|
মাসুদ মজুমদার
digantaeditorial@gmail.com |
|
সৌদি আরব যেসব কারণে প্রাসঙ্গিক
23 August 2017, Wednesday
সৌদি আরব নিয়ে আমাদের উৎসাহ ও মাথা ব্যথার অনেক কারণ। সৌদি আরব আমাদের নিয়ে কতটা ভাবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। ষোল কোটি মানুষের জনপদ। মুসলিম উম্মাহর প্রভাবশালী সংগঠন ওআইসির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই সাথে, ওআইসির অঙ্গীকারগুলোকে সযত্নে লালন করতে সচেষ্ট থাকে।
একটা ব্রেকিং নিউজ দেখে মনে হলো- সৌদি আরবের সরকারকে সাধুবাদ জানানো উচিত। ব্রেকিং নিউজটা হচ্ছে- সৌদি আরব বাদশাহর নির্দেশে কাতারের হাজীদের প্রবেশের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে। দুটো দেশের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন এখনো চলছে। তার ভেতর এই শুভবুদ্ধির উদয় হওয়াকে অবশ্যই সম্মানের চোখে দেখতে হবে। এটি সাধারণ কূটনীতির ঊর্ধ্বে, ঈমানবিধৌত একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
এর আগেও সৌদি আরব সরকার দুটো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মিডিয়া জানিয়েছে। ক. সৌদি আরব ইরানের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নত করতে চায়। সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে ইরাক যেনো ভূমিকা পালন করে, সেই জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। খ. ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে সৌদি আরব সরে আসার পথ ও প্রক্রিয়া খুঁজছে। আমাদের আগ্রহের জায়গা এখানেই। সৌদি আরব এশিয়ার পঞ্চম বৃহত্তম দেশ। পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্রে সৌদি আরবের অবস্থান শীর্ষে। প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের দেশ সৌদি আরব। অর্থনৈতিক সম্পদে বলীয়ান, শত ভাগ আরব মুসলিমঅধ্যুষিত দেশটির চারপাশে রয়েছে জর্ডান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান ও ইয়েমেন। পারস্য ও লোহিত সাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত কিংবা দুটি সাগর-বিধৌত দেশটির আয়তন সাড়ে ২১ হাজার বর্গকিলোমিটার।
সৌদি আরব সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর সংবেদনশীলতা তুলনাহীন। জাজিরাতুল আরব ও হেজাজের ইতিহাস লাখ বছরের। হজরত আদম আ:-এর দুই সন্তানের একজন ছিলেন কৃষিজীবী, অন্যজন বেছে নিয়েছিলেন পশু পালন। সৌদি আরবের জনগণের আদি পেশাও কৃষি এবং পশুপালন। তেল ও খনিজসম্পদ যেনো দেশটির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক অফুরন্ত নেয়ামত। মক্কা-মদিনার অবস্থান হেজাজ অংশে। মক্কা-মদিনার সাথে মুসলিম উম্মাহর সম্পর্ক নিবিড় ও প্রশ্নাতীত। আর কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকলেও মক্কা-মদিনার সাথে উম্মাহর নাড়ির সম্পর্ক শাশ্বত। যদ্দুর জানি পশ্চিমে লোহিত সাগরের ওপারে মিসর ও সুদান। দুটোই উত্তর আফ্রিকার দেশ। মিসরের প্রতি আকর্ষণ পিরামিড ও ফেরাউনদের কারণে নয়। উম্মাহর অন্যতম সদস্যরাষ্ট্র মিসর বার বার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ব্রাদারহুড বা ইখওয়ানুল মুসলিমিনের কারণে। হাসান তুরাবির সুদানও একই কারণে আকর্ষণ বাড়ায়। আরব বসন্তের সময় থেকে সৌদি আরব ব্রাদারহুডের ব্যাপারে ইউটার্ননীতি অনুসরণ করে চলেছে বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। অথচ সৌদি আরব দুঃখ দিনে শায়খ হাসানুল বান্না, সাইয়েদ কুতুব শহীদদের ব্যাপারে ছিলেন বিগলিত প্রাণ, কাক্সিক্ষতমাত্রায় সংবেদনশীল ও সহমর্মী। একাধিকবার শাসকের হাতে নিপীড়িত মিসরবাসী সৌদি আরবের আশ্রয় ও সাহায্য পেয়েছে।
আজকের বিষয় সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সরকারের ধরন-ধারণ নিয়ে নয়, সৌদি আরব যে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের উপমা, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সৌদি আরবের বিদেশনীতি এখন উম্মাহর রক্তক্ষরণের অন্যতম কারণ হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখার গরজ আছে। কিছু কারণ চিহ্নিত। মুসলিম উম্মাহর সদস্যরা মনে করেন, সৌদি আরব এখন জেরুসালেম ও ফিলিস্তিন নিয়ে কম আগ্রহী। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলন নিয়ে সৌদি আরবের বর্তমান অবস্থান সুখকর মনে হয় না। কাতার এবং দোহাভিত্তিক নন্দিত ও বস্তুনিষ্ঠ মিডিয়া আলজাজিরা নিয়ে সৌদি আরবের অবস্থান মুসলিম উম্মাহ ইতিবাচকভাবে নিতে পারেনি। সিরিয়ায় ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধে রাশিয়া ও আমেরিকার মতো সৌদি আরবও পক্ষ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেকের মতো আমরাও আশাহত হয়েছি। প্রত্যাশা ছিল, সৌদি আরব পক্ষগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করবে।
তা ছাড়া ওআইসির মাধ্যমে অনেক গুণগত ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সৌদি আরব মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। আরব লিগ এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা ফোরামেও সৌদি আরবের অবস্থান দৃঢ়। তাই প্রত্যাশা ছিল সৌদি আরব পক্ষ না হয়ে পক্ষগুলোর বিরোধ নিষ্পত্তিতেই অবদান রাখবে।
সব বিশ্লেষক একমত যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের আরব ও মধ্যপ্রাচ্যনীতি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের ঊর্ধ্বে নয়। সে ক্ষেত্রে সৌদি আরবেরও একই সমতলে অবস্থান মুসলিম উম্মাহ যৌক্তিক মনে করার কথা নয়। সৌদি আরব ও ইরানের শুভাকাক্সক্ষীরা মনে করেন, মাজহাবি দূরত্ব সৃষ্টি না করে ভ্রাতৃপ্রতিম দুটি দেশ মোটা দাগে রাষ্ট্রাচারের ব্যাপারে সৌহার্দ্যপূর্ণ হওয়ার সুযোগ ছিল এবং আছে। দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত হলেও শিয়া-সুন্নিবিরোধ উম্মাহর ভেতরকার মতদ্বৈধতার বিষয়। এটি এক-দুইশতকের বিতর্ক নয়। এর সমাপ্তিও তাৎক্ষণিকভাবে হওয়ার কথা নয়। পারস্পরিক সম্পর্ক সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে গেলে ন্যূনতম বোঝাপড়ায় আসা সহজ। সেটা দুটো রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক রাজনীতির উপাত্ত না হলে, আরব-পারস্য প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে অনেক বেশি ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে।
’৪৮ সাল থেকে টানা প্রায় ৭০ বছর ধরে ফিলিস্তিনি ভাইয়েরা মুক্তির প্রহর গুনছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগিয়ে রেখেছে। জেরুসালেমের কান্না, আল আকসা ও বায়তুল মোকাদ্দাসের নীরব আর্তনাদ ইসরাইলি বর্বরতা ও নৃশংসতার কারণে চাপা পড়ে যাচ্ছে। উম্মাহর বিরোধ-বিভক্তির কারণে ফিলিস্তিনিরা চরমভাবে আশাহত। গত বছর তুরস্কে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর আঙ্কারা ও ইস্তাম্বুল সফরের সুযোগ হয়েছিল। তুরস্কের সর্বোচ্চ নেতা ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ে মতবিনিময়ের সুযোগ মিলেছিল। সবাই মনে করেন, ইরান, তুরস্ক ও সৌদি আরব এক সাথে কাজ করা সবার জন্য কল্যাণ।
একজন তরুণ তুর্কির অভিব্যক্তি ছিল এমন : তুরস্ক-পারস্য ও আরবরা এককাতারে দাঁড়ালে সমৃদ্ধির যুগ এসে উম্মাহর পদচুম্বন করবে।’ আঙ্কারায় কথা হচ্ছিল ইন্টারন্যাশনাল থিংকার্স ফোরামের মহাসচিব আলি কুর্দের সাথে। সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট আল্লামা ইউসুফ কারজাভি। ফেকাহ শাস্ত্রের পণ্ডিত হিসেবে তিনি অনেক অভিমত দিয়ে থাকেন। সব ব্যাপারে সবার একমত হওয়া জরুরি নয়। কিন্তু তিনি এই মুহূর্তে উম্মাহর একজন প্রজ্ঞাবান মুখপাত্র। আমাদের আলোচনায় শরিক হলেন সুদানের যুবমন্ত্রী। দু’জনের অভিমত ছিল- দুর্ভাগ্য মুসলমান মুসলমানের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ঐক্য ছাড়া চিন্তার বিভক্তি কাটবে না। কাতার ইস্যুতে যখন শুনলাম ইউসুফ কারজাভিও আরো ক’জনের মতো সৌদি আরবে ‘নিষিদ্ধ’। হামাস, ব্রাদারহুড নাকি ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন। তখন রিয়াদ আর ওয়াশিংটনের বিদেশনীতি নিয়ে আলাদা মন্তব্য করার মতো যুক্তি খুঁজে পেলাম না। মরহুম বাদশাহ আবদুল আজিজ এবং বাদশাহ ফয়সলের সৌদি আরব ঐক্যের যে দেয়াল গড়ে তুলেছিল, সেটা কি ধসে পড়ছে?
বাস্তবতা হচ্ছে, ইয়েমেনে যুদ্ধে জড়িয়ে সৌদি আরব শুধু ইমেজ হারায়নি, উম্মাহর মধ্যস্থতাকারীর অবস্থানকে নতুন এক অনাকাক্সিক্ষত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলার সুযোগ করে দিয়েছে। আজ জাতিসঙ্ঘ অভিযোগ তুলছে ইয়েমেনে শিশু হত্যার দায় সৌদি জোটকেও নিতে হবে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের বিস্তৃতির দায় থেকে সৌদি আরব মুক্ত থাকবে কিভাবে? বাস্তবতা এমন যে, সৌদি আরব প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমরা প্রশ্নমুক্ত থাকি না। কারণ সৌদি আরব পবিত্র কালেমাকে জাতীয় পতাকায় স্থান দিয়ে সব কিছুর ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে যখন কাতারের হাজীদের ব্যাপারে সৌদি বাদশাহর ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানলাম, ইরানের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির খবর পেলাম, ইয়েমেন ও সিরিয়া প্রশ্নে সৌদি আরবের অবস্থান পরিবর্তনের আভাস মিলল, তখন ধরে নিলাম কাতার ও আলজাজিরা প্রশ্নেও সৌদি আরবের উম্মাহপ্রীতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান পাবে। মুসলিম উম্মাহর সদস্যরা সৌদি আরবের কাছে এমনটিই প্রত্যাশা করে। এই প্রত্যাশা পূরণ হলে সৌদি আরব হবে মুসলিম বিশ্বের পথপ্রদর্শক ও অভিভাবক। তখন সৌদি আরব অর্থ ও অস্ত্রবলে সমৃদ্ধ হলে উম্মাহর ভরসা বাড়বে। নিরাপত্তা জোরদার হবে।
পৃথিবীর মাত্র দু-তিনটি দেশ জাতীয় পতাকায় আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণা আসমানে তুলে ধরেছে। মোটা দাগে তারা বিশ্বের তাবৎ উম্মাহর কাছে এই ঘোষণা দিচ্ছে- আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের সাথে শরিক করার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য সৌদি আরবের স্মরণ করার মতো প্রচুর অবদান রয়েছে। বস্তুগতভাবে তার মূল্যায়ন করার দায় নিশ্চয়ই রয়েছে। তবে সৌদি আরবের অভিভাবকত্বের অবস্থান উম্মাহপ্রীতির চাদরে মোড়ানো থাকুক, এটা এক পবিত্র কামনা। সব কুফর যেমন এক, উম্মাহর সদস্যরাও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে অবিচ্ছেদ্য এবং এক দেহতুল্য- এমনটি কামনা করাই স্বাভাবিক।
সৌদি আরব সারা বিশ্বের ঈমানদারদের রাহবার বা পথপ্রদর্শক হলে ইরানের কোনো গাত্রদাহ হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ রেজা শাহর ইরান আর আয়াতুল্লাহ খোমেনি ও খামেনির ইরান এক নয় বলেই মনে করি। সাংবিধানিকভাবে ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্র। ইমাম জাফর সাদেকের ফেকাহ প্রাধান্য পায় সে দেশে। অন্য দিকে সৌদি আরবের মুসলিম বণিক ও দায়িরাই বাংলাদেশে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন। বাংলাদেশের গরিষ্ঠ মানুষ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আকিদা লালন করে থাকে।
অথচ ৬০০ বছর বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পারস্য প্রভাব বলয়ে ছিল। ফার্সি ছিল দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রভাষা। পবিত্র কুরআন, প্রিয় নবী ও জান্নাতের ভাষা আরবির পরই এই দেশের মুসলমানরা ফার্সি ও উর্দুকেই ধর্মীয় ভাষা মনে করে আজও। দৈনন্দিন জীবনে অসংখ্য আরবি শব্দ ও প্রায় আড়াই হাজার ফার্সি শব্দ বাংলাদেশের মানুষ ব্যবহার করে। পারস্যের জাতীয় কবিরা বাংলায় নন্দিত হন সব আলেম ওলামা ও সাধারণ মুসলিমদের কাছেও।
সৌদি আরব মুসলিম উম্মাহর প্রত্যাশার জায়গাটি পূরণ করলে অনৈক্যের দেয়ালগুলো ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। লাভবান হবে মুসলিম উম্মাহ, সৌদি আরবের জনগণ তো বটেই।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন