|
বদরুদ্দীন উমর
test@gmail.com |
|
শীর্ষ আদালত ও সরকারের দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য
13 August 2017, Sunday
সভ্য কায়দায় রাজনৈতিক বিতর্ক ও মতপার্থক্য নিয়ে আলাপ-আলোচনার ঐতিহ্য বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। এটা কোনো সমাজের পক্ষে গৌরবের ব্যাপার নয়। দেখা যায়, বাংলাদেশে অনেক রকম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো সোচ্চার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ নেই। ভয়, লোভ ও হরেকরকম স্বার্থচিন্তা থেকেই এটা হয়ে থাকে। অন্যদিকে দেখা যায়, কেউ বা কোনো মহল যদি কোনো নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং কোনো অন্যায়ের প্রতিকার চান, তাহলে তার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় বসে থাকা লোকজন এমন ভাষায় ও এমনভাবে বিষোদগার করেন, এমনকি আক্রমণ করেন, যা কোনো গণতান্ত্রিক পরিবেশে সম্ভব নয়। ক্ষমতাসীনদের এ ধরনের আচরণ সমগ্র সমাজের মধ্যে অসহনশীলতার প্রবণতা বৃদ্ধি করে ক্ষমতাসীন বা সরকারি মহলের বাইরে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি বা বিকাশ সাধনের পরিবর্তে তার বিপরীত কাজটিই করে থাকে। এর ফলে সমগ্র সমাজেই একটা বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। বাংলাদেশে আজ এ পরিবেশই বিরাজ করছে এবং এই প্রক্রিয়ার শুরু হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম লগ্ন থেকেই।
বর্তমানে ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বাতিলের পর সরকারি মহল থেকে এর বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হচ্ছে এবং গায়ের জোরে এই বাতিলের রায় বাতিলের হুমকি দেয়া হচ্ছে, এর মধ্যেই বাংলাদেশে উচ্চ মহলে বিতর্কের ধরন ও চরিত্র সম্পর্কে কোনো অস্পষ্টতা থাকার কথা নয়। বিতর্কের নামে এখন সরকার ও উচ্চতম আদালত এবং দু’পক্ষের সমর্থনকারীদের মধ্যে যে বাকবিতণ্ডা চলছে, এটা এক সাংবিধানিক বিষয়। কিন্তু বিষয়টি সাংবিধানিক হলেও এ নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত নিয়ম-কানুন কিছুই মান্য করা হচ্ছে না। এই ঐতিহ্যও বাংলাদেশে প্রথম থেকেই তৈরি হয়েছে। সংবিধান, সংসদ, সরকার, বিচার বিভাগ কোনোটাই কারও ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা দলীয় জমিদারি নয়। কাজেই এখানে স্বেচ্ছাচারিতার কোনো স্থান নীতিগতভাবে নেই। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সরকারি কর্তৃপক্ষ, আইন প্রণয়নকারী সংস্থা অর্থাৎ সংসদ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা পৃথকীকরণের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই পৃথকীকরণ মোটামুটি মসৃণভাবে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে কার্যকর থাকে। তাদের শাসন যথাসম্ভব সংকটমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই তারা এটা করে থাকে। যেসব অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীন হয়েছে, সেসব দেশের সংবিধানেও উপরোক্ত তিন ক্ষমতার পৃথকীকরণের ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু শাসন ক্ষেত্রে গণতন্ত্র চর্চার কোনো ঐতিহ্য না থাকার কারণে এ ধরনের দেশে সরকার আইন প্রণয়ন ও বিচারব্যবস্থার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার চেষ্টা করে এবং সহজেই তারা এটা করে থাকে। পশ্চিমা উন্নত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে তিন ক্ষমতার পৃথকীকরণ যেভাবে প্রথাগতভাবে প্রতিষ্ঠিত (institutionalised) হয়েছে, সেভাবে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে সাধারণত এটা ঠিকমতো হয় না। যেহেতু আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর দাঁড়িয়েই সরকার গঠিত হয় সেজন্য আইনসভার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়। বিশেষত দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি থাকে, তাহলে এ নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ হতে পারে। এদিক দিয়ে বিচার বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ সে তুলনায় অত সহজ নয়, যদিও অনুন্নত দেশগুলোতে নিজেদের সম্পূর্ণ অনুগত লোককে বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে সরকার এটা সাধারণত করে থাকে। এ কাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বৃহৎ পুঁজিবাদী দেশেও একইভাবে করা হয়। এজন্য সেখানে সুপ্রিমকোর্টের শুধু প্রধান বিচারপতি নয়, যে কোনো বিচারপতির নিয়োগ নিয়ে জাতীয়ভাবে অনেক আলোচনা হয়ে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা ও সুযোগ নেই। এর কারণ সেখানে বিচারব্যবস্থা শক্তিশালীভাবে প্রথাগত (institutionalised)। সেই প্রথার বাইরে কারও হুকুম মেনে বিচারপতিদের স্বেচ্ছাচারিতার কোনো ক্ষমতা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এটা একেবারে প্রথম থেকেই দেখা গেছে। আওয়ামী-বাকশালী আমল থেকে নিয়ে কোনো সরকারের আমলেই বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, তা দেখা যায়নি। এ নিয়ে জনমনে অনেক বিতর্ক রয়েছে।
প্রশাসন, আইনব্যবস্থা ও বিচার বিভাগের ওপর একক প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার যে চেষ্টা এখানে প্রথম থেকেই দেখা গেছে, তারই সব থেকে নিকৃষ্ট চেহারা এখন দেখা যাচ্ছে ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বাতিলের পর। এই সংশোধনীর মাধ্যমে চেষ্টা ছিল আইনসভা বা জাতীয় সংসদের ওপর সরকারের যে ধরনের কর্তৃত্ব আছে, সেই ধরনের কর্তৃত্ব শীর্ষ আদালতের ওপর প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু শীর্ষ আদালত এই সরকারি প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে নিজেদের পৃথক অবস্থান রক্ষার জন্য সাংবিধানিকভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন। এ কাজকে সুপ্রিমকোর্টের এক সাবেক প্রধান বিচারপতি আখ্যায়িত করেছেন ‘বিচারকদের প্রজাতন্ত্র’ বলে। সরকারের কথিত অনুগত ব্যক্তি হিসেবে এবং একটি অতি উচ্চ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত থেকে তার পক্ষে এটা বলা স্বাভাবিক। কিন্তু আসল ব্যাপার হল, ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নয়, ‘আওয়ামী লীগের প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত করতে চেয়েছিল। সেই অধিকার থেকে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ তাদের বঞ্চিত করায় এখন তারা মরিয়া হয়ে সুপ্রিমকোর্টের বিরুদ্ধে যেভাবে বিষোদগার করছে, এটা শীর্ষ আদালতের কোনো রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বা তার সমালোচনার কোনো সভ্য ভাষা ও কায়দা নয়। এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্টের মধ্যে এমন কিছু কথা আছে যা সত্য হলেও এতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আঁতে ঘা লেগেছে। কারণ আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালে ও তার পূর্ববর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন করার সংগ্রামে এ দেশের জনগণের ভূমিকাকে শুধু খর্ব করা নয়, একেবারে উড়িয়ে দিয়ে দলীয়ভাবে এর সব কৃতিত্ব ও গৌরব যেভাবে আত্মসাৎ করে ইতিহাসের চরম বিকৃতি ঘটিয়েছে, তার কোনো বিরোধিতা আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের স্তুতিগান এত বেশি ঢাকঢোল পিটিয়ে সব সময় করে, যা প্রায়ই অশ্লীলতার পর্যায়ে নেমে আসে। এ বিষয়ে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই। সংবাদপত্রের পাতা, বৈদ্যুতিক মাধ্যম, আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের সভা-সমিতি, তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের নানা কীর্তন, এমনকি রাস্তাঘাটে পোস্টার, দেয়াল লিখন ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণ তা প্রত্যক্ষ করেন।
সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে শীর্ষ আদালত ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করায় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করেছেন। সম্ভব হলে মনে হয়, তারা পদত্যাগ দাবি না করে তার অভিশংসন দাবি করতেন! কারণ নিজেদের জমিদারির মধ্যে প্রজা বিদ্রোহ কোন্ জমিদার সহ্য করতে পারে? তবে এক্ষেত্রে তারা একটু ঠাণ্ডা মাথায় এর প্রতিকার চিন্তা করতে পারতেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি আগামী বছরের প্রথম দিকেই অবসরে যাবেন। এরপর তারা নিজেদের অনুগত ও বিশ্বস্ত কোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত করে ষোড়শ সংশোধনী পুনর্বহালের চেষ্টা করতে পারেন! তবে এক্ষেত্রে শুধু প্রধান বিচারপতিই নয়, প্রায় সমগ্র বিচার বিভাগই এখন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে। কাজেই শুধু প্রধান বিচারপতি পরিবর্তনের মাধ্যমে যা ইচ্ছা করার ক্ষমতা সরকারের নেই। তাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যতবার সুপ্রিমকোর্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করবে, ততবারই জাতীয় সংসদ সেটা আবার প্রণয়ন করবে! এ ধরনের চিন্তা ও তার প্রকাশ্য ঘোষণা সাংবিধানিক রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ ‘কৃতিত্বের’ ব্যাপার! এ ধরনের ‘কৃতিত্ব’ অর্জনে আওয়ামী লীগের কোনো অরুচি নেই। কিন্তু এ কাজ অত সহজ নয়। কারণ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে যেসব কথা বলা হয়েছে, ইতিহাসের গতি-প্রকৃতির যে সমালোচনা করা হয়েছে সেগুলো উড়িয়ে দেয়ার নয়। ইতিমধ্যে জনগণের মধ্যেও এ বিষয়ে আলোচনা ও নতুন করে চিন্তাভাবনার অবস্থা তৈরি হয়েছে। গায়ের জোরে কিছুদিন এসব বিষয়কে আলোচনার বাইরে রাখা গেলেও চিরদিন তা হয় না। এখন দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এবং এক্ষেত্রে শীর্ষ আদালত যে ভূমিকা রেখেছেন তার মোকাবেলা সরকারকে অবশ্যই করতে হবে। গায়ের জোর, পুলিশ ও মিথ্যা মামলা দিয়ে এর মোকাবেলার দিন শেষ হয়েছে। বাস্তব রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের এই ধারা অগ্রাহ্য না করে যৌক্তিকভাবে এর মোকাবেলা করা দরকার। কিন্তু যৌক্তিকভাবে বিরোধিতা মোকাবেলা আওয়ামী লীগ কখন করেছে? তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও তো এদিক দিয়ে তাদের সাহায্য করার কোনো চেষ্টা করেনি! কাজেই ক্ষমতার মদমত্ত অবস্থায় সরকার হয়তো যা করবে তাতে বাংলাদেশে তথাকথিত সাংবিধানিক রাজনীতি আরও বড় আকারে ও গভীরভাবে সংকটে নিক্ষিপ্ত হবে। সে সংকট আওয়ামী লীগের জন্যও কোনো শুভ পরিণতি ডেকে আনবে না।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন