|
বদরুদ্দীন উমর
test@gmail.com |
|
মিয়ানমারে ফ্যাসিস্ট ও সাম্রাজ্যবাদীদের অভিন্ন অবস্থান
11 September 2017, Monday
কিছুদিন ধরে, বিশেষত এই মুহূর্তে, বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে রোহিঙ্গা সমস্যার ওপর সর্বাধিকারের ভিত্তিতে রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছে। এ সমস্যার ওপর অনেকেই লেখালেখি করছেন। এটা স্বাভাবিক। কারণ যেভাবে এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক হামলা হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের হাজারে হাজারে হত্যা করে সেদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তারা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। এ ধরনের গণহত্যা রুয়ান্ডার গণহত্যার মতো। শুধু তাই নয়, রুয়ান্ডার গণহত্যার থেকেও মারাত্মক। আন্তর্জাতিক মহলেও এ ঘটনার ওপর নানা ধরনের বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলোতে এ নিয়ে কোনো বিশেষ উদ্বেগ বা নড়াচড়া নেই, যদিও জাতিসংঘ থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ একটা করা হয়েছে। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে যেখানে জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশন ডাকা দরকার সে রকম কিছুই হচ্ছে না। এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের কোনো বৈঠকও এ নিয়ে ডাকা হয়নি। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের জনগণের ওপর এত বড় এক ফ্যাসিস্ট অমানবিক হামলা সত্ত্বেও কয়েকটি মুসলিম দেশ ছাড়া এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি মুসলিমপ্রধান দেশ থেকে কিছু ত্রাণ-সাহায্য বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গাদের জন্য। কিন্তু যে পরিমাণ সাহায্য আসছে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাছাড়া লক্ষ করার বিষয়, ‘মুসলিম উম্মাহর’ নেতা হিসেবে দাবিদার সৌদি আরব এবং তার বলয়ভুক্ত মিত্ররা এদিক দিয়ে প্রায় নীরব ও নিষ্ক্রিয়। অথচ এরা যে পরিমাণ ধনসম্পদের মালিক এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ নিয়ে এরা যত কথাবার্তা বলে, তাতে এক্ষেত্রে এই দেশগুলোরই মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে সব থেকে বেশি সোচ্চার হওয়া এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য সব থেকে বেশি ত্রাণ-সাহায্য পাঠানো দরকার। এসব কিছুই হচ্ছে না।
আরও লক্ষ করার বিষয়, ভারত, চীন, রাশিয়া ইত্যাদি থেকে নিয়ে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো নিজেদের জাতীয় স্বার্থে মিয়ানমারের ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষেই আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভাঁওতাবাজি হিসেবে মিয়ানমার সরকারের গণহত্যার ওপর কিছু প্রতিবাদ করলেও তারা কোনো কার্যকর পদক্ষেপের কথা এক্ষেত্রে ঘোষণা করছে না। তাদের কোনো ত্রাণ-সাহায্যও নেই। সাম্রাজ্যবাদীদের এই আচরণে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। উপরন্তু এটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। ভারত নাকি বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র। ১৯৭১ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছিল। কিন্তু তারপর থেকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে আজ পর্যন্ত যে আচরণ করে আসছে তাতে বন্ধুত্বের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বরং তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুসুলভ আচরণ তো নয়ই, উপরন্তু শত্রুসুলভ আচরণ করে এসেছে। তিস্তার পানি চুক্তি না করা এবং অন্য অনেক চুক্তি নিজেদের অনুকূলে করাই এর সব থেকে বড় প্রমাণ। এখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক আক্রমণ চালিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং এর ফলে বাংলাদেশে যে লক্ষাধিক নিঃস্ব রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছে এবং হাজার হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে, এ নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগই নেই! উপরন্তু তারা প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েই মিয়ানমার সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে! তবে এর ফলে বাংলাদেশের একতরফা বন্ধুত্ব যে কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ হবে বা তাতে কোনোভাবে চিড় ধরবে এমন সম্ভাবনার কথা চিন্তাও করা যায় না।
রোহিঙ্গারা ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি এবং ধর্মগতভাবে মুসলমান। মিয়ানমার সরকার মূলত রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ করছে জাতিগত বিদ্বেষের কারণে। কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ম। ধর্মকে এভাবে যুক্ত করে তারা মিয়ানমারের বৌদ্ধদের এমনভাবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে যাতে মনে হয় ব্যাপারটা শুধু ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক। চারদিকে প্রচারও সেভাবেই হচ্ছে। এ কারণে দেখা যাবে যে, রোহিঙ্গাদের প্রতি সমবেদনা ও সমর্থন জানিয়ে শুধু কয়েকটি মুসলমানপ্রধান দেশই এগিয়ে এসেছে এবং মুসলমানদের শত্রু হিসেবে ভারত সরকার বাংলাদেশের পরম বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের চরম উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদী হামলাকেই প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে সমর্থন করছে।
সামরিক বাহিনী সরাসরি রোহিঙ্গাদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপকভাবে হামলা চালিয়ে গেলেও এটা এখন হচ্ছে মিয়ানমারের একটা নির্বাচিত ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের অধীনে। এই ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার ক্ষমতায় এসেছে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে এক অগণতান্ত্রিক সমঝোতার মাধ্যমে। এই সমঝোতা অনুযায়ী মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র ও দেশরক্ষা মন্ত্রী হলেন সামরিক বাহিনীর লোক! কাজেই দেশের কোনো ধরনের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ওপর সুচিসহ ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের বেসামরিক দলীয় মন্ত্রীদের কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই! কাজেই এ ধরনের একটা সরকার নির্বাচিত হলেও তাকে গণতান্ত্রিক সরকার মনে করার কোনো কারণ নেই।
এ প্রসঙ্গে এ কথাটি মনে রাখা দরকার যে, সুচি সম্পূর্ণ জেনেশুনেই এ শর্তে ক্ষমতায় গেছেন। আসল ক্ষমতা সামরিক বাহিনীর হাতে থাকলেও যে ক্ষমতাটুকু তিনি ভোগ করছেন সেটাই তার কাছে যথেষ্ট। গণতন্ত্রী হিসেবে নিজের এক ধরনের ভাবমূর্তি তৈরি করলেও তিনিও যে সামরিক জান্তার মতোই ফ্যাসিস্ট চরিত্রসম্পন্ন এটা তিনি নিজেই এভাবে ক্ষমতায় গিয়ে এবং রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছেন। এ অবস্থায় তার নোবেল প্রাইজ প্রত্যাহারের জন্য কোনো কোনো মহল দাবি করছে। কিন্তু এ দাবি অর্থহীন এবং এর ফলে সুচির নোবেল প্রাইজ ফেরত নেয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই। কারণ শান্তির নামে যারা তাকে নোবেল প্রাইজ দিয়েছে, তাদের এ ধরনের কাজ এই প্রথম নয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার সাম্রাজ্যবাদীদের একটা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা সব সময়ই হিসাব করে শান্তি পুরস্কার দিয়ে এসেছে। তারা দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ নেতা, ইসরাইয়েল যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী থেকে নিয়ে আরও অনেক চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট ও গণশত্রুদের এ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। বারাক ওবামা প্রথমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানোর ঘোষণা দেয়ার সময়েই তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল! কাজেই শান্তি পুরস্কার দেনেওয়ালাদের গণতন্ত্রী ও জনদরদি মনে করার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। চিহ্নিত যুদ্ধবাজ, শান্তিবিরোধী এবং জনশত্রুদের এরা বরাবরই শান্তি পুরস্কার দিয়ে এসেছে। এটা তারা খুব হিসাব করে এবং জেনেশুনেই দিয়েছে। কাজেই তাদের এই নীতিগত অবস্থানের কারণে তারা সুচি কর্তৃক মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং সামরিক বাহিনীর সব নির্যাতন সমর্থন করার অপরাধে তার পুরস্কার বাতিল করবে, এটা ভাবার অর্থ নোবেল পুরস্কারের মালিক সাম্রাজ্যবাদীদের এক হিসাবে গৌরবান্বিত করা ছাড়া আর কিছু নয়। যারা সুচির নোবেল প্রাইজ প্রত্যাহারের দাবি করছেন, তারা যে এটা জেনেশুনে করছেন এমন নয়; তারা মিয়ানমারে সুচির ফ্যাসিস্ট অবস্থানের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই এই দাবি করছেন। কিন্তু তাদের এই দাবির যে কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই এটা এক মহাসত্য। আসলে মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে এখন সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, এটা থেকে সাম্রাজ্যবাদীদের চরম গণবিরোধী চরিত্র ভালোভাবেই উন্মোচিত হচ্ছে। চীন ও ভারতের মধ্যে শত্রুতা থাকলেও নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তারা যেভাবে এক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ, এটা চোখ খুলে দেয়ার মতোই এক ব্যাপার।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন