আলোচনার সুবিধার জন্য গানকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগকে বলা হয় লোকসঙ্গীত বা ফক সঙ, আরেক ভাগকে বলা হয় শিল্পসঙ্গীত বা আট সঙ। বাংলাদেশের মানুষের ছিল সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীতের ঐতিহ্য। কিন্তু যাকে বলা হয় শিল্পসঙ্গীত, তার শুরু হয়েছে ইউরোপীয় কণ্ঠসঙ্গীতের প্রভাবে। আর প্রধানত সাহিত্যিকদের হাতে। বাংলা শিল্পসঙ্গীতের বয়স বেশি নয়। তিনজন ব্যক্তির নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আসে। এরা হলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং রবীন্দ্রনাথ ইউরোপীয় সঙ্গীতের সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হন বিলাতে গিয়ে। কিন্তু নজরুল তার গানের শিক্ষা পেয়েছিলেন কেবল এই উপমহাদেশের উত্তর ভাগে অবস্থান করে। তবে এ ক্ষেত্রে একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হয়, তা হলোÑ এখন আমরা গান গাই সাধারণত হারমোনিয়াম বাজিয়ে। নজরুলও গান গেয়েছেন প্রধানত হারমোনিয়াম বাজিয়ে। হারমোনিয়াম দেশী বাজনা নয়। এ দেশে যাকে বলে টেবল হারমনিয়াম, যা বাজানো হয় দু’হাত দিয়ে এবং বেলো করা হায় দু’পা দিয়ে, তা নিয়ে আসেন ইউরোপীয় খ্রিষ্টান মিশনারিরা গির্জায় গানের জন্য। পরে কলকাতায় এই টেবল হারমোনিয়াম থেকে তৈরি হয় বক্স হারমোনিয়াম, যা আমরা বাজাই এক হাত দিয়ে বেলো করে। এই সাথে আরো মনে রাখতে হবে, হারমোনিয়ামে যে-স্কেল বা স্বরগ্রাম ব্যবহার করা হয়, তার উদ্ভব আমাদের দেশে হয়নি। একে বলা হয় ইকুয়ালি টেম্বার স্কেল বা সমান সমিক্রিত স্বরগ্রাম। এর উদ্ভব হয়েছিল ১৭৭৩ সালের কাছাকাছি, জার্মানিতে ক্লাভিকড তৈরি করতে। এর সাথে বিখ্যাত জার্মান সঙ্গীতজ্ঞ সিবাস্টিন বাখ্্-এর নাম বিশেষভাবে জড়িত। আমি এসব কথা বলছি, কেননা আমাদের দেশী শিল্পসঙ্গীত ঠিক দেশী নয়। আমরা প্রভাবিত হয়েছি বিদেশীদের মাধ্যমে। স্বরগ্রামের ইতিহাস আলোচনা করলে আমরা দেখি, আর্যরা গান করতো তিন স্বরে : উদাত্ত, স্বরিত ও অনুদাত্ত। কিন্তু বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতে ব্যবহার হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই সপ্তস্বর। যার সাথে মিল আছে (অনেক বিশেষজ্ঞর মতে) প্রাচীন সুমেরীয় সপ্তস্বরের। অর্থাৎ আমাদের প্রাচীন লোকসঙ্গীত হতে পারে সংশ্লিষ্ট সুমেরীয় ঐতিহ্যের সাথে, আর্য সঙ্গীত ধারার সাথে নয়। নৃতাত্ত্বিকদের মতে, মানুষ প্রথম সুর বেঁধেছে তিন স্বরে ( সা গা পা)। তারপর বেঁধেছে পাঁচ স্বরে (সা রে গা পা ধা)। এর পরে এসেছে সপ্তস্বরে গান (সা রে গা মা পা ধা নি)। গ্রিকরা যে লিয়ার (খুৎব) বাজাত, তাতে থাকত আটটি তার। অর্থাৎ সা রে গা মা পা ধা নি এবং চড়া সা। এই স্বরগ্রামকে ভেঙে পরে বারো ভাগ করা হয় ক্লাভিকড ও পরে পিয়ানোর জন্য। পিয়ানোর অনুকরণ করা হয় হারমোনিয়ামে। আমরা হারমোনিয়ামের সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইতে শিখি। এ শেখার পদ্ধতি আমরা পেয়েছি ইউরোপের কাছ থেকে। যার সূচনা হতে পেরেছিল গির্জার গানের মাধ্যমে। গির্জায় গানের মাধ্যমে প্রার্থনা করা হয়। কিন্তু মসজিদে গানের মাধ্যমে প্রার্থনা করা হয় না। খ্রিষ্টধর্ম আর ইসলামে আছে এ ক্ষেত্রে পার্থক্য। তবে ইসলামেও সুকণ্ঠের দাম আছে। মুসলমানেরা কুরআন শরিফ প্রায় গানের ধারাতেই পড়েন। আল কুরআনে বলা হয়েছে, অন্যের প্রতি মুখ বাঁকা করে চলবে না; হেঁট না গর্বভরে পাটিতে পা ফেলে; একরোখা আর অহঙ্কারীদের ভালোবাসেন না আল্লাহ। সংযত হও; কথা বল নিচু স্বরে; চিৎকার করো না গাধার মতো। কেননা গাধার স্বর সুমিষ্ট নয় (সূরা লোকমান, আয়াত ২৮-১৯)। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহ সব নবীকেই সুকণ্ঠের অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন।
ইসলামে কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে বাজনা বাজাতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু কেবল ইসলামেই যে কণ্ঠসঙ্গীদের সাথে বাজনা বাজাতে নিষেধ করা হয়েছে তা নয়। বিখ্যাত প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটো তার রিপাবলিকে বলেছেন, কণ্ঠসঙ্গীতের সাথে বাজনা বাজানো উচিত নয়। কেননা বাজনার আড়ালে ঢাকা পড়ে যেতে চায় কণ্ঠের সুমিষ্টতা। অনেকেই মনে করেন ইসলাম সঙ্গীতচর্চার পরিপন্থী। কিন্তু ইসলামে সব রকম সঙ্গীত চর্চাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। যে সঙ্গীত মানুষকে কর্মপ্রেরণা জোগায় এবং শ্রমক্লান্তি দূর করে, ইসলামে তা নিষিদ্ধ নয়। কথিত আছে যে, কাবা শরিফের কিছুটা অংশ ভেঙে যায়। রাজমিস্ত্রিরা তা মেরামত করতে থাকে। তারা তাদের কাজের সময় গান গাইছিল। নবীজী তাদের গান করতে নিষেধ করেছিলেন না। যে গান মানুষকে কর্মমুখী করে ইসলামে সে গান নিষিদ্ধ নয়। এরকমই বলেছেন অনেকে। প্লেটো তার রিপাবলিকে বলেছেন, আদর্শ রাষ্ট্রে সব সুরেই গান গাওয়া যাবে না। যেমন লিডিয়ান সুরে গান গাওয়া যাবে না। কেননা, মানুষকে তা করে তোলে শোকাতুর। আদর্শ রাষ্ট্রে আয়নীয় সুরে গান গাওয়া যাবে না। কেননা, তা প্রশ্রয় দেয় মাৎসর্যের। আদর্শ রাষ্ট্রে গান গাইতে হবে ডরিয়ান সুরে। কারণ তা মানুষকে উদ্দীপিত করে বীররসে। আদর্শ রাষ্ট্রে ফ্রিজিয়ান সুরে গান গাওয়া চলবে, কেননা তা মানুষকে করে মিতাচারী। অর্থাৎ সঙ্গীতের বিচার কেবল তার বিনোদন মূল্য দিয়েই করা যাবে না। কোন সঙ্গীত মানুষের ওপর কী ধরনের প্রভাব বিস্তার করছে সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। বিশেষ করে আদর্শ রাষ্ট্রে। বিখ্যাত ইমাম আল গাজ্জালি গ্রহণযোগ্য ও অগ্রহণযোগ্য সঙ্গীতের বিভাগ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি আলোচনা করেছেন তার বিখ্যাত ‘এহইয়া-আল উলুমুদ্দীন’ গ্রন্থে। অনেকের মতে, মুসলিম সমাজে বিশেষ করে বাংলার মুসলিম সমাজে গান ছিল অপাঙ্ক্তেয়। নজরুল তার ইসলামি গানের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে গানকে করে তোলেন গ্রহণযোগ্য। এ কথা কিছু পরিমাণে সত্য হলেও গ্রামবাংলায় কৃষিজীবী মুসলমানের মধ্যে ছিল লোকসঙ্গীতের প্রাচুর্য। সে কথাও মনে রাখতে হয়। নৌকার মাঝিরা গান গেয়েছেন, কৃষকরা মাঠে ধান কাটতে গান গেয়েছেন, গরু-গাড়ি চালকরা গরু-গাড়ি চালাতে চালাতে গেয়েছেন গান। তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল জারি নাচ। প্রচলিত ছিল জারি গান। আসলে বাংলাদেশের নিজস্ব নাচ বলতে বুঝতে হয় জারি নাচকেই। গানের কথা আলোচনা করতে হলে গ্রামবাংলার কথা ভুললে চলে না। আসলে সুরের উদ্ভব হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই। পরে তাকে দেয়া হয় রাগ-রাগিণীর রূপ। প্রথমে উদ্ভব হয় সুরের, তারপর আসে সুরের ব্যাকরণ।
১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম ক্লাব। এর সাথে ছিল একটা গ্রন্থাগার। আর এখানে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠিত হতো বিবিধ প্রসঙ্গে আলোচনা। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম ক্লাবের প্রতিষ্ঠার দিনে নজরুলকে অতিথি করে আনা হয়েছিল। তাকে দেয়া হয়েছিল বিশেষ মানপত্র। রাজশাহী শহরে অবস্থানকালে এক মজলিসে নজরুল গেয়েছিলেন গান। সে সময় মুসলমান সমাজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়াকে মনে করা হতো শরিয়ত বিরুদ্ধ। বড়দের কাছে শুনেছি, ওই মজলিসে গান বন্ধ করার জন্য ফেলা হয়েছিল কয়েকটি ঢিল। কিন্তু নজরুলের গান গাওয়া তাতে বন্ধ হয়নি। কেননা বিরাটসংখ্যক তরুণ এসে দাঁড়ান নজরুলের পক্ষে। নজরুল ওই মজলিসে অনেক গান গেয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল
বাজলো কিরে ভোরেরই সানাই
নিঁদ মহলার আঁধার পুরে।
শুনছি আজান গগনতলে
অতীত রাতের মিনার চূড়ে।
এই গানটি শুনে নাকি গোঁড়া মুসলমানেরা খুবই অভিভূত হয়েছিলেন। বলেছিলেন এ রকম গান শরিয়ত বিরুদ্ধ নয়। বরং বলতে হবে শরিয়ত অনুকূল। কেননা এরকম গান মুসলিম আবেগকে সংহতকারী; ধ্বংসকারী নয়। যা কিছু ইসলামি আবেগকে সুসংহত করে, সমাজকে তা দেয় সুশৃঙ্খলা। সামাজিক সুশৃঙ্খলা ইসলামের কাম্য।
রাজশাহী জেলার সীমান্ত থেকে বেশি দূরে নয়, পদ্মার অপর পারে মুর্শিদাবাদ জেলায় নিমতিতা নামে একটি গ্রাম আছে। এখানে নজরুল, জানি না ঠিক কিভাবে, বরদাচরণ মজুমদার নামে এক ব্যক্তির সাথে পরিচিত হন। এই বরদাচরণ ছিলেন কালী সাধক। বরদাচরণ নজরুলকে বলেন, তিনি যদি তার কথা মতো কালী সাধনা করেন, তবে তিনি তার রোগ থেকে মুক্ত হবেন। নজরুল বরদাচরণ মজুমদারের পদ্ধতি অনুসারে কালী সাধনা শুরু করেন। কিন্তু তার রোগ মুক্তি হয় না। তার রোগ পরিণত হয় চিকিৎসার অযোগ্য। তিনি কালী সাধনা না করে যদি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেন, তবে তার রোগ সারতেও পারত। কেননা তার যে রোগ হয়েছিল, সেটা প্রথম অবস্থায় চিকিৎসা করলে তখন সারতে পারত। রোগটি চিকিৎসার জন্য তখন একটি ওষুধ ছিল, যাকে ইংরেজিতে বলা হতো, ৬০৬। তখনো কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু নজরুল ধরেই নেন চিকিৎসকরা তার অসুখ সারাতে পারবেন না। রোগ সারবে অধ্যাত্ম পদ্ধতিতে। আর বরদাচরণ জানেন সেই পদ্ধতি। নজরুল কেবল কালী সাধনায় প্রমত্ত হন না, রচনা করেন অনেক শ্যামাসঙ্গীত। লেখেনÑ
শ্যামা তোর নাম যার জপমালা
তার কি মা ভয় ভাবনা আছে।
দুঃখ অভাব রোগ শোক জরা
লুটায় তাহার পায়ের কাছে॥
নজরুলের এই আধ্যাত্মিক বিবর্তন অনেককেই বিস্মিত করেছিল। কেননা যে কবি একদিন লিখতে পেরেছিলেনÑ
বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি, নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর-
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-
বিধাত্রীর!
তিনি তার রোগমুক্তির জন্য করতে শুরু করলেন শ্যামাসঙ্গীত রচনা। আর আরম্ভ করলেন বিশেষভাবে কালী সাধনা। নজরুল তার প্রথম জীবনে ছিলেন সাম্যবাদের পক্ষে। তিনি খ্যাত হন সাম্যবাদের কবি হিসেবে। কিন্তু তিনি ১৯৪১ সালে মায়ামুকুর বলে কিশোরদের জন্য একটি কবিতা লেখেন। যাতে তিনি বলেন, হিটলার হলেন একজন মহামানব। আর কিশোরদের উচিত হবে হিটলারের মতো মহামানব হওয়ার সাধনা করা। কবিতাটি আমি আমার স্কুলের ছাত্রজীবনে শুনেছিলাম এক শিক্ষকের মুখে। তিনি ক্লাসে নজরুলের এই কবিতাটিকে পড়ে শুনিয়েছিলেন খুব সুন্দর আবৃত্তি করে। আমাদের এই শিক্ষক ছিলেন হিন্দু এবং পড়াতেন বাংলা। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে নজরুলকে পছন্দ করতেন অনেক বেশি। কেবল তাই নয়, ইনি প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন সৈন্য হিসেবে। নজরুলের সঙ্গে কিছু দিনের জন্য ছিলেন করাচিতে। ইনি ছিলেন রাজশাহীর বাসিন্দা।
এবারের নজরুল জয়ন্তীতে কোনো এক পত্রিকায় কোনো এক ব্যক্তির লেখাতে পড়লাম, নজরুলই নাকি একমাত্র কবি, যিনি ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে জেল খেটেছেন। লেখাটি পড়ে আমার মনে হলো, তিনি যে তথ্য দিয়েছেন সেটা যথাযথ নয়। আমি যতদূর জানি, আরেকজন কবিও ব্রিটিশবিরোধী কবিতা লিখে জেল খেটেছিলেন। তার নাম ঈসমাইল হোসেন শিরাজী। তার কাব্যগ্রন্থের নাম হলো ‘অনলপ্রবাহ’। ঈসমাইল হোসেন শিরাজী ইরানের শিরাজ শহরের অধিবাসী ছিলেন না, তিনি নামের শেষে শিরাজী লিখতেন, সিরাজগঞ্জের অধিবাসী ছিলেন বলে। শিরাজী সাহেব বলকান যুদ্ধের সময় তুরস্কে গিয়েছিলেন একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। তিনি নজরুলের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে দশ টাকা পাঠিয়েছিলেন আর বলেছিলেন তার পক্ষে যদি আরো টাকা দেয়া সম্ভব হতো, তবে তিনি তা দিতেন। নজরুলের কবিতা তাকে মুগ্ধ করেছে। নজরুলের সাহিত্য সাধনার পিছে যাদের দান আছে, তাদের মধ্যে শিরাজী সাহেবের কথাও আসে। কিন্তু তিনি এখন আর আগের মতো আলোচ্য নন। যদিও বাংলার মুসলমান সমাজের জাগরণের ক্ষেত্রে তার দান সামান্য নয়।
সেটা ১৯৫৮ সালের কথা। কবি, গীতিকার, সুরকার সিকান্দার আবু জাফর তখন থাকতেন ঢাকায় টিকাটুলিতে একটি ভাড়া বাড়িতে। তার সেই বাড়ির বৈঠকখানা ছিল তার প্রকাশিত ও সম্পাদিত মাসিক ‘সমকাল’ পত্রিকারও অফিস। সেখানে একদিন অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা হচ্ছিল নজরুল সাহিত্য ও সঙ্গীত নিয়ে। জনাব জাফর বলেন, নজরুলের কবিতা আমাদের কাছে আর বেশি দিন আদৃত থাকবে না কিন্তু তার রচিত ও সুরারোপিত গান আমাদের কাছে আদৃত হবে বহু দিন। গানের ভুবনে তিনি থাকবেন অম্লান হয়ে। জাফর সাহেবের কর্মজীবন আরম্ভ হয়েছিল কলকাতায়, এ কে ফজলুল হকের ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরির মধ্য দিয়ে। আর এ সময় নজরুল ছিলেন নবযুগ পত্রিকার সম্পাদক। জাফর সাহেবের নজরুল সম্পর্কে ছিল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তার সাহিত্য রুচিও ছিল যথেষ্ট প্রখর। তাই তার নজরুল সম্পর্কে মূল্যায়নকে আমি গ্রহণ করা প্রয়োজনীয় মনে করছি। তখনকার ঢাকা আর আজকের ঢাকার মধ্যে কোনো সুদূর তুলনা চলে না। তখনো ঢাকায় অনেকে ভাবতেন ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে নজরুলের এই গানটির প্রচার করা উচিত নয়।
বসিয়া বিজনে কেন একা মনে
পানিয়া ভরণে চল লো গোরী
চল জলে চল কাঁদে বনতল
ডাকে ছল ছল জল-লহরী
দিবা চলে যায় বলাকা-পাখায়
বিহগের বুকে বিহগী লুকায়!
কেঁদে চখা-চখী মাগিছে বিদায়
বারোয়াঁর সুরে ঝুরে বাঁশরী॥
তাদের যুক্তি ছিল গানটি শ্রীরাধাকে নিয়ে লেখা। এখানে শ্রীরাধাই যাচ্ছেন পানিয়া ভরণে। পানিয়া ভরণে কথাটা হিন্দি। বাংলায় চলে না। বাংলায় বলে চলকে চল। আজকের বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে খুবই উদার। সুপ্রিম কোর্টের চত্বরে তাই বসতে পারছে গ্রিক দেবীর মূর্তি। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হতে পারছেন এমন ব্যক্তি, যিনি কেবল যে মুসলমান নন তাই নয়, তিনি জন্মসূত্রেও বাঙালি নন। তিনি হলেন বিষ্ণুপুরিয়া মণিপুরী।
আমরা আলোচনা করছিলাম গীতিকার ও সুরকার নজরুলকে নিয়ে। নাজরুলের গান গাইতে হলে যথেষ্ট কণ্ঠ সাধনার প্রয়োজন পড়ে। গলা তৈরি ছাড়া তার গান গাওয়া যায় না। বিখ্যাত মারাঠি গায়িকা আশা ভোঁসলে (লতা মঙ্গেশকরের মেজ বোন) নজরুলের গান সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেন, নজরুলের গানে আছে কণ্ঠশিল্পীর স্বাধীনতা। শিল্পী এখানে মূল সুরকে বজায় রেখে নিজের সুরও কিছুটা যোগ করতে পারেন। দেখাতে পারেন গলার কাজ। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে এটা পারা যায় না। নজরুল সঙ্গীতে গাইতে গাইতে যদি কোথাও একটু আলাপ বা বিস্তারের ইচ্ছা জাগে, তাহলে সেটা করার স্বাধীনতা আছে। কণ্ঠশিল্পী গানের মূল সুরের ইন্টারপ্রিটেশন বা ব্যাখ্যা দিতে পারেন। আর সেটাই নজরুলের গানের প্রতি সৃষ্টি করে বিশেষ আকর্ষণ। ওই লেখায় রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে তার যথেষ্ট অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু নজরুলের গান করতে তার সেই অসুবিধা হয়নি। তিনি আরো বলেন যে, যেহেতু তিনি গলা সেধে গানের গলা তৈরি করেছেন, তাই তার পক্ষে সহজ হয়েছে নজরুলের গান করা। নজরুলের গান কেবল তাদের পক্ষেই করা সম্ভব, যারা গলা সেধে গান গাইতে শিখেছেন (সানন্দা : জুলাই, ১৯৯১, কলকাতা)।
আশা ভোঁসলে মারাঠি মেয়ে। বাংলা তার মাতৃভাষা নয়। তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন আবার নজরুলের গানও গেয়েছেন। কিন্তু নজরুলের গান গেয়ে তিনি তৃপ্তি পেয়েছেন বেশি।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন