স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ছিলেন একজন নাম করা কসমোগনিস্ট। কসমোগনি বলতে বোঝায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি কিভাবে হতে পেরেছে, সে সম্পর্কে আলোচনাকে। কসমোগনির কাছাকাছি আর একটি শব্দ আছে, কসমোলজি। যার লক্ষ্য বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিবরণ প্রদান; উদ্ভব নিয়ে আলোচনা নয়। হকিংকে প্রধানত বলা যায় কসমোলজির লোক। ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো কসমোগনি ও কসমোলজির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম না। তাই হকিংয়ের অবদান নিয়ে কিছু আলোচনা করা আমার জন্য অনাধিকার চর্চা হবে। আমি কেবল তার কিছু উক্তি নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি, যা আমার কাছে মনে হয়েছে খুবই অহঙ্কার প্রসূত বলে। তিনি ২০১১ সালে কোনো এক অনুষ্ঠানে বলেন, দর্শন একটা মৃত ব্যাপার। মানুষের চিন্তায় দর্শন আর কোনো অবদান রাখবার অধিকারী নয়। বিশ্ব সৃষ্টি রহস্য কেবল উন্মোচিত করতে পারে বিজ্ঞান।
২০১৪ সালে তিনি এক সভায় ঘোষণা করেন, বিধাতা নেই। আমি নাস্তিক। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করতে হবে কেবল প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে। তার একটি বিষয় যা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হয়েছে। হকিং বলেছেন, মানুষের উচিত হবে পৃথিবী ছেড়ে আর কোনো গ্রহে উপনিবিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করা। কারণ, পৃথিবী হয়ে উঠবে তার বাসের অনুপযোগী। অথচ আমরা জানি, সৌরজগতে একমাত্র পৃথিবী ছাড়া আর কোনো গ্রহ মনুষ্য বাসের উপযোগী নয়। কেবল যে মনুষ্য বাসেরই উপযোগী নয়, তাই নয়, উদ্ভিদ ও অন্য প্রাণী বসবাসেরও অনুপযোগী। একসময় বৈজ্ঞানিকেরা মনে করতেন, মঙ্গলগ্রহে মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। কিন্তু এখন সেখানে রকেট পাঠিয়ে কোনো প্রাণ-পদার্থের অস্তিত্বই মিলছে না। মানুষ সেখানে যেয়ে উপনিবিষ্ট হতে পারবে, এ কথা ভাবাই যায় না। সূর্য ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে অন্য কোনো নক্ষত্রের গ্রহে গিয়ে মানুষকে উপনিবিষ্ট হতে হলে যে ধরনের নভোযান প্রয়োজন হবে, সে রকম নভোযান নির্মাণ মানুষ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিকই মনে করেন, মানুষের পক্ষে অন্য গ্রহে গিয়ে উপনিবিষ্ট হওয়া সম্ভব নয়। এই পৃথিবীতেই সে যাতে আরো ভালোভাবে বাস করতে পারে, সেই প্রয়াসই তাকে করে চলতে হবে। কিন্তু হকিং ভাবতেন অনেক ভিন্নভাবে। তার উপদেশ অনুসরণ করতে গেলে মানুষকে হতে হবে জগদ্বিমুখ। করতে হবে পৃথিবীর জীবনকে অবহেলা। কেউ আস্তিক হবেন অথবা নাস্তিক হবেন, সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু মানব ইতিহাসে ধর্মের ভূমিকাকে ছোট করে দেখলে অবৈজ্ঞানিক মনোভাবেরই পরিচয় দেয়া হয়। হকিং ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে সংশ্লিষ্ট।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখি যে, এর উদ্ভব হতে পেরেছিল ব্যাবিলনের ধর্ম-মন্দিরে। সেখানকার ধর্ম-মন্দিরের পুরোহিতেরাই প্রথম রচনা করেন রাশিচক্র। অনেকের মতে প্রাচীন ধর্ম-মন্দিরের পুরোহিতেরা লক্ষ করেছিলেন যে, নীলনদে বন্যা আসার আগে লুব্ধক নক্ষত্র পুবের আকাশে উদিত হয়। তারা এই লুব্ধক নক্ষত্রের অবস্থান দেখে নীলনদের বন্যার আগমন বার্তা প্রচারের ব্যবস্থা করেন। নীলনদের বন্যার ওপর নির্ভর করেছে মিসরের কৃষি। ধর্ম-পুস্তকগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাতে বিধাতাকে কেবল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকারক হিসেবে চিত্রিত করা হয়নি। চিত্রিত করা হয়েছে মহৎ গুণের বাহক হিসাবে। মানুষকে বলা হয়েছে এসব গুণের অনুসরণ করতে। অর্থাৎ ধর্মে বিধাতাকে কেবল স্রষ্টা হিসেবে চিত্রিত করা হয়নি, চিত্রিত করা হয়েছে মানবজীবনের আদর্শ হিসেবে। আল কুরআনে বলা হয়েছ, তোমরা আল্লাহর রঙে নিজেকে রঞ্জিত কর (সূরা ২: ১৩৮)। আল কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ হলেন আলোর আলো (সূরা ২৪:৩৫)।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে তাপ ছড়িয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে না। এর একটা ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। ধরে নিতে হয়, এর আছে একটা শক্তির বিশেষ উৎস। শক্তির এই মহা উৎসকেই বলতে হয় আলোর আলো।
যা হোক, ধর্মতত্ত্ব আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য নয়। আলোচ্য হলো হকিংয়ের অহঙ্কার প্রসূত উক্তি। হকিং বলেছেন, বিজ্ঞানীরা যা জানতে পারেন, অন্যরা তা পারেন না। কিন্তু বিজ্ঞানীরা কোনো কিছুর কতটা পরিমাণ অবগত হওয়ার সামর্থ্য রাখেন, সেটা নিয়ে তোলা যায় প্রশ্ন। আমরা আলোর সাহায্যে দেখি। আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে ৩০০০০০ কিলোমিটার। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে লাগে ৮ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের কাছাকাছি। এখন সূর্যকে আমরা যেখানে দেখছি সেখানে সে আসলে ছিল বর্তমান সময়ের থেকে ৮ মিনিট ১৮ সেকেন্ড আগে। দুরবিন দিয়ে আমরা যখন দূর আকাশের কোনো নক্ষত্রকে দেখি, তখন সেখান থেকে আলো আসতে বহু লক্ষ অথবা কোটি বছর লেগে যায়।
দূর নক্ষত্রের আলো থেকে আমরা যে সংবাদ পাই, তা হলো তার কোটি কোটি বছর আগেকার পরিচয়; বর্তমান পরিচয় নয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে দূরত্বের পরিমাপ সাধারণত প্রকাশ করা হয় আলোক বছরে। অর্থাৎ পৃথিবীর এক বছর সময়ে আলোক যতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে তার হিসাব অনুসারে। ১৯৩১ সাল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে রেডিও টেলিস্কোপ। রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে আমরা দূর নক্ষত্রালোকের এমনকি গ্রহের সংবাদ পেতে পারি। এই সংবাদ অবশ্য কোনো রেডিও স্টেশনের দেয়া নয়। বহু নক্ষত্র থেকে একং কিছু কিছু গ্রহ থেকে প্রাকৃতিক নিয়মেই রেডিও তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। তা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা উদ্ধার করতে পারেন নক্ষত্র ও গ্রহের অবস্থার কথা। এমন জ্যোতিষ্কও আছে যাদের এখন বলা হয় কোয়াসার (Quasar)। এরা আকরের দিক থেকে অন্যান্য নক্ষত্রের চেয়ে অনেক ছোট। কিন্তু এদের থেকে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে বিপুল তেজ, বিকিরণ (Radiation) রূপে। কী করে এদের মধ্যে এত বিপুল তেজ উৎপন্ন হতে পারছে, তা আইনস্টাইনের দেয়া সূত্র অনুসারে ব্যাখ্যা করা যায় না। অনেকে মনে করেন, কোয়াসারদের সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান বাড়লে বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেক বদলে যাবে।
বিজ্ঞানী হকিং বিশেষভাবে গবেষণা করেছেন কৃষ্ণ গহ্বর তথা ব্ল্যাক হোল নিয়ে। কৃষ্ণ গহ্বর বলতে বোঝায় চুপসে যাওয়া নক্ষত্র। এখানে বস্তু পদার্থ এত ঘন ও তার টান এত প্রবল যে, সেই টান কাটিয়ে বাইরে আলো আসতে পারে না। তাই ওই অঞ্চল দেখে মনে হয় কালো, তার পশ্চাতে বহু দূরে অবস্থিত উজ্জ্বল নক্ষত্রের আলোতে। কৃষ্ণ গহ্বরের উদ্ভবের ক্ষেত্রে হকিংয়ের মত বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছে। কিন্তু আমরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আলোক দুরবিন ও রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে যা জানছি, তা হলো, বহু কোটি বছর আগের অবস্থার বিষয়। বর্তমান বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিশ্চয়ই অনেক ভিন্ন হয়ে পড়েছে।
তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পক্ষে কোনোভাবেই বলা সম্ভব নয়, বর্তমান বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অবস্থা সম্বন্ধে। দার্শনিকেরা যন্ত্র দিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে পর্যবেক্ষণ করেন না। তারা বিজ্ঞানের আহরিত তথ্যকে করতে চান যুক্তি দিয়ে বিচার। যুক্তি-বিচারই হলো তাদের জ্ঞানের উৎস। দর্শনের লক্ষ্য মানুষের জ্ঞানকে সমগ্রভাবে বিচার করা। এখানেই হলো বিজ্ঞানের সাথে এর পার্থক্য। বিজ্ঞান বলে, মানুষ কিভাবে বেঁচে আছে। আর দর্শন বিশ্লেষণ করে উপলব্ধি করতে চায়, মানুষ কেন বেঁচে থাকতে চায়। যেতে চায় মৃত্যুকে এড়িয়ে। ভাবে, ‘জীবনে জীবনে জীবন রাখি, মরণেরে দাও ফাঁকি’। বিজ্ঞান ভালো-মন্দের বিচার করে না। কিন্তু দর্শন করে। যা কিছু মানুষের আয়ু বাড়ায়, তাকেই দর্শন বলতে চায় শ্রেয়। বিজ্ঞান ভালো-মন্দের বিচার করে না। বৈজ্ঞানিকেরা পরমাণু বোমা, হাইড্রোজের বোমা, নিউট্রন বোমা বানিয়েছেন মানুষের ভালো-মন্দের বিচার না করেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং (১৯৪২-২০১৮) মারা যাওয়ার পর আমাদের পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হতে পেরেছে। কিন্তু এই আলোচনা হতে পেরেছে, তার ব্যক্তি জীবন নিয়ে। তার বৈজ্ঞানিক মতবাদগুলো নিয়ে নয়। কিন্তু বিজ্ঞানে, বৈজ্ঞানিকের চেয়ে বিজ্ঞানে তার অবদান নিয়ে আলোচানাই হলো বিশেষ বিধেয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
উৎসঃ dailynayadiganta
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন