‘সংস্কৃতি’ (কালচার) শব্দটা নৃতত্ত্বে যথেষ্ট সম্প্রসারিত অর্থে ব্যবহার হয়। মানুষই একমাত্র প্রাণী, যার আছে সংস্কৃতি। অন্য প্রাণীরা চলে সহজাত প্রবৃত্তির প্রেরণায়। কিন্তু মানুষ চলতে চায় তার সচেতন সত্ত্বা নির্ভর করে। একটা সাধারণ দৃষ্টান্ত নেয়া যেতে পারে। মাকড়সা জাল বোনে। তার এই জাল বোনাটা সহজাত। সে এটা লাভ করে জন্মসূত্রে। একটি মাকড়সা আর একটা মাকড়সার কাছ থেকে জাল বোনা শেখে না। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে কাপড় বোনাটা মাকড়সার জাল বোনার মতো নয়। কাপড় বোনা তাকে শিখতে হয় অন্য মানুষের কাছ থেকে। এটাকে বলতে হয় তার সামাজিক উত্তরাধিকার। কেননা, মানুষ কাপড় বোনা শেখে সচেতনভাবে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে। আর সমাজ বলতে বোঝায় পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল বহু মানুষের সমষ্টিকে। মানুষ যা শেখে, তাই সংস্কৃতি। মানুষ রিরংসা লাভ করে জন্মসূত্রে। কিন্তু বিয়েব্যবস্থা মানুষের সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। একইভাবে ক্ষুৎ-পিপাসা মানুষ লাভ করে জৈবিক জন্মসূত্রে। কিন্তু রন্ধনকর্ম তার সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। পিঁপড়ারা একরকম ছত্রাককে নিজের বাসায় নিয়ে গিয়ে লাগায় এবং প্রয়োজনে তাদের আহার করে। তারা একরকম পতঙ্গকে নিয়ে গিয়ে তাদের বাসায় পোষে করে এবং তাদের দেহ-নিঃসৃত মিষ্টি রস সেবন করে। কিন্তু এটা তারা করে চলে বংশপরম্পরায়; ঠিক সচেতনভাবে নয়। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে কেবলমাত্র আহার্য আহরণ করে না, করে সচেতনভাবে আহার্য উৎপাদন। আর এক কথায় কৃষিকর্ম। আমরা যাকে বলি সংস্কৃতি, তার একটা বিরাট অংশই হলো আমাদের অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টা।
আমাদের অর্থনৈতিক কর্মপ্রচেষ্টার উন্নয়ন নির্ভর করে উৎপাদন যন্ত্রের প্রকর্ষের ওপর। উৎপাদন যন্ত্রের প্রকর্ষের ওপর নির্ভর করে সংস্কৃতির বিকাশ। মানুষ একমাত্র প্রাণী, যে আগুনের ব্যবহার ও আগুন জ্বালাবার কৌশল আয়ত্ত করতে পেরেছে। আর তাই সম্ভব হয়েছে উৎপাদন পদ্ধতিতে বিকাশ সাধন করতে পারা। বিভিন্ন মানব সম্প্রদায়ের মতো আমাদের সংস্কৃতির বিশ্লেষণ করতে হলে তাই আসে অর্থনৈতিক জীবনের বিশ্লেষণ। মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের বিশ্লষণ করতে হলে আবার আসে দু’টি ধারণা। একটিকে চিহ্নিত করতে পারা যায় উৎপাদনশক্তি হিসেবে। আরেকটিকে চিহ্নিত করতে পারা যায় উৎপাদনসম্বন্ধ হিসেবে।
উৎপাদনশক্তি কলতে অর্থনীতিবিদেরা বোঝেন, উৎপাদনের কাজকর্মে প্রশিক্ষিত মানুষকে; বোঝেন উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত সাজ-সরঞ্জামকে; বোঝেন সেসব সাজ-সরঞ্জামকে দিয়ে যেসব প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগানো হয়, তাদের। অন্য দিকে উৎপাদনসম্বন্ধ বরতে বোঝায়, উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত মানুষের শ্রমবিভাজনকে। মানুষ কেউ করে কৃষিকাজ, আবর কেউ করে বস্ত্র বয়ন। এ হলো শ্রমবিভাজনের একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে একই রকম প্রাকৃতিক সম্পদ মেলে না। প্রাকৃতিক সম্পদের পার্থক্যের জন্য বিভিন্ন দেশের মানুষের জন্য গড়ে উঠতে চায় ভৌগোলিক শ্রমবিভাজন। একটি দেশের সংস্কৃতির বিশ্লেষণে এসব কথা আসে। মানুষের সংস্কৃতির একটা বড় দিক হচ্ছে, মানুষে মানুষে একত্রে বাস করতে পারা। এই একত্রে বাস করতে পারার ক্ষেত্রে এসেছে নীতি-চেতনার প্রশ্ন। নীতি-চেতনার একটি দিক নিয়ন্ত্রিত হয়েছে ধর্ম-চেতনার দিয়ে। ধর্ম-চেতনাকে বলা যায় নীতি-চেতনার আদিম উৎস। মানুষের মধ্যে উদ্ভব হয়েছে সৌন্দর্য-চেতনার। সব রূপ মানুষের ভালো লাগেনি। সে চেয়েছে সুন্দর রূপের উদ্ভাবন। মানুষ জ্ঞানের অন্বেষণ করেছে। কিন্তু সে কেবল জ্ঞানের সাধক হয়ে থাকতে চায়নি। সে চেয়েছে আবার রূপকথারও রচক হতে। মানুষ কাজ করেছে, কিন্তু সেইসাথে আবার প্রয়োজন অনুভব করেছে ক্রীড়া-জীবনের। এই সবকিছু মিলিয়েই তার সংস্কৃতি। সংস্কৃতিবিহীন মানুষের জীবন তাই কল্পনা করা যায় না। মানুষের এই সাংস্কৃতিক জীবন এক পুরুষে রচিত হয়ে যায় না। এর মূলে আছে বহু যুগের সঞ্চয়। অনেকে এখন বলছেন, তরুণরাই হলেন দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু বহুযুগের সঞ্চিত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করেই চলতে হয় তরুণদের। তা না হলে তারা বাঁচতে পারেন না। অতীতের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাই কাজ করে চলে উৎপাদনী শক্তির ভিত্তি হিসেবে। এ কথাটি এখন আমাদের জাতীয় জীবনে স্মরণ রাখা উচিত বলে আমার মনে হয়। পারিবারিক জীবনে সন্তান-সন্ততিরা পিতা-মাতার এবং অভিভাবকদের কোনো নির্দেশ না মানলে হয়ে পড়বেন বিশৃঙ্খল। তাই কেবল তারুণ্যের জয়গান করে একটি জাতি পেতে পারে না তার নিরাপত্তা এবং আর্থিক জীবনে সচ্ছলতা। আমাদের সংস্কৃতির মানদণ্ড হতে হবে জাতীয় জীবনের নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধান।
মানুষ একসময় পাথর দিয়ে অস্ত্র বানিয়েছে। কোনো ধাতুর ব্যবহার সে জানত না। পরে সে আরম্ভ করেছে তামার মতো ধাতুর ব্যবহার করে জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য নির্মাণ। যে সময়টাতে সে পাথর দিয়ে অস্ত্র নির্মাণ পরিত্যাগ করেনি কিন্তু তামার মতো ধাতু দিয়ে হাতিয়ার বানাতে শুরু করেছে, সে সময়টাকে বলা হয় তাম্র-প্রস্তর যুগ। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিবি ও তার কাছে পশ্চিমবঙ্গে বিরভুম জেলার মহিশাদলে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হয়েছে তাম্র-প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি অথবা সভ্যতার (এ ক্ষেত্রে নৃতত্ত্বে সংস্কৃতি শব্দটা বেশি প্রচলিত, কিন্তু প্রত্নতত্ত্বে সভ্যতা শব্দটা বেশি ব্যবহার করা হয়। নৃতত্ত্বে সভ্যতা শব্দটি প্রধানত ব্যবহার করা হয় নগর-সংস্কৃতি বোঝাতে)।
পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে তামা দিয়ে তৈরি মাছ ধরার বড়শি। যা থেকে প্রমাণিত হয় ওই সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষ তামার বড়শি দিয়ে মাছ ধরত। অন্য দিকে মহিশাদলে একটি পোড়ামাটির মৃৎপাত্রে কিছু ধান পাওয়া গেছে। ধানগুলো বহুদিনের আগের বলে পরিণত হয়েছে কয়লায়। এই কয়লা হয়ে যাওয়া ধানের বয়স রেডিও একটিভ কার্বন-১৪ পদ্ধতিতে নির্ণয় করা হয়েছে, যা থেকে জানা যায়- এই ধান খ্রিষ্টপূর্ব ১৩৮০ থেকে ৮৫৫ অব্দের মধ্যে। এ থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায়, সে সময় মানুষ ধান থেকে উৎপাদিত চালের ভাত এবং সেই সাথে মাছ আহার করত। তাদের জীবন ছিল আমাদেরই মতো, ভাত-মাছ নির্ভর। অন্য দিকে পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে ১৩টি নর কঙ্কাল মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে একটি হলো পূর্ণাঙ্গ। যা থেকে বোঝা যায়, এ সময়ে এই সংস্কৃতির মানুষ তাদের শব দাহ করত না, মাটিতে পূর্ব-পশ্চিমভাবে শায়িত করে কবর দিত। এসব মানুষের মাথার খুলি লম্বা নয়, আবার গোলও নয়। এদের মাথার খুলি ছিল মধ্যম আকৃতির (Mesaticephalic)। বর্তমান বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে এরকম প্রাচীন কোনো তাম্র-প্রস্তর যুগের সংস্কৃতির নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিমবঙ্গের সে যুগের মানুষের মতোই মাছ-ভাত খেয়ে বাঁচে। আর বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের একটি বিরাট অংশ হলো মধ্যম আকৃতির মাথা বিশিষ্ট। তাই মনে করা চলে মানব বংশের দিক থেকে তাদের একটি ধারা বজায় আছে বর্তমান বাংলাদেশের মানুষেরও মধ্যে। যদিও বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ আর পড়ে নেই তাম্র-প্রস্তর যুগে। সে বহু দিন আগেই এসে পৌঁছেছে লৌহযুগে। ব্যবহার করছে লোহা দিয়ে তৈরি হাতিয়ার।
ভারতের একজন বিখ্যাত মহিলা নৃতাত্ত্বিক ছিলেন ইরাবতী কার্ভ (Irawati Karve)। তিনি একটি প্রবন্ধ লেখেন India As A Cultural Region নামে। যা প্রকাশিত হয় Indian Anthropology নামে একটি বইতে। বইটি প্রকাশিত হয় Asia Publishing House, London থেকে ১৯৬২ সালে। এতে তিনি বলেন, সারা ভারতকে কেবল একটি সাংস্কৃতিক এলাকা বলে বিবেচনা করা যেতে পারে না। একে কম করে দু’টি বড় সাংস্কৃতিক এলাকায় সহজেই ভাগ করা চলে। এর একটি সাংস্কৃতিক এলাকার মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হলো গম। এরা গমের ময়দার রুটি বানিয়ে খায়। গম বোনে বলদ দিয়ে জমিতে লাঙল দেয়ার পর ছিটিয়ে। অন্য দিকে আরেকটি বড় বিভাগের মানুষের প্রধান খাদ্য ফসল হলো ধান। এরা ধানের চালের ভাত খায়। এরা ধানের প্রধান ফসল ছিটিয়ে বপন করে না। ধানগাছ প্রথমে বীজতলায় উৎপন্ন করে। তারপর সেখান থেকে ধানের চারা তুলে নিয়ে কাদামাটিতে রোপণ করে ধানক্ষেতে। কাদা মাটিতে এরা চাষ করে বলদে টানা লাঙল দিয়ে। এই দুই অঞ্চলের মানুষের প্রধান ফসলের আবাদ-পদ্ধতি হলো বিশেষভাবেই ভিন্ন। এদের তাই বলা চলে না একই সংস্কৃতির ঐতিহ্যবহ।
তিনি আরো বলেন, যারা গমের রুটি খায়, তারা তরকারি ও মাছ-গোশত কাটে ছুরি দিয়ে। কিন্তু যারা ধানচাষ করে, তারা এ ক্ষেত্রে ছুরি ব্যবহার না করে, করে বঁটির ব্যবহার। এদিক থেকেও তারা বলতে হয় খুবই ভিন্ন সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহন করছে। ইরাবতী কার্ভ বলেন, চীনা ভাষাপরিবারের ভাষায় সাধারণত য়ং ধ্বনি যুক্ত থাকতে দেখা যায়। নদীর নামের সাথে, যেমন হোয়াংহো, ইয়ংসিকিয়ং, সাংপো, দিস্তাং (তিস্তা)। তার মতে, গংগা নদীর নামও সম্ভবত এসেছে চীনা ভাষাপরিবারভুক্ত কোনো ভাষা থেকেই। এর আগে বিখ্যাত ফরাসি গবেষক সিলভা লেঁভি বলেছিলেন, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ইত্যাদি নামগুলো কোনো আর্যপরিবারভুক্ত ভাষা নয়, সম্ভবত চীনা পরিবারভুক্ত ভাষা থেকে আসা। কারো কারো মতে তাই ‘বঙ্গ’ এই নামটি ছিল পূর্ব বাংলার একটি নদীর নাম। আর এই নদীর তীরে যারা বাস করত, তাদের ডাকা হতো বঙ্গালি বলে। এ দেশের মানুষ একসময় ভাষার দিক থেকে আর্য ছিল না। হয়তোবা কথা বলত চীনা ভাষাপরিবারভুক্ত ভাষাতেই।
চীনা পরিবারভুক্ত ভাষায় বিভক্তির ব্যবহার নেই। বাংলা ভাষায় আছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় বিভক্তির ব্যবহার এখন ক্রমেই কমে যাচ্ছে। আগে আমরা বলতাম, বাঘ মানুষকে খায়। কিন্তু এখন বলছি, বাঘ মানুষ খায়। অর্থাৎ বাংলা ভাষা হয়ে উঠতে চাচ্ছে কতকটা চীনা পরিবারভুক্ত ভাষারই অনুরূপ। হতে পারে এই প্রবণতা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। আবার তা প্রকট হচ্ছে। আমরা চাচ্ছি না আর্য প্রভাবিত থাকতে। বাংলা ভাষাকে সাধারণত বলা হয় আর্য পরিবারভুক্ত ভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষার বহু মিল থাকতে দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় পারিবারভুক্ত ভাষার সাথে। আর্য পরিবারভুক্ত ভাষায় ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য গঠন করা যায় না। কিন্তু আমরা বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্য গঠন করতে পারি। যেমন আমরা বলতে পারি, সে একজন ভালো ছাত্র। আমরা কখনো বলি না, সে হয় একজন ভালো ছাত্র। দ্রাবিড় পরিবারের ভাষাতেও এই একইভাবে বাক্য গঠন করা চলে। দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতির সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতির মিল থাকতে দেখা যায় বেশি। বাংলাদেশের মানুষ দক্ষিণ ভারতের মানুষের মতোই সিদ্ধ চালের ভাত খায়। আমরা বাংলাদেশের মানুষ তাদের মতোই একসময় গ্রামে বাস করতাম মাটির দেয়াল দেয়া উলুখড়ে ছাওয়া চালা ঘরে।
আমি আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে এসব কথা বলছি, কারণ ক’দিন আগে পত্রিকার খবরে পড়লাম (প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর ২০১৭) অধ্যাপক গোলাম মুর্শিদ ঢাকায় বাংলাদেশে মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে একটি বক্তৃতা দিয়েছেন। এই বক্তৃতার আয়োজক ছিল ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। কিন্তু বক্তৃতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামান মিলনায়তনে। মুর্শিদ তার বক্তৃতায় এমন কিছু কথা বলেছেন যে, তা আমাদের ইতিহাস জ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ হলো একটি প্রান্তিক দেশ। তার সংস্কৃতি প্রান্তিক। কিন্তু বাংলাদেশ কোন দেশের প্রান্তিক দেশ, তা তিনি বলেননি। পৃথিবীটা গোল। প্রান্তিক শব্দটা এমনিতেও প্রয়োগ করা উচিত নয়।
আমরা আমাদের আলোচনায় দেখেছি যে, ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলে একটি অতি প্রাচীন তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার অথবা সংস্কৃতির অস্তিত্ব ছিল। আমরা বহন করছি সম্ভবত তারই ঐতিহ্য। যদিও এসে পৌঁছাতে পেরেছি তাম্র-প্রস্তর যুগ ছেড়ে লৌহ যুগের সংস্কৃতিতে। এটা আমরা স্বচেষ্টাতেই আসতে পেরেছি বলে মনে হয়। অনেকে এখন বলছেন, দক্ষিণ ভারতে নাকি হতে পেরেছিল প্রথম লৌহ-যুগের সূচনা। আমরা তাদের কাছ থেকে পেয়ে থাকতে পারি লোহা তৈরির কৌশল; আর্য ভারতের কাছ থেকে নয়। বাংলাদেশে সংস্কৃতির কোনো উদ্ভাবন ও বিকাশ ঘটেনি, এরকম কথা ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। ব্রিটিশ শাসনামলে সারা ভারতের রাজধানী হয়েছিল কলকাতা শহর। কলকাতা শহরকে নির্ভর করে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ঘটেছিল বিশেষ বিকাশ। যার প্রভাব পড়েছিল সারা ভারতের ওপর। কলকাতা শহরকে নির্ভর করে হতে পেরেছিল নব্য-প্রাচ্য চিত্রকলার আন্দোলন। যারও প্রভাব পড়েছিল তখনকার সারা ভারতের ওপর। কিন্তু মুর্শিদ সাহেব বোঝাতে চাচ্ছেন, বাংলাদেশ নাকি কেবলই একটা প্রান্তিক সংস্কৃতির দেশ। অবশ্য কলকাতা শহর এখন রাজনৈতিকভাবে ভারতের শহর, বাংলাদেশের নয়। আমি যতদূর জানি, অতীতে ‘পুর’ বলতে বোঝাত দেয়ালঘেরা শহরকে। বাংলাদেশের বহু জায়গার নামের সাথে ‘পুর’ শব্দটা যুক্ত থাকতে দেখা যায়। যেমন দিনাজপুর, রংপুর, ফরিদপুর, বিক্রমপুর, মনিরামপুর প্রভৃতি।
বাংলাদেশে মানুষ কেবল গ্রামেই বাস করেছে, শহরের মতো জনপদ গড়ে তুলবার চেষ্টা করেনি, এরকম সিদ্ধান্ত করাকে তাই যথাযথ বলা চলে না। যেমন বলতে চেয়েছেন অধ্যাপক গোলাম মুর্শিদ। গোলাম মুর্শিদ আমাদের দেশের একজন খুব উঁচু দরের চিন্তক ব্যক্তি বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন কি না, আমি তা বলতে পারি না। কিন্তু তার ঢাকার বক্তৃতাকে পত্রিকায় যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আর তার আয়োজক ছিল ভারতের হাইকমিশন। কেন ভারতের হাইকমিশন এ সময় এরকম একটা সভার পৃষ্ঠপোষকতা করতে গেল, সেটা নিয়ে সৃষ্টি হতে পারছে এ দেশের মানুষের মনে বিবিধ প্রশ্ন। ভারতীয় হাইকমিশন নিশ্চয় চেষ্টা করতে পারে না বাংলাদেশের সংস্কৃতি কী হবে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন