|
বদরুদ্দীন উমর
test@gmail.com |
|
জঙ্গি হামলায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে
09 July 2017, Sunday
গত বছরের (২০১৬) ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান ক্যাফে নামক একটি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় নিহত ২০ জনের পরিবারের প্রত্যেককে ১৫ হাজার ইউরো বা ১৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত সরকার ঘোষণা করেছে। ৫ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে জানিয়েছে (Daily Star, 06.07.2017). এর জন্য সরকারের মোট খরচ হবে ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এই খাতে সরকার চলতি বাজেটে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যয় নির্ধারণ করেছে বলেও রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে যে, ইতালিতে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে ক্ষতিপূরণের জন্য একটি প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানোর পর অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ২০টি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে এই ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন (Daily Star, 06.07.2017). এদের মধ্যে আছে ৯ জন ইতালিয়ান, ৭ জন জাপানি, ১ জন ভারতীয় এবং ৩ জন নিহত বাংলাদেশির পরিবার।
হলি আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গিরা অতর্কিতে হামলা চালিয়ে অতি নিষ্ঠুরভাবে উপরোক্ত ২০ জনকে হত্যা করে। যারা এভাবে নিহত হন তাদের পরিবারবর্গ যে বড় রকম ক্ষতিগ্রস্ত হয় এতে সন্দেহ নেই। এভাবে মানুষের প্রাণ গেলে তাদের পরিবার ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে একইভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। নিকটজনের কাছে এক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। এ কারণে এই হত্যাকাণ্ডের মতো ক্রিমিনাল কাজ সব সময়ই নিন্দনীয় এবং যারা অপরাধ করে তারা চরম শাস্তিযোগ্য। হলি আর্টিজান ক্যাফের জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে এটা কোনো ব্যতিক্রম নয়।
তবে একটি বিষয় এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য ও বিবেচনা করা দরকার। এ ধরনের দুর্ঘটনায় ক্ষতির দুটি দিক আছে। একটি মানসিক এবং অন্যটি আর্থিক। অনেকের ক্ষেত্রে এসব পরিবার শুধু মানসিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ক্ষতি মানসিক ও আর্থিক দুই-ই হয়। কাজেই ক্ষতিপূরণের প্রকৃত প্রয়োজন হয় যারা শুধু মানসিকভাবে নয়, মানসিক ও আর্থিক দুইভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হন তাদের। অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণত দ্বিতীয় ধরনের। যিনি নিহত হন তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হওয়ায় তার মৃত্যু তার পরিবারকে শুধু মানসিকভাবেই আঘাত করে না, আর্থিক সংকটের মধ্যে নিক্ষেপ করে চরমভাবে দুর্দশাগ্রস্ত করে, এমনকি ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। বলাই বাহুল্য, ক্ষতিপূরণ এ ধরনের পরিবারের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন। মানবিক দিক দিয়ে এই ক্ষতিপূরণের গুরুত্ব অনেক বেশি।
এভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা মানসিক দিক দিয়ে সবাই সমান। এর মধ্যে তারতম্য করা অর্থহীন। ধনী-দরিদ্র সবার নিকট-আত্মীয়রা তাদের পরিবারের কাছে সমান আদরণীয় ও ভালোবাসার পাত্র। কিন্তু আর্থিক ক্ষতির দিক দিয়ে তারা সমতুল্য নন। কাজেই যারা দরিদ্র তাদের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণের প্রয়োজন অনেক বেশি। দেখা যায় যে, জঙ্গি হামলায় সাধারণত গরিবরাই বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই ঘটে এমন নয়, দুনিয়াজুড়েই এটা হচ্ছে। এভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে সাধারণ গরিবদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে এমন উদাহরণ বাংলাদেশে নেই। এদিক দিয়ে ঢালাওভাবে হলি আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গি হামলায় নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত এই প্রথম বলা চলে।
যে ইতালিয়ান ও জাপানিরা এই হামলায় নিহত হয়েছেন, তারা সবাই কোনো না কোনো ব্যবসায়িক কাজে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন বলে জানা যায় না, যারা নিহত হওয়ার ফলে তাদের পরিবার পথে বসবে। অন্য যারা নিহত হয়েছেন, তারা সবাই খুব ধনী অথবা সচ্ছল পরিবারের সন্তান। কাজেই তাদের নিহত হওয়ার কারণে তাদের পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন নয়। মনে হয়, ইতালিয়ান ও জাপানিদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হলে অন্যদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে বাদ দেয়া অসুবিধাজনক মনে করে তাদের পরিবারকেও ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, যার কোনো প্রকৃত প্রয়োজন নেই।
বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগতই আতঙ্কজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব জিনিসেরই মূল্য বাড়ছে। তবে একটা জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি না পেয়ে ক্রমেই এবং বড় আকারে কমছে। এ জিনিসটি হল গরিব মানুষের জীবন। সব ধরনের মেহনতি মানুষ, শ্রমিক-কৃষক নিন্মমধ্যবিত্তের জীবনের কোনো মূল্য সরকারের কাছে আছে বলে তাদের আচরণ দেখে মনে হয় না। জঙ্গি আক্রমণ ছাড়া সারা দেশে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ নানা ধরনের দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে নিহত ও মারাত্মকভাবে আহত হচ্ছেন। কিন্তু তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। এখন কলকারখানায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিহতদের পরিবারকে সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। কিন্তু এর উদাহরণও কম। অনেককেই ক্ষতিপূরণ দেয়া হয় না। ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারে সরকারের দিক থেকেও কোনো চাপ সৃষ্টি করা হয় না।
বন্যা, ঝড়, পাহাড় ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে অনেক দুর্যোগকে শুধু প্রাকৃতিক বলা চলে না। পাহাড় ধসের তথাকথিত দুর্ঘটনার কারণ যে দুর্বৃত্তদের দ্বারা পাহাড়ের গাছ কাটা ও বন কেটে উজাড় করা এটা এখন এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। হাওর এলাকাতেও একইভাবে দুর্বৃত্তদের লুটপাট ও দখল কাণ্ডের ফলে দুর্যোগ ঘটছে, যেমনটি এখন দেখা যাচ্ছে সিলেটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। এভাবে যাদের মৃত্যু হচ্ছে, যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের দিকে তাকানোর আগ্রহ সরকারের নেই। তাদের কাছে যে নামমাত্র ত্রাণ-সাহায্য পাঠানো হয়, তাদের খাদ্য-পানীয়-ওষুধপত্র থেকে নিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না। নামমাত্র দুর্যোগ মোকাবেলার একটি মন্ত্রণালয় থাকলেও নানা দুর্যোগের সময় ত্রাণমন্ত্রী ও তার মন্ত্রণালয়ের কোনো নড়াচড়া দেখা যায় না। কাজেই এসব দুর্যোগ যাদের মৃত্যু হয় তাদের পরিবারের লোকজনের জীবনে দুর্দশার শেষ থাকে না এবং ধুঁকে ধুঁকে তাদের অনেকেরই মৃত্যু হয় খাদ্য, পানি ও ওষুধপত্রের অভাবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে অগণিত গরিব মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ইদানীং এই দুর্ঘটনা অবিশ্বাস্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বছরেই সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় আটশ’ লোকের মৃত্যু হয়েছে বলে সরকারিভাবেই হিসাব দেয়া হয়েছে। কাজেই বছরে এখন আট-দশ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছেন। একজন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী আছেন, তিনি সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকও বটেন। প্রতিদিন তিনি যেসব কথা বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার দেখে সে কথার যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায় না। তার কোনো দায়িত্ববোধেরও পরিচয় নেই তার কথাবার্তা ও কাজকর্মে। দুর্ঘটনায় নিহত ও গুরুতর আহতদের জন্য যে ক্ষতিপূরণ অবশ্যই দরকার, সে বিষয়ে সরকারের কোনো আগ্রহ ও উদ্যোগ নেই। কাজেই এ নিয়ে শুধু তাদের পরিবহনমন্ত্রীর ওপর দোষারোপ করে লাভ নেই। বাংলাদেশের জনগণ এখন যে শাসক শ্রেণীর ও তাদের সরকারের শোষণ-নির্যাতনে নিষ্পেষিত হচ্ছেন, তাতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত গরিবদের প্রতি তাদের এই আচরণে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
হলি আর্টিজান ক্যাফের জঙ্গি হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের মধ্যে বিদেশিদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হয়েছে এবং যে কারণে অন্যদের জন্যও ব্যবস্থা হয়েছে ক্ষতিপূরণের। এর সঙ্গে মানব দরদের কোনো সম্পর্ক নেই। ক্ষতিপূরণের এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক। কাজেই এ ধরনের সরকারি স্বার্থ যেখানে জড়িত নেই, সেখানে জঙ্গি হামলায় নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকার কথা নেই। তাছাড়া সারা দেশে কলকারখানা ও সড়ক দুর্ঘটনা এবং তথাকথিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে যারা নিহত, আহত এবং অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাদের ভরসাস্থল বলে কিছু নেই। তাদের কর্তব্য হচ্ছে সরকারকে হাজার রকম ট্যাক্স দিয়ে যাওয়া, নির্বাচনের সময় ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় ভোট দেয়া এবং সরকারের কাজ হচ্ছে সেই অর্থে উন্নয়নের নামে বিরাট মাপের বাজেট তৈরি করে লাখ লাখ টাকা খরচ করা, যার প্রায় অর্ধেকটাই চোর, দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তরা আত্মসাৎ করে।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন