|
বদরুদ্দীন উমর
test@gmail.com |
|
আগামী নির্বাচন ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
30 July 2017, Sunday
আগামী নির্বাচন নিয়ে এখন অনেক শোরগোল ও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, এই তোড়জোড়ের মধ্যে এই স্বীকৃতি খুব স্পষ্ট যে, এর আগের নির্বাচন সৎ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি এবং আগামী নির্বাচন যথাসম্ভব দোষমুক্ত করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই সৎ, দুর্নীতিমুক্ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। ১৯৭২ সালের সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে যে প্রথম নির্বাচন হয়েছিল সেটা সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া খুব স্বাভাবিক ও সম্ভব ছিল। কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে যে, তা হয়নি। যেখানে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৮০ বা ২৭৫ আসনে জয়লাভ নিশ্চিত ছিল, সেখানেও নির্বাচন ঠিকমতো অনুষ্ঠিত হয়নি! আওয়ামী লীগ দেখাতে চেয়েছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশের মালিক তারাই। কাজেই সংবিধান, নির্বাচন যাই হোক, সবকিছুই তাদের মালিকানার অধীনস্থ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের ফলাফল টেলিভিশনে প্রচারিত হতে থাকার সময়ে দেখা গেল, বেশ কয়েকজন বিরোধীদলীয় প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রার্থীর থেকে বেশি ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন এবং জয়লাভের সম্ভাবনা যথেষ্ট বা ষোল আনা। কিন্তু সেই অবস্থায় তাদের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেল। অনেক পরে যখন আবার তাদের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা শুরু হল তখন দেখা গেল তারা আর এগিয়ে নেই। শেষ পর্যন্ত কম ভোট পেয়ে তারা হেরে গেলেন!! যারা এভাবে ‘হেরে’ গেলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ডক্টর আলীম আল রাজি, মেজর জলিল, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ। নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে ২৫-৩০ জন বিরোধী প্রার্থীর জয়লাভের সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু একমাত্র আতাউর রহমান খান ছাড়া আর কারও পক্ষে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনের পর তিনি বলেছিলেন, ঢাকার পার্শ্ববর্তী তার নির্বাচনী এলাকায় বহু বিদেশি সাংবাদিক, টেলিভিশন ইত্যাদি উপস্থিত থাকায় অন্যত্র যেভাবে কারচুপি ও ভোট ডাকাতি সম্ভব হয়েছিল, তার এলাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। এই নির্বাচন বিজয়ের পর একবার প্রথম নির্বাচিত জাতীয় সংসদে শেখ মুজিবুর রহমান খুব গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো বিরোধী দল নেই।’
বাংলাদেশে সংসদীয় নির্বাচন এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের এই অবস্থা পরবর্তী সময়ে এবং এখনও পর্যন্ত এক নির্ধারক ব্যাপার হয়ে আছে। সেই প্রথম নির্বাচনের সময় যেভাবে দুর্নীতি ও কারচুপি হয়েছিল, সেটাই পরবর্তী পর্যায়ে পরিণত হয়েছে এদেশের প্রতিটি সরকারের নির্বাচনী ঐতিহ্যে। এ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের উল্লেখ এখানে করা হল। এরপর থেকে প্রত্যেক নির্বাচনেই অল্পবিস্তর দুর্নীতি ও কারচুপি হয়েছে। এর পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন যেভাবে হয়েছিল তাকে শুধু কারচুপি বললে কিছুই বলা হয় না; সে সময় নির্বাচনকে এমন অবস্থায় এনে দাঁড় করানো হয়েছিল যে, জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য ভোটের প্রয়োজন হয়নি! ভোট ছাড়াই ১৫৩ জন নির্বাচিত হওয়ায় সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা আওয়ামী লীগ অর্জন করেছিল!! শুধু বাংলাদেশের নয়, দুনিয়ার নির্বাচনী ইতিহাসে এর কোনো তুলনা নেই।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ যেভাবে ‘নির্বাচনী সাফল্য’ অর্জন করেছিল তারই আতঙ্ক এখন শুধু বিরোধী দলগুলোকেই নয়, সরকারি দলকেও ভূতের মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বিরোধী দলগুলো পূর্ববর্তী নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি রোধের জন্য মরিয়া হয়েছে এবং সরকারি দল তার পুনরাবৃত্তি আর সম্ভব নয় এটা উপলব্ধি করে নিরপেক্ষ নির্বাচনে তাদের উৎখাত হওয়ার ষোল আনা সম্ভাবনা দেখে আতঙ্কের মধ্যে আছে। তাদের নেতাদের নানা উক্তির মধ্যেই তাদের এই আতঙ্কের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচনে কারচুপি ও দুর্নীতির প্রধান হাতিয়ার হল খোদ নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ। এ দুইয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখেই ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনের সময় সমগ্র প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। এজন্য নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা যায়, এ বিষয়ে আলোচনা এ দুইকে কেন্দ্র করেই ঘুরতে থাকে। পুলিশের ছত্রছায়ায় সরকারি দলে গুণ্ডাবাহিনীও যথেষ্ট তৎপর থাকে। কিন্তু পুলিশ না থাকলে তারা স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারে না। এজন্য নির্বাচনের সময় সরকারি গুণ্ডাবাহিনী কতখানি তৎপর ও কার্যকর হবে সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে পুলিশের অবস্থান ও ভূমিকার ওপর।
নির্বাচনের একটা লক্ষ্য হল, এর মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটানো। উন্নত ও অগ্রসর দেশগুলোতে সম্পূর্ণভাবে না হলেও এই লক্ষ্য অনেকখানি অর্জিত হয়। কিন্তু অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে সেটা হয় না। এমন সব শর্তে এসব নির্বাচন হয় যাতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটা সম্ভব নয়। কিন্তু তবু মোটামুটিভাবে কারচুপি যদি কম হয়, তাহলে এই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন সরকারকে তাদের অজস্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে শোষণ-নির্যাতন চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশোধ হিসেবে জনগণ তাদের উৎখাত করতে পারেন। অবশ্য বাংলাদেশেও ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত এটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচন এদিক দিয়ে ছিল এক বিস্ময়কর ঐতিহাসিক ব্যতিক্রম। এমনভাবে সে নির্বাচন পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয়েছিল যে, জনগণের এই প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতাও কেড়ে নেয়া হয়েছিল। এদিক দিয়ে সেই নির্বাচন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সব থেকে কলঙ্কজনক ও বিপজ্জনক ব্যাপার। তবে বলা দরকার যে, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ‘সাফল্য’ সত্ত্বেও দেশের জনমতকে তা সহ্যসীমার বাইরে এনে দাঁড় করিয়েছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এখন যেসব নির্বাচনী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে এই পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটছে এবং তাকে সামনে রেখেই সরকারি ও বিরোধী দলগুলো তাদের কৌশল নির্ধারণের চেষ্টা করছে।
পূর্ববর্তী দুর্নীতিবাজ প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে এখন নতুন নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়া সত্ত্বেও তাদের ওপর বিরোধী দলের কোনো আস্থা ও ভরসা নেই। তাছাড়া পুলিশকে সরকার এমনভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের অধীন করেছে যে এ আশঙ্কা এক বাস্তব ব্যাপার। কাজেই কীভাবে একটি নতুন নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা যায় এবং নির্বাচনের সময় পুলিশের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করা যায় এটাই হল এখন বিরোধী দলগুলোর মুখ্য বিবেচনার বিষয়। নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আর কিছু নেই। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ এটা ভালোভাবেই জানে যে, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ যদি তাদের না থাকে, তাহলে নির্বাচন জয়ের কোনো সম্ভাবনা তাদের একেবারেই নেই। বিশেষত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের পর থেকে তাদের চুরি, ঘুষখোরি, লুটপাট ও সন্ত্রাস এমনভাবে হয়েছে যে তারা সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। কাজেই আগামী নির্বাচনে জনগণ তাদেরকে ভোট দিয়ে আবার ক্ষমতায় বসাবে, এমন ভরসা তাদের একেবারেই নেই। এখনও পর্যন্ত তারা যেসব বড় বড় কথা, হামবড়ামি এবং বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে যেভাবে বিষোদ্গার করছে এবং হুমকি দিচ্ছে, এসব গোদা পায়ের লাথি ছাড়া আর কিছু নয়। এই গোদা পা নিয়ে নির্বাচন যুদ্ধে পা ফেলে তারা এগিয়ে যাবে এটা চরম নির্বোধ ছাড়া অন্য কেউই ভাবে না। আওয়ামী লীগের মধ্যে অবশ্য এ ধরনের নির্বোধের অভাব নেই। বুদ্ধির এই বিলুপ্তি ক্ষমতামদমত্ত অবস্থায় কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নিজের একটা নির্বাচন পরিকল্পনা আছে। এই পরিকল্পনার অন্যতম কৌশল হিসেবে তারা জনমত যাচাইয়ের জন্য সিভিল সোসাইটির অন্তর্ভুক্ত কিছু লোককে নির্বাচন বিষয়ে তাদের মতামত জানানোর জন্য আমন্ত্রণ করছে। কিন্তু এই লোকদের মতামত যাই হোক, তাদের নির্ধারক মনে করার কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে আসল নির্ধারক হচ্ছে দেশে বিরাজমান বাস্তব পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতিতে যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা আর আওয়ামী লীগের নেই। তাছাড়া আওয়ামী লীগের জনবিচ্ছিন্নতার কারণে যে আর বেশিদিন তাদের কার্যকর কোনো রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে বিদেশি শক্তিরাও বিবেচনা করবে, এ সম্ভাবনাও বিশেষ নেই। কাজেই দেশীয় জনগণের থেকে পরিপূর্ণ বিচ্ছিন্নতা এবং বিদেশি শক্তির সমর্থন আগের মতো না পেয়ে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার তক্তা উল্টানোর সম্ভাবনা ষোল আনা। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তারপর দেশের শাসনব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হবে এটা ভবিষ্যৎই বলতে পারে। এ নিয়ে এখন জল্পনা-কল্পনা বা ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো সুযোগ নেই।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন