|
মাসুদ মজুমদার
digantaeditorial@gmail.com |
|
এ কোন অচেনা বাংলাদেশ
06 September 2017, Wednesday
বাংলাদেশের মানুষ মগদস্যু, হার্মাদ, বর্গি প্রভৃতি শব্দগুলোর সাথে পরিচিত। কোন কোন শব্দ দিয়ে ছড়া কেটে শিশুদের ঘুম পাড়ানো হয়। শিশু মনে ভীতি জাগিয়ে ঘুম পাড়ানো মনোবিজ্ঞান সমর্থন করে না। এরপরও এই দেশের মায়েরা ভীতি জয় করে বাঁচার লক্ষ্যেই বর্গিদের বীভৎসতা স্মরণ করেই শিশুদের ঘুম পাড়ান। তাইতো প্রতিবাদী মায়েদের সন্তানরা সাহসী এবং মুক্তিকামী।
শায়েস্তা খানের আগে-পরে মগদস্যুরা চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছিল। মগদস্যু উপদ্রুত অঞ্চলে বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতার অন্ত ছিল না। ছিল না কোনো আইনশৃঙ্খলা। অরাজক ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির পরিচয়বাহী শব্দ ‘মগের মুল্লুক’। ‘হার্মাদ’ ছিল পর্তুগিজ দস্যুরা। জোর, জুলুম, অত্যাচার ও লুণ্ঠনের জন্য তাদের এই খ্যাতি। মারাঠারা পরিচিতি পেয়েছিল ‘বর্গি’ হিসেবে। নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার উপাধি বর্গি। হার্মাদ, বর্গি ও মগদস্যু তাড়িয়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।
এই মুহূর্তের বাংলাদেশের রাজনীতি-সরকার যেন সেই মগদস্যুর ভীতির ঘুমে কাতর। আরাকানখ্যাত রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার পরও আমাদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের শব্দ আহ! উহ! পর্যন্তই। প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ কাজে লাগেনি। মিয়ানমার বার বার আকাশসীমা লঙ্ঘন করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। ভারত-চীন-মুসলিম বিশ্ব-জাতিসঙ্ঘ কাউকে সরকার কাছে টানতে পারেনি। কূটনৈতিক তৎপরতা দায়সারাগোচের। মানবতা যেনো রাবিশ কূটনীতির তলে চাপা পড়ে আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নাকে কানে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তাই ফুঁসে ওঠা জনমত ভাষা পাচ্ছে না। এ যেন কূটনৈতিক বিপর্যয়। মগের মুল্লুকের যে বীভৎসতার চিত্র ইতিহাসে পাই তার পুনরাবৃত্তি যেন নতুন করে দেখতে পাচ্ছি আরাকানজুড়ে। বিগত শতকের ৮০ ও নব্বইয়ের দশকে মিয়ানমারের মগদস্যুরা রাখাইনদের ওপর কয়েকবার সর্বাত্মকভাবে হামলে পড়েছিল। লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সৌদি আরবসহ অনেক মুসলিম দেশ তাদের মানবিক আশ্রয় দিয়েছে। সাহায্য করেছে। শাসকেরা ছিল সরব, কূটনীতি ছিল চাঙ্গা। বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে বিশ্ববিবেক দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়। মিয়ানমারের শাসকেরা হত্যা বন্ধ করে আপাতত শান্তির পথ ধরে। এক যুগ পর আবার ২০১২ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গার ওপর হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগসহ ইতিহাসের বর্বরতম নৃশংসতা চাপিয়ে দিয়েছিল। চার বছর পর মিয়ানমার সরকার আবারো ঠাণ্ডা মাথায় হাজার হাজার রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। স্কুল মাদরাসা উপাসনালয় পুড়িয়ে দিয়েছে। শিশু নারী বৃদ্ধদের ওপর বর্বরতম তাণ্ডব চালিয়ে সক্ষম রোহিঙ্গাদের সাগর ও নাফ নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে বাধ্য করল। যারা তীর খুঁজে পেলো না সেই ভাগ্যাহতরা লাশ হয়ে সাগর-নদীতে ভাসল। এখনো সীমান্তে নোম্যানস ল্যান্ডে উদাস মনে মুক্তি কিংবা মৃত্যুর প্রহর গুনছে অনেকেই। মিয়ানমারের জল্লাদবাহিনী টিকতে দিচ্ছে না রাখাইনের মাটিতে। বাংলাদেশ দিচ্ছে না ভেতরে ঢুকতে। রাষ্ট্রহীন মানুষগুলোর অপরাধ তারা রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ, মুসলমান। যাদেরকে মায়ের সামনে শিশুকে গুলি কিংবা চাকু দিয়ে গলা কিংবা মাথা কেটে হত্যা করছে। স্বামী কিংবা বাবার সামনে তরুণীকে ধর্ষণের যে নজির মিয়ানমার এবার দেখালো তার উপমা চেঙ্গিস, হালাকু, হিটলার এবং ইয়াহিয়ার বর্বরতাকে ম্লান করে দিচ্ছে। বার্মিজ কন্যা অং সান সু চির মিয়ানমার যেনো মর্তের দোজখ। পৈশাচিকতার নতুন বৈদ্যভূমি।
এক সময় নেউইন নামের সামরিক জান্তাকে রোহিঙ্গা হত্যার জন্য দায়ী করে অনেকেই পাশ কাটাতেন। শেষ পর্যন্ত এই জাতিগত নিধনযজ্ঞে মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও নেতৃত্ব দিচ্ছে। জীব হত্যা মহাপাপের দোহাই রোহিঙ্গাদের জন্য আর ধর্মাচার রইল না। টাইম ম্যাগাজিন উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রচ্ছদে ছবি তুলে ধরে বিশ্ববাসীর সামনে এক অজানা ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরল। শান্তিবাদী বৌদ্ধদের এই কি দানবীয় চেহারা!
বিশ্ববাসী এই প্রথম জানল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও অহিংস নয়। চরমভাবে উগ্রবাদী ও মারাত্মক ধরনের সহিংস। ধর্মীয় নেতা তথা ভিক্ষুরা উগ্র ও চরমপন্থী হতে পারে, এ ছিল ধারণাতীত। তাদের পৈশাচিকতা, হিংস্রতা ও বর্বরতা বিশ্ববিবেককে শুধু নাড়া দিলো না, বিস্ময়ে হতবাকও করল। অবাক পৃথিবী তাকিয়ে দেখল কিভাবে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে চারখার করে দেয়া হলো রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি, ক্ষেত-খামার ও সব স্থাপনা।
মিয়ানমার রাখাইন রাজ্যকে ত্রাণ সংস্থা, মিডিয়া এবং মানবাধিকার সংস্থার জন্য নিষিদ্ধ করে রেখেছে। তার পরও জাতিসঙ্ঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বিগত ক’দিনে রাখাইন রাজ্যের বিপন্ন মানবতাকে নিয়ে বারকয়েক প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্বমিডিয়ায় গণহত্যার চিত্রগুলো ভয়াবহতার গভীরতা বোঝাচ্ছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত শান্তির দূত হিসেবে নোবেল জয়ী অং সান সু চির যে চেহারা বিশ্ববাসী এবার প্রত্যক্ষ করল, তাতে রীতিমতো নতুন এক ডাইনী চরিত্রকে চিনতে পেলো। যিনি হার মানিয়েছেন নে উইনের বর্বরতাকেও। ধিক সু চি! ধিক্কার তোমার নোবেল পুরস্কার পাওয়াকে। তোমার গণতান্ত্রিক ভাবমর্যাদার আড়ালে যে রাক্ষুসী চেহারা ও পৈশাচিকতা লুকিয়ে রয়েছে তারই প্রকাশ ঘটল এবার। তুমি ধ্বংস হও, ব্যথাদীর্ণ মানুষের অভিশাপ বও।
মিয়ানমার বাহিনীর নিñিদ্র ব্যবস্থার মধ্যেও রাখাইন রাজ্যে গণহত্যার যে বর্ণনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এসেছে, মিডিয়া কর্মী প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার গরাদ গলিয়ে যেসব ভয়াবহ হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নিষ্ঠুরতার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে- তাতে বিশসভ্যতা ও মানবতা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিবেক যেখানে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হওয়ার কথা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ফুঁসে ওঠার কথা, সেখানে এতটা নীরব থাকার কারণ অজানা। তাহলে রোহিঙ্গারা বিশ্বাসগত কারণেই গণহত্যার মুখে পড়াকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে না তো!
হালে বাংলাদেশ ভুলে বসেছে একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি। নিজেরা শরণার্থী হওয়ার দুঃখকষ্ট নিয়েও রাখাইন রাজ্যের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়বোধ করছে না। নিকট অতীতও এতটা দায়হীন দেখিনি। সরকার তাকিয়ে আছে ভারত ও চায়নার অমানবিক কূটনীতির দিকে। এ যেনো মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা পাওয়া জাতির জন্য লজ্জা! মানবতার এত কান্না, নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ সীমানাজুড়ে রোহিঙ্গাদের লাশ ভেসে বেড়ালেও সরকার কূটনীতির কূটচালে বন্দী থাকছে। মানলাম, ভারতের প্রয়োজন মিয়ানমারের বাজার, সীমান্তে নিরাপত্তা এবং সম্ভাব্য খনিজসম্পদ। তার ওপর চাই ভারত লাগোয়া উপদ্রুত অঞ্চলে নিজস্ব স্থিতি। তাহলে মানবতার দোহাই শুধুই মায়াকান্না! চীন মিয়ানমারকে আঞ্চলিক রাজনীতি ও ভূকৌশলগত নিরাপত্তার কারণে পাশে রাখতে চায়। এ অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি-ইউরোপীয় বলয় বিস্তার রোধ করতে চায়। হয়তো ঝিনজিয়াং-এ নিজেদের মুসলিম জাতিঘাতী অপকর্মও আড়ালে রাখতে চায়। ষোল কোটি মানুষের বাংলাদেশ কেনো সেসব বিবেচনায় নেবে। বাংলাদেশ জনগণের অনুভূতি লালন করে রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াবে। মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে যাবে। প্রয়োজনে মুসলিম বিশ্বকে এই বিপন্ন মানবতার সাথে একাত্ম হতে আহ্বান জানাবে। ওআইসিকে সংশ্লিষ্ট করে সাহায্য চাইবে। রাবেতার মতো সাহায্য সংস্থাকে পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করবে। মুসলিম বিশ্বের সম্পদশালী দেশগুলোকে সাথে নিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান চাইবে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করে, শরণার্থী হয়ে বুঝেছে রাষ্ট্রহীন, নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি কতটা কষ্টদায়ক। তাই রাক্ষুসী মিয়ানমার বাহিনীর অত্যাচারে যারা নদী-সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে- বাংলাদেশের উচিত তাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়ে মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা। ত্রাণ দিয়ে মানবিক দায়িত্ব পালন করা। জীবন ভয়ে সর্বস্ব ফেলে আসা মানুষগুলোকে আবার বর্বরতার মুখে ঠেলে দেয়া কিভাবে মেনে নেয়া যেতে পারে! এটাতো মৃত্যু ভয়ে পালিয়ে আসা মানুষগুলোকে জ্বলন্ত অঙ্গারে ছুড়ে মারা। নয়তো হিংস্র জানোয়ারদের মুখে তুলে দেয়া।
হিংস্র হায়েনার মুখ থেকে বেঁচে আসা রোহিঙ্গাদের আপাতত আশ্রয় দিয়ে মানবতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন। সব রাষ্ট্রাচার ও কূটনীতির ঊর্ধ্বে মানবতা। মিয়ানমার সরকারের ওপর এমন চাপ প্রয়োগ করুন, যাতে তারা নতুন করে আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে না দেয়। যাদের হত্যা করেছে তাদের দায় নিতে বাধ্য হয়। যারা পালিয়ে বেঁচেছে তাদের পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা দিয়ে ফেরত নিয়ে পূবর্বাসন করে। নয়তো জীবিত রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ, মৃতদের হাড়-গোড়, রক্ত এবং গুলিতে ঝাঝরা হওয়া ক্ষতবিক্ষত লাশ আমাদের বিরুদ্ধে আহাজারি করবে, বিশ্ব প্রভুর কাছে তাদের মানবিক আত্মা ফরিয়াদ করবে। মানবাত্মার আর্তনাদ ও আহাজারিতে সাড়া না দেয়ার অপরাধে আমাদের ওপর অভিশাপ নামবে। এক আইনাল সমুদ্র সৈকতে বালুর ভেতর মুখ বুজে পড়ে থেকে বিশ্বকে ধিক্কার দিয়েছে। তারকাঁটায় ঝুলে থাকা এক ফালানীর লাশ আমাদেরকে দায়বদ্ধ করে রেখেছে। মিয়ানমারের হাজার হাজার শিশু-নারী ও বৃদ্ধার লাশ কি আমাদের হৃদয়ের মর্মমূলে খানিকটাও বোধোদয় ঘটাবে না।
চেতনার বৈরাগী ও মানবতাবাদের ডুগডুগিবাজরা কোথায়। কোথায় ইসলামের মানবতাদীরা। কোন গর্তে লুকিয়ে আছে দুনিয়ার মজলুমকে জাগানোর ঠিকাদাররা। গণহত্যার এমন পৈশাচিকতা দেখেও নিথর নিস্তব্ধ হয়ে থাকা এ কোন অচেনা বাংলাদেশ। এ তো নজরুলের বাংলা নয়, সুকান্ত-ফররুখের বাংলা নয়, রবিঠাকুরের বাংলা নয়, বঙ্গবন্ধুর বাংলা নয়, এই বাংলা জনগণের কাছে অচেনা।হ
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন