|
এবনে গোলাম সামাদ
test@gmail.com |
|
জার্মানিতে তুর্কি মুসলমান বড় সমস্যা হতে পারে
30 March 2018, Friday
জার্মানিতে আগে মুসলমান ছিল না। জার্মানিতে মুসলমানেরা জার্মান বংশোদ্ভব নয়। নৃজাতিক দিক থেকে তার হলো ওসমানীয় তুর্কি বংশোদ্ভব। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তুরস্ক ও জার্মানি একত্রে যুদ্ধ করেছিল ব্রিটিশ ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সে যুদ্ধে জার্মানি ও তুরস্ক পরাজিত হয়েছিল। সে সময়ের তুরস্কে সুলতান খলিফা জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার জিহাদের ডাকে সাড়া দেয়নি আরব মুসলিম বিশ্ব। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তুরস্ক থেকেছে নিরপেক্ষ। তবে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছু আগে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জার্মানি ও জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তবে এটা ছিল কেবলই একটা আনুষ্ঠানিক ব্যাপার। তুরস্ক এ সময় জড়ায়নি কোনো রক্তক্ষরা যুদ্ধে। জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক এ সময় থেকেছে খুবই ভালো। বিশেষ করে পশ্চিম জার্মানির সাথে। এ সময় পশ্চিম জার্মানিতে শ্রমশক্তির অভাব দেখা দেয় বিশেষভাবে। যা পূরণের জন্য তুরস্ক থেকে দলে দলে শ্রমিক যেতে থাকে পশ্চিম জার্মানিতে কলকারখানায় কাজ করতে। তুরস্কের সাথে পশ্চিম জার্মানির বিশেষ চুক্তি হয়। তুর্কি শ্রমিকেরা পশ্চিম জার্মানিতে যেতে পারেন বিনা ভিসায়। পশ্চিম জার্মানিতে তুর্কি শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় বিশ লাখ। এখন এদের বংশধরেরা কেবল আর শ্রমিক নন, হয়ে উঠেছেন দোকান-পত্রের মালিক। করছেন ব্যবসা বাণিজ্য। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এরা হয়ে উঠেছেন যথেষ্ট সচ্ছল। জার্মানি এখন আর পশ্চিম এবং পুবে বিভক্ত হয়ে নেই। সমগ্র জার্মানিতে এখন তুর্কি মুসলিম বংশোদ্ভব জার্মান নাগরিকদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চল্লিশ লাখের ওপর। এরা জার্মান ভাষায় কথা বলছেন। চাল-চলনে হয়ে উঠেছেন অনেক পরিমাণেই জার্মান। কিন্তু মানবধারার দিক থেকে এখনও এদের থেকেছে তুর্কি পরিচয়। জার্মান জনসমষ্টির মধ্যে এরা সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারেননি। তাই সৃষ্টি হতে পারছে বিশেষ সমস্যা। পশ্চিম জার্মানিতে ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বেশি। জার্মানির অঙ্গরাজ্য ব্যাভেরিয়ার ক্যাথলিক খ্রিষ্টানরা খুবই গোঁড়া।
জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সিহোফার হলেন ব্যাভেরিয়া অঙ্গরাজ্যের অধিবাসী। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, ইসলাম ধর্ম জার্মানির সংস্কৃৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তুর্কি মুসলমানদের সম্পর্কে জার্মানিকে গ্রহণ করতে হবে কঠোর নীতি। তবে তিনি বলেননি এই কঠোরতার বাস্তব রূপ কী হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বিবৃতির পর জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল ও জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক ওয়ালার স্টেইনমার বলেছেন যে, তুর্কি মুসলমানরা এখন জার্মনির বৈধ নাগরিক। ধর্মে তারা মুসলমান। সেই হিসাবে ইসলাম হয়ে উঠেছে জার্মানির ধর্ম বিশ্বাসের অংশ। এটা নিয়ে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা হবে রাজনৈতিক ভুল। কিন্তু জার্মানিতে সৃষ্টি হচ্ছে উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তুর্কিদের খাপ খাবে কি না, বলা যাচ্ছে না। ফলে সৃষ্টি হতে পারে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। চল্লিশ লাখ জনসমষ্টিকে এখন আর একটি ছোট জনসমষ্টি হিসেবে বিবেচনা করা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হারার পর সাবেক জার্মানির বিস্তীর্ণ অংশ দখল করে নেয় পোল্যান্ড। সেখান থেকে জার্মানদের তারা নির্মমভাবে বিতাড়িত করে জার্মানিতে। জার্মানরা আবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে। তারা তাদের পূর্ব পুরুষের ভূমিকে আবার তাদের নিজের বলে দাবি করতেই পারে। জার্মান জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠতে পারে খুবই উগ্র।
কিছু দিন আগে আমরা অনেক বুদ্ধিজীবীকে বলতে শুনতাম যে, জাতীয়তাবাদ এখন সেকেলে হয়ে গেছে। কিন্তু ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানিতে জাতীয়তাবাদ লাভ করতে যাচ্ছে চণ্ড-মূর্তি। কিছু দিন আগে গ্রেট ব্রিটেন বেরিয়ে গেল ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। ইউরোপবাদ এখন আর আগের মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি নয়। ইউরোপবাদের উদ্ভব হয়েছিল এশিয়াকে কাবু করার জন্য। কিন্তু সেই নিখিল ইউরোপবাদ এখন ভেতর থেকেই ভেঙে পড়ছে। আজকের ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী জাতি হচ্ছে জার্মানি। আর জার্মান জাতীয়তাবাদ হচ্ছে জার্মান রাজনীতির বিশেষ উপাদান।
জাতীয়তাবাদ নানাভাবেই আত্মপ্রকাশ করছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একসময় আমরা শুনতে পেতাম পথে ঘাটে একদল লোককে বলতে, দুনিয়ার মজদুর এক হও। কিন্তু এখন এক দেশের মজুররা চাচ্ছেন না আরেক দেশের মজুররা এসে তাদের দেশে কাজ করুক। প্রতিযোগিতা করুক তাদের দেশে তাদের সাথে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ল। যার অন্যতম কারণও হলো জাতীয়তাবাদ। বাইলোরুশিয়া ও ইউক্রেন থাকতে চাইল না রুশদের সঙ্গে। ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন মার্কিন জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তুলে। এর পরেও যারা বলেন যে, জাতীয়তাবাদ সেকেলে হয়ে পড়েছে, তাদের যুক্তি কতটা বাস্তব ঘটনাভিত্তিক। রাশিয়াতে পুতিনের জয়জয়কারের কারণ, তিনি তুলেছেন উগ্র রুশ জাতীয়তাবাদের ধ্বনি। বলছেন না আর লেনিনের মতো, দুনিয়ার মজদুর এক হও।
আমাদের দেশে তুর্কিরা এসে দিল্লির সালতানাত স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশে এসেও তারা করেছিলেন রাজ্য বিস্তার। তুর্কিদের রক্তধারা এই উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যেও প্রবিষ্ট হয়ে আছে। তবে এই তুর্কিরা ওসমানীয় তুর্ক্ নয়; সালযুক তুর্ক্। মুঘল বাদশারা ওসমানীয় তুরস্কের সুলতান খলিফাদের মানতেন না। এই সময় ওসমানীয় তুর্কি খলিফাদের নামে এ দেশের মসজিদে খুৎবা পাঠ করা হতো না। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে তুর্কি সুলতান খলিফাদের নামে খুৎবা পাঠ করা হতো। ওসমানীয় তুর্কি রাষ্ট্রের ওপর, তাই এই উপমহাদেশের মুসলমানদের আছে একটা বিশেষ সহানুভূতি। এ জন্যই আমরা করছি জার্মানিতে তুর্কি মুসলমানদের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এই আলোচনা। তুর্কি মুসলমানেরা উগ্র মুসলমান নন। তুরস্ক চাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে। আর এর জন্য প্রয়োজনে তার নিজের দেশের আইনেও পরিবর্তন আনতে। তুরস্কের পররাষ্ট্র নীতিতে অবশ্য বেশকিছুটা স্ববিরোধিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কামাল আতাতুর্ক চেয়েছিলেন তুরস্ককে জার্মানির ধাঁচে গড়তে। এ জন্য তিনি করেছিলেন খেলাফতের অবসান। কিন্তু বর্তমান তুরস্ক ঝুঁকছে বেশ কিছুটা খেলাফতের দিকে। রাজনীতিতে ইসলাম হয়ে উঠছে একটা উল্লেখ্য উপাদান।
কিন্তু মুসলিম বিশ্বে রাজনীতি খুব জটিল হয়ে উঠেছে। কেউ ভাবতে পারেনি, ইরানের সাথে সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে, সৌদি আরব চাইবে ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে সখ্য করতে। অন্যদিকে তুরস্ক চাচ্ছে না মুসলিম কুর্দিদের অধিকার মানতে। দেখা দিচ্ছে তুর্কি-কুর্দি সঙ্ঘাত। মুসলিম বিশ্বে রাজনৈতিক ঐক্য হতে চলেছে বিলুপ্ত। তবে মোটের ওপর বিশ্ব রাজনীতিতে ইসলাম একটা উপাদান হয়েই উঠেছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল ১৫টি রিপাবলিক। এর মধ্যে ছয়টি ছিল মুসলিম অধ্যুষিত। এরা হলো- আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও কিরঘিজিয়া। এরা সবাই রুশবিরোধী। কেবল জাতিসত্ত্বাগত কারণে নয়, ধর্মীয় ঐতিহ্যগত কারণেও। যদিও নিখিল মুসলিম সাম্রাজ্য গড়ার আওয়াজ এখন আর উঠছে না তুর্কি মুসলিম সুলতান খলিফাদের রাজত্বকালের মতো। বিখ্যাত ওসমানলি তুর্কি খলিফা ইয়াবুদ সেলিম (১৫২০-৬৬ খ্রি:)। গড়ে তোলেন এক বিরাট সাম্রাজ্য। নিজেকে ঘোষণা করেন মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে। কিন্তু বর্তমানে কোনো মুসলিম অধ্যুষিত দেশই এতটা শক্তিধর নয়। রাষ্ট্রিক শক্তি ধর্মবিশ্বাসকে শক্তি জোগায়।
গত সংখ্যার সংশোধনী : গত সংখ্যায় ভুলবশত ছাপা হয়েছে : ‘পাসকাল সম্ভবত গণিতের অন্যতম জনক।’ সেখানে আসলে হবে, ‘পাসকাল সম্ভাবনা গণিতের অন্যতম জনক।’
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন