বাংলাদেশের জনগণের জীবনে সুখ-শান্তি বলে কিছু আজ পর্যন্ত দেখা যায়নি। জনগণের জীবনে দারিদ্র্য দূর করার দাবি সরকার ও কতগুলো এনজিও দেশে ও দেশের বাইরে ঢেড়ি পিটিয়ে বলতে থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যজনিত কারণে তাদের জীবনে দুর্দশার শেষ নেই। শোষণ ও নানা ধরনের নির্যাতনের মধ্যে তারা বসবাস করে। প্রত্যেক বছরই এর সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যুক্ত হয়ে তাদের জন্য অতিরিক্ত বিপদ ডেকে আনে। এ বছর এই বিপদ একেবারে সীমা অতিক্রম করেছে। পাহাড় ধস থেকে নিয়ে ঝড় ও বন্যায় দেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জনগণ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এত ব্যাপক আকারে ও এই মাত্রায় এ বিপদ আগে দেখা যায়নি। কিন্তু জনগণের এই বিপদ মোকাবেলার জন্য নামমাত্র কিছু সাহায্য ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। সরকারের একটি দুর্যোগ মোকাবেলা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় আছে। এই মন্ত্রণালয়ের একজন মন্ত্রীও আছেন। তাদের নিষ্ক্রিয়তা দেখে মনে হয়েছে তারা ঘুমিয়ে আছে। এখন হঠাৎ করে ১২ জুলাই এই মন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলন ডেকে দুর্যোগ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য প্রদান করেছেন।
মন্ত্রী তার বক্তব্যে জানিয়েছেন ত্রাণসামগ্রীর ‘অভাব নেই’। এ প্রসঙ্গে ‘বন্যা নিয়ে রাজনীতি’ না করে তিনি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন! কিন্তু বন্যা নিয়ে রাজনীতির যে কথা তিনি বলেছেন তার অর্থ কী? অর্থ কি এই যে, তাদের কাছে ‘ত্রাণসামগ্রীর অভাব নেই’, তাই যারা ত্রাণের অভাবে জনগণের জীবনে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে সে অবস্থায় ত্রাণসামগ্রী তাদের কাছে না পৌঁছানোর ব্যাপারে যারা কথা বলছেন ও সংবাদপত্রে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে তা বন্ধ করা?
ত্রাণমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সিলেট, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, কক্সবাজার, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ জেলা বন্যাকবলিত। উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে আরও নতুন জেলা প্লাবিত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উজানের দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানে এবার বন্যা হয়েছে। ভাটির দেশ হিসেবে এর প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করছি এবং মানুষকে সহনশীল অবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়েছি’ (যুগান্তর, ১৩.০৭.২০১৭)। ত্রাণমন্ত্রী আরও বলেন, ‘দুর্গত ১৩ জেলার ৪৫ উপজেলায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা জেলা প্রশাসকদের বলেছি, চাহিদামতো খাদ্যশস্য ও অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। একটি লোকও যাতে খাবারের কারণে কষ্ট না পায় এ জন্য সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। যারা খোলা আকাশের নিচে, উঁচু বাঁধে বা রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। সেখানে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।’ এরপর তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক জেলায় প্রচুর ত্রাণসামগ্রী মজুদ রয়েছে। ৯৮ হাজার শুকনা খাবারের প্যাকেট তৈরি করে রেখেছি। কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে উঠলে যেন তাৎক্ষণিকভাবে খাবারের চিন্তা করতে না হয়।’
প্রতিদিন প্রতিটি জাতীয় সংবাদপত্রে দেশের লাখ লাখ বন্যাদুর্গতের দুরবস্থার ওপর যে সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে তার থেকে কি মনে হয় সংবাদ সম্মেলনে ত্রাণমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন এবং যেসব দাবি করেছেন তার মধ্যে কোনো সত্যতা আছে? প্রত্যেক এলাকা থেকে যেসব রিপোর্ট পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় লাখ লাখ দুর্গত মানুষের মাঝে অতি সামান্যসংখ্যকের কাছে নামমাত্র কিছু সাহায্য ছাড়া এমন কিছুই পৌঁছায় না যাতে তাদের দুর্দশা দূর হওয়া তো দূরের কথা, সামান্য কিছুটা লাঘব হতে পারে। যে পত্রিকায় প্রকাশিত ত্রাণমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনের রিপোর্ট ছাপা হয়েছে সেই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাতেই ‘১৩ জেলার মানুষ পানিবন্দি, ত্রাণের জন্য হাহাকার’ শীর্ষক একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ‘ক্ষতিগ্রস্ত সাড়ে ৬ লাখ, বরাদ্দ ১৮ হাজার ৫শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার’, ‘তিন জেলায় ৩-৫ দিনেও কেউ সরকারি ত্রাণের দেখা পায়নি’, ‘ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরিতে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ’। এ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির যে অভিযোগের কথা বলা হয়েছে, তা লুটপাট ছাড়া আর কী? এই রিপোর্টটিতে বন্যাপীড়িত লাখ লাখ লোকের দুর্দশার যে চিত্র পাওয়া যায় তার থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, ত্রাণমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের প্রায় পুরোটাই বাকসর্বস্বতা ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি বন্যা মোকাবেলার সম্পূর্ণ প্রস্তুতির কথা বলেছেন, কিন্তু এই ‘প্রস্তুতি’ সত্ত্বেও আসলে ত্রাণ কীভাবে ও কোথায় দেয়া হয়েছে তার সঠিক কোনো বিবরণ নেই।
‘যারা খোলা আকাশের নিচে, উঁচু বাঁধে বা রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন তাদের আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। সেখানে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে’ বলে মন্ত্রী যে দাবি করেছেন তার মধ্যে কি বিন্দুমাত্র সত্যতা আছে? কিন্তু সরকারের সর্বস্তরের মন্ত্রীরা কি সত্য কথা বলার কোনো পরোয়া করেন? তারা প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে সত্যের বিপরীতে যেসব কথা বলে থাকেন তার জন্য তাদের বিবেকের দংশন কি তারা অনুভব করেন? সেটা হলে তারা অন্তত এ ব্যাপারে কিছুটা সংযত হতেন। কিন্তু তারা বেপরোয়া। এ দেশে প্রকৃত কোনো বিরোধিতার অভাবে তারা যেভাবে শাসন কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে কোনো কিছুর পরোয়া করার প্রয়োজন তারা বোধ করেন না। ত্রাণমন্ত্রী বর্তমান বন্যা পরিস্থিতিতে তার মন্ত্রণালয় ও তাদের সরকারের যে সক্রিয়তা, দায়িত্বশীলতা ও মানবিক বোধের কথা বলেছেন, বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব কি দেশের এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে কোথাও দেখা যায়?
ত্রাণ বিতরণ অতি সামান্য হলেও তার মধ্যে ‘স্বজনপ্রীতির’ যে কথা উপরোক্ত রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, সেটা লুটপাট ছাড়া আর কী? যেটুকু ত্রাণ সরকার দিচ্ছে তার একটা বড় অংশই এভাবে লুটপাট হয়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকদের পকেটে পড়ছে। এটা কোনো নতুন অথবা অজানা কথা নয়। এটা শুধু বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রেই নয়, দেশজুড়ে প্রত্যেক ক্ষেত্রে ব্যাপক ও বেপরোয়াভাবে ঘটছে।
দেশের সম্পদ কীভাবে লুটপাট হচ্ছে এটা দেশের লোকের ভালোভাবেই জানা। তবু ত্রাণ বিতরণসংক্রান্ত যেসব রিপোর্ট ১৩ জুলাইয়ের যুগান্তরে আছে, এর বাইরে আরও যে একটি রিপোর্ট আছে ছাত্রলীগের নেতাদের সম্পর্কে তার থেকে এখন ত্রাণ ক্ষেত্রে যে লুটপাট হচ্ছে সে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। বাস্তব পরিস্থিতি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। যুগান্তরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারের দেয়া এই রিপোর্টটিতে প্রথমেই বলা হয়েছে, ‘ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভায় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনকে একহাত নিলেন সংগঠনটির অন্য নেতারা। তাদের অভিযোগ, এ দু’জন এককভাবে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছেন। সংগঠনের নামে আসা অর্থ নিজেরা ভোগ করছেন। বিষয়টি নিয়ে সভাস্থলে ব্যাপক হট্টগোল সৃষ্টি হয়।’
এই দীর্ঘ রিপোর্টের এক জায়গায় সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারির কাছে যে অর্থ-বিত্ত আসে, তা ছাত্রলীগের নামে আসে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি যারা হয়, তাদের কাছে ছাত্রলীগের নেতাদের ভাগ্যের আমানত থাকে। সেই আমানতের খেয়ানত ২৬ তারিখের পর হতে দেব না। ছাত্রলীগের নামে যত টাকা আসে, তার ভাগ করতে হবে। ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারি যারা হয়, তাদের কেউ আগে এমন কোনো মহীয়ান ছিল না যে, মানুষ এমনিতে টাকা দিয়ে দেবে। মানুষ ছাত্রলীগ সভাপতি-সেক্রেটারিকে টাকা দেয়। সংগঠন পরিচালনার জন্য দেয়। এ টাকা সংগঠন পরিচালনার জন্য দেয়। এ টাকা সংগঠনের পেছনে ব্যয় করতে হবে। তিনি এ সময় ছাত্রলীগ সভাপতিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি ৫৫ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দেন কিভাবে?’ তখন সোহাগ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টাকা দেন।’ এ সময় সায়েম খান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী টাকা দিলে সেই টাকার ভাগ আমারও আছে। তাহলে আমার ভাগও দিতে হবে।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগের মধ্যে এই কোন্দল ও ঝগড়াঝাঁটি টাকা ভাগাভাগি ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে নয়। দেশের অবস্থা, জনগণের অবস্থা, এমনকি সাধারণ ছাত্রলীগ কর্মীদের অবস্থাও তাদের আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের কোনো বিষয় এই সভায় ছিল না। এই ভাগাভাগির বিষয়ে যুগান্তরের রিপোর্টটিতে আরও অনেক কথা বলা হয়েছে যার মধ্যে যাওয়া এখানে সম্ভব নয়, তার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু এর থেকে কি প্রমাণিত হয় না কীভাবে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলের শাসনে আজ দেশ চলছে? এর দ্বারা কি প্রমাণিত হয় না, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং আওয়ামী লীগের সব অঙ্গসংগঠনে এই লুটপাট কীভাবে চলছে? ছাত্রলীগের সভাপতি কী পরিমাণ অর্থ-বিত্তের মালিক হলে ৫৫ হাজার টাকা মাসিক বাসাভাড়া দিতে পারে- এটা কি গাধার পক্ষেও বোঝা কঠিন ব্যাপার? এই যদি হয় ছাত্রলীগ নেতাদের অবস্থা, তাহলে খোদ আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের ক্ষেত্রে কী ঘটছে? এই অবস্থায় দেশে বন্যাকবলিত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য সরকারের কোনো মানবচিত দরদ ও চিন্তাভাবনা থাকবে, এটা ভাবা কি এক অবাস্তব ব্যাপার নয়? এ পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত মানুষের কাছে যথেষ্ট ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে এবং ত্রাণসামগ্রীর অভাব নেই, এ কথা সরকারিভাবে বলা হলেও এই তথাকথিত ত্রাণ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে বা ভবিষ্যতে পৌঁছাবে, এর কোনো সম্ভাবনা কি থাকা সম্ভব?
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন