নেই। এই ব্যাংক লুটপাট সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের অভিমত যুগান্তরের একটি রিপোর্টে দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এখন বলছেন, বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর অবস্থা করুণ। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই এতে বলা হয়েছে, ‘অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুধু এভাবে বক্তব্য দিয়েই দায় এড়াতে পারেন না। এমন স্পষ্ট অভিমত দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের। তারা মনে করেন, ব্যাংকগুলোর এমন নাজুক পরিস্থিতির অন্যতম কারণ অর্থ লুটপাট। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এসব ঋণ আদায়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা, উল্টো রাজনৈতিকভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে। ...এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদদের সাফ কথা- রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের লুটপাটের পেছনে অর্থ মন্ত্রণালয় দায়ী। আর মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে তার দায়ভার অর্থমন্ত্রীর ওপরই বর্তায়। মূলত বিচারহীনতার কারণে ব্যাংকিং খাতে এ বিপর্যয় নেমে এসেছে। যতদিন বড় বড় ঋণখেলাপি ও তাদের দোসরদের বিচারের মুখোমুখি না করা হবে, ততদিন এসব লুটপাট চলতেই থাকবে।’ (০১.০৭.২০১৭)
এসব থেকে কি বোঝার উপায় আছে সরকারি লোকজন দুর্নীতিমুক্ত? এসব থেকে কি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য ‘অর্থ পাচারের কোনো রেকর্ড আওয়ামী লীগের নেই’- এর কোনো সত্যতা আছে? এর থেকে কি বোঝা যায় না, সরকার কত বড় বড় মিথ্যার জন্মদান করে নিজেকে টিকিয়ে রেখেছে?
আসলে শুধু ব্যাংক ডাকাতি নয়, অন্য হাজার হাজার উপায়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে এবং সে টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এই টাকার পরিমাণ শুধু কয়েক হাজার কোটি নয়, লাখ লাখ কোটি। এগুলোর মধ্যে সামান্য কিছু টাকা সুইস ব্যাংকে জমা হলেও এর বিপুল অধিকাংশ জমা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশে। বিশেষ করে শীর্ষ পাচারকারীদের এখন সব থেকে পছন্দের দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেখে মনে হয় বাংলাদেশের যেমন জাতীয় কবি আছেন, আছে জাতীয় ফুল ও ফল, তেমনি ‘জাতীয় চোর’ কারা সেটাও নির্ধারিত ও ঘোষিত হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরাই তাদের তদন্ত ও গবেষণার মাধ্যমে জাতিকে অবহিত করতে পারেন।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন