মিয়ানমার যদি আমাদের সাথে যুদ্ধ চায়, তবে কি আমরা একতরফা আঘাত সহ্য করে নেবো
মিয়ানমার যদি আমাদের সাথে যুদ্ধ চায়, তবে কি আমরা একতরফা আঘাত সহ্য করে নেবো
বাংলাদেশের একটা সেনাবাহিনী আছে। আমরা যদি মনে করতাম, সব সমস্যার সমাধান কেবল কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমাধান করা যায়, তবে নিশ্চয়ই এত ব্যয় করে সেনাবাহিনী রাখা যুক্তিযুক্ত মনে করতাম না। ১৯৭১ সালে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে চুক্তি করেছিল, বাংলাদেশের কোনো পৃথক সেনাবাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য থাকবে পুলিশ ও মিলিশিয়া। কিন্তু শেখ মুজিব এই চুক্তি নাকচ করে দেন। ফলে সৃষ্টি হতে পারে বাংলাদেশের একটা পৃথক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এ দেশে কথিত প্রগতিশীল বাম চিন্তকেরা সব সময় বলে আসছেন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে, যুদ্ধের মাধ্যমে নয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়েছে বিশাল সেনাবাহিনী। বানিয়েছে পরমাণু বোমা, হাইড্রোজেন বোমা ও তা বহন করার জন্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র)।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন ভেঙে গেছে। কিন্তু রাশিয়া এখনো দম্ভভরে কথা বলতে পারছে তার সামরিক শক্তির জোরেই। বর্তমানে উত্তর কোরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় দেখাচ্ছে হাইড্রোজেন বোমা নিক্ষেপের। এ রকম একটি বিপজ্জনক বিশ্বে যারা মনে করেন কেবল আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে, তারা আর যাই হোন, বাস্তববাদী নন। ইংরেজি প্রবচনে বলে War is the logical extension of diplomacy. অর্থাৎ যুদ্ধ হচ্ছে কূটনীতির যুক্তিযুক্ত উপসংহার। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যাদের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের ভক্ত, তারা বলছেন মিয়ানমারের সাথে আমরা যুদ্ধ চাই না। কিন্তু মিয়ানমার যদি আমাদের সাথে যুদ্ধ চায়, তবে কি আমরা একতরফা আঘাত সহ্য করে নেবো?
বহু মিথ্যা কথাই বলে এসেছেন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীর দল। তারা মিথ্যা কথা বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের নামেও। যার প্রমাণ মিলছে সম্প্রতি প্রকাশিত (২০১২ খ্রিষ্টাব্দ) শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে। শেখ মুজিব তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নেই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নেই।’ তিনি তার এই আত্মজীবনীর আরেক জায়গায় বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আর একটা হলো আমরা বাঙালি।’ শেখ মুজিবুর রহমানের এই কথাগুলো আমি এখানে উদ্ধৃত করবার প্রয়োজন মনে করছি এ জন্য যে, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় তসলিমা নাসরিন লিখেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ নন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ হলে রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিতেন না। যেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার সারা পৃথিবীর সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে, সেখানে ছাপা হতে পারছে বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় তসলিমা নাসরিনের এহেন ধরনের প্রবন্ধ। গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক’দিন আগে বলেছেন, মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার বন্ধ না করে, তবে ব্রিটেনে মিয়ানমারের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান বন্ধ করে দেয়া হবে। বিলাতের লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা চালানো হচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। তার মতে, রোহিঙ্গারা দীর্ঘ নিপীড়নের শিকার, যা আর বাড়তে দেয়া উচিত নয়।
কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কেবলই বলে চলেছেন কূটনৈতিক তৎপরতার কথা। যা হবে কেবলই কালক্ষেপণ মাত্র। কেননা, মিয়ানমার পরিচালিত হচ্ছে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে। আর তারা চাচ্ছে যুদ্ধের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান। মিয়ানমারে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় নেই। আসল ক্ষমতা আছে সেনাবাহিনীর হাতে। যার প্রধান হলেন মিন অং লাইং। বর্তমান মিয়ানমারের রাজনৈতিক দর্শন হলো বৌদ্ধ সমাজতন্ত্রবাদ। সেনাবাহিনীর পরই মিয়ানমার পরিচালিত হচ্ছে থেরাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষু নেতাদের দিয়ে। যারা মুসলিম মৌলবাদীদের চেয়ে মোটেও কম মৌলবাদী নন। আমাদের দেশের যারা মিয়ানমারের এই রাজনৈতিক দর্শনের সাথে পরিচিত নন, তারাই কেবল বলতে পারেন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান আসতে পারবে। মিয়ানমারের বৌদ্ধ সমাজতন্ত্রের ধারণা খুবই গোঁড়ামিপূর্ণ, যা সহজে দূরীভূত হওয়ার নয়। মিয়ানমার যদি যুদ্ধ চায়, তবে আমাদেরও করতে হবে যুদ্ধ। কেননা, শক্তির যুক্তিকে কেবল শক্তির মাধ্যমেই জবাব দেয়া চলে। আর এ পৃথিবীতে কেবল বীরেরাই পেতে পারে ন্যায্য বিচার; কাপুরুষেরা নয়।
আরাকান এক সময় ছিল একটা পৃথক স্বাধীন রাজ্য। সে প্রাচীন বার্মার অংশ ছিল না। খাঁটি বর্মি বা ম্রনমারা বার্মার যে ভূভাগে বাস করে, মানচিত্রে তা দেখে মনে হয় কতকটা মাকুর আকৃতিবিশিষ্ট। এই অঞ্চল খুবই উর্বরা। আর কৃষিকাজের উপযোগী। বার্মার রাজধানী মন্দালয় থেকে ইরাবতি নদীর বদ্বীপ পর্যন্ত এই অঞ্চল বিস্তৃত। পাশ দিয়ে আছে শিতাং নদীর উপত্যকা। এই ভূ-ভাগকে বলা হয় বর্তমান বার্মার কেন্দ্রভূমি। এ অঞ্চলের মানুষের ভাষা হলো আধুনিক বর্মি বা ম্রনমা। থেরাবাদী বৌদ্ধ ধর্ম ও বর্মি ভাষাকে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের সংস্কৃতি ও জাতীয় ভাব। উচ্চ ও নি¤œ বার্মার রাজারা এ অঞ্চলকে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন একটি ঐক্যবোধ, যা হলো আধুনিক বর্মি বা ম্রনমা জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক ভিত্তি। কিন্তু মিয়ানমারের সব মানুষই ম্রনমা নন। ম্রনমাদের ঘিরে আছে কারেন, কাচিন, চীন, সান, মন প্রভৃতি জাতি। যাদের ভাষা ম্রনমা নয়। কারেনদের বেশির ভাগই আবার গ্রহণ করেছে খ্রিষ্টান ধর্ম। ম্রনমাদের সাথে চলেছে এসব জাতির বিরোধ। এরা হতে চাচ্ছে স্বাধীন।
বার্মায় বিভিন্ন জাতির সাথে ম্রনমাদের যুদ্ধ চলেছে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে; যখন থেকে বার্মায় হয়েছে ব্রিটিশ শাসনের অবসান। বার্মার সরকার যদি বাংলাদেশের সাথে যুদ্ধ শুরু করে, তবে বার্মার অন্য জাতিগুলো তাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আবার ভয়ঙ্কর যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরপরই আরাকানিরা বিদ্রোহ করেছিল স্বাধীন হওয়ার জন্য। যার সাথে রোহিঙ্গারা সংশ্লিষ্ট ছিল না। আমরা বেশির ভাগই আরাকানের এই ইতিহাস সম্পর্কে অবগত নই। আরাকানের শতকরা ৩৬ ভাগ লোক হলো মুসলমান। উত্তর ও পূর্ব আরাকানের মানুষ কথা বলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলায়। এখানে বৌদ্ধ আরাকানিরাও এই ভাষা বুঝতে ও বলতে পারে। আরাকানের অন্যতম শহর গুচি দংয়ে বিশেষভাবে চলে চট্টগ্রামের বাংলা; আরাকানি ভাষা নয়। ভাষাগত দিক থেকে আরাকানের এই অংশকে তাই মনে করা চলে বাংলাদেশ। এখান থেকে রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশের মধ্যে। যেটাকে আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী আবদুল মাল আবুল মুহিত বলেছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের যুদ্ধ ঘোষণা। প্রয়োজনে তাই আমাদের সেনাবাহিনীকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতেই হবে। কেবল আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান আসবে বলে মনে করা যায় না।
সম্প্রতি মিয়ানমারের পত্রপত্রিকা বাংলাদেশকে নিয়ে নানান প্রচারণা চালাচ্ছে। এসব প্রচারণার উদ্দেশ্য হতে পারে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের (Psychological Warfare) অংশ। তবে লক্ষ করার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকার আরাকান সীমান্তে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে কেবল বিজিবি নিয়োগ করছিল। কিন্তু এখন রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণে সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের সেনাবাহিনী এখন আর আরাকান সীমান্ত থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, আরাকানের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে রয়েছে ঘন বনে আবৃত সুউচ্চ পর্বতমালা (আরাকান ওমা)।
এই পাহাড়ের মধ্য দিয়ে কয়েকটি গিরিপথ আছে। কিন্তু এসব গিরিপথের মধ্য দিয়ে যাওয়া-আসা করা এখনো যথেষ্ট কঠিন। এসব গিরিপথের মধ্য দিয়ে সৈন্য, রসদ ও যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম নিয়ে আসা এখনো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। জাপানিরা সমুদ্রপথে এসে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে বার্মার মূল ভূখণ্ড দখল করে নেয়। পরে ১৯৪২ সালে বার্মার মূল ভূখণ্ড থেকে স্পিডবোটে করে এসে জয় করে আরাকান।
কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আরাকানে যেতে আমাদের সেনাবাহিনীকে কোনো পাহাড় পেরোতে হবে না। পায়ে হেঁটেই, সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে তারা অবাধে ঢুকতে পারবে উত্তর-পূর্ব আরাকানে; যা হলো রোহিঙ্গাদের মূল আবাসভূমি। চীন, রাশিয়া, ভারত যদি নিতে চায় মিয়ানমারের পক্ষ, তবে বাংলাদেশের পক্ষে এসে দাঁড়াবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এরা ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের করেছে প্রতিবাদ। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব আছে বাংলাদেশের পক্ষে। বিশেষ করে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। যুদ্ধ তাই মিয়ানমারের পক্ষে যাবে, এমন কথা সমরবিশারদরা মনে করছেন না। মিয়ানমারের টেনাসেরিন ও মালয়েশিয়ার আছে যুক্ত সীমান্ত। এই সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হলে মিয়ানমারের পক্ষে তা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের যুদ্ধের জন্য বলতে হবে সম্পূর্ণ অনুকূল। ভৌগোলিক পরিস্থিতি সর্বক্ষেত্রেই যুদ্ধের জয়-পরাজয়কে বহুলভাবে নিয়ন্ত্রিত করে। এ ক্ষেত্রেও করবে।
বিখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) তার বিখ্যাত উপন্যাস শ্রীকান্ত-এর দ্বিতীয় পর্বে বার্মা সম্পর্কে অনেক কিছুই লিখেছেন। বার্মায় হিন্দু তরুণেরা গিয়ে বর্মি মেয়েদের বিয়ে করছে। কিন্তু তারা স্ত্রী ও তাদের গর্ভজাত সন্তানদের রেখে একপর্যায়ে দেশে পালিয়ে আসত। পালিয়ে আসার সময় অনেকেই তাদের বর্মি স্ত্রীর সর্বস্ব অপহরণ করত। কিন্তু রোহিঙ্গা মুসলমানরা আরাকানে এ রকম কিছু করেনি।
ইংরেজ আসার অনেক আগে থেকেই তারা গিয়েছে আরাকানে। তাদের আরাকানে যাওয়ার ইতিহাস হলো ভিন্ন। তারা আরাকানের অর্থনীতিতে রেখেছে অবদান। ম্রনমারা বাঙালিদের পছন্দ করেনি। কেননা, বাঙালিরা (বাঙালি বলতে তারা মূলত বোঝে হিন্দু বাঙালিদের) তাদের অনেক ক্ষতি করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা সমুদ্রপথে মিয়ানমারে গিয়ে কোনো ক্ষতি করেনি। তারা থেকেছে আরাকানেই সীমিত। বাঙালি হিন্দুর অপকর্মের জন্য রোহিঙ্গারা আদৌ দায়ী নয়। যদিও তারা দেখতে বাঙালি হিন্দুর যথেষ্ট কাছাকাছি। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ড থেকে সৈন্যরা এসে খুন করছে রোহিঙ্গাদের। এই খুনকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যেতে পারে না। অতীতে আরাকান ছিল একটা পৃথক রাজ্য। এই রাজ্য ছিল বাংলাদেশের খুবই ঘনিষ্ঠ। ভবিষ্যতে এ রকম কিছু হওয়া অসম্ভব নয়।হ
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন