|
মাসুদ মজুমদার
digantaeditorial@gmail.com |
|
আঞ্চলিক ভূরাজনীতি : কার ভূমিকা কী?
14 September 2017, Thursday
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তিটা তৈরি করেছিলেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘দেশের বাইরে আমাদের বন্ধু রয়েছে, প্রভুু নেই।’ তা ছাড়া, সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়- এটিও মূলনীতি হিসেবে কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়টিতে ভারতের একাধিপত্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অপ্রতিহত প্রভাব বিস্তারের মাঝেও বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত দৃঢ়তার কাছে বাংলাদেশের অবস্থান ও তার স্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট ছিল। বাকশাল প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল নানা ধরনের সঙ্কটের মাঝেও আশা জাগানোর অন্তহীন প্রচেষ্টার ভেতর। তারপর স্বপ্নভঙ্গের কারণ ঘটতে লাগল।
বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর সোভিয়েত ধারার সরকার গঠন জাতিকে কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা দেয়নি। বরং লক্ষ্য ও কক্ষচ্যুত করেছে। বাকশালকে বঙ্গবন্ধুর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলা এক ধরনের প্রবঞ্চনা। কারণ এর ধরন-ধারণ সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজন্ম অনুশীলিত ও অনুসৃত রাজনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। এ সত্যটি মেনে নিলে এটি ছিল মুজিবের নীতিনির্ধারণী সফর।
ওআইসির পথে উন্নতশির অভিযাত্রার পথপরিক্রমায়ও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা পথপ্রদর্শক বা রাহবারের মতো। এ পথ ধরেই জিয়াউর রহমান মুসলিম বিশ্বের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে নতুন এক মাইলফলক স্থাপন করলেন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার সেই পথে এগোলেন। এরশাদের পথ চলা ছিল জিয়ার পদচিহ্ন অনুসরণ করে। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণার বাইরে এরশাদের নিজস্ব রাজনৈতিক কোনো দর্শন ছিল না। এখনো নেই। চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে জিয়ার ভূমিকা ছিল স্মরণযোগ্য। মওলানা ভাসানীর ব্যক্তি-ইমেজ চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
ইউরোপ-আমেরিকার সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো সরকারের একক ভূমিকা নেই; তবে স্বার্থের বোঝাপড়ায় পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে পশ্চিমবঙ্গ ছিল চীনপন্থী বাম রাজনীতির সূতিকাগার। সেখানে মাওবাদীদের অবস্থান ছিল দৃঢ়। চারু মজুমদারের নক্সালবাড়ি আন্দোলনের ভীতি দিল্লিকে অস্বস্তিতে রেখেছিল। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। তার ওপর চীন ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ‘বন্ধু’। এই বাস্তবতায় সিরাজ শিকদারের অবস্থান মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর শুরুর দিনগুলো নিষ্কণ্টক ছিল না। তার ওপর ছিল গণবাহিনী ও জাসদ রাজনীতি।
অন্য যেকোনো সরকারের তুলনায় শেখ হাসিনার বিদেশনীতিতে ভারসাম্য সব সময় কম ছিল। কখনো ভারতের প্রাধান্য এতটা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে যায় যে, তাকে ভারতের স্বার্থের ক্রীড়নক ভাবার মতো কারণ ঘটে। পশ্চিমাদের সাথেও শেখ হাসিনার কূটনীতি পূর্বাপর ভারসাম্যপূর্ণ নয়। সে তুলনায় বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশনীতিকে ভারসাম্যপূর্ণ বলা সম্ভব। খালেদা জিয়ার ‘লুক ইস্ট নীতি’র গরজ ছিল; কিন্তু নীতি বাস্তবায়নের কর্মকৌশল ছিল দুর্বল। ফলে আমাদের পূর্বদুয়ারি অর্থনৈতিক কূটনীতির মতো সাধারণ কূটনীতিও বাস্তবে মুখথুুবড়ে পড়ে থাকে। ভূরাজনৈতিক টানাপড়েনের কারণেই বাংলাদেশ কোনো দেশের বাফার স্টেট নয়। তাই পড়শি সবার সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের গরজ রয়েছে; এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। সে ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দেশের সাথে বিশেষ সম্পর্ক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বিঘোষিত নীতির খেলাপ। সার্ক আমাদের স্বপ্নের ফসল। কিন্তু ভারতীয় কূটনৈতিক দাপটের কাছে সংস্থাটি বারবার হোঁচট খায়। তাই সম্পর্ক উন্নয়নের পথে ছেদ পড়ে।
এর বাইরে মুসলিম বিশ্বের সাথে বিশেষ সম্পর্কের বিষয়টি উপেক্ষার পর কোনো এক দিকে ঝুঁকে পড়ার মতো সাংবিধানিক দায় অন্তত আর নেই। কিন্তু উদার অর্থনৈতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু করার ছিল, যা করা হয়নি। তাই চাল-ডাল-পেঁয়াজ ফুরালে বাজার স্থিতিতে থাকে না।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে উন্নয়নের আইয়ুবি ধারায় পথ চলতে চেষ্টা করেছে। সাড়ে আট বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, যে দিকেই দৃষ্টি দেয়া হয় সে দিকেই সমস্যা-সঙ্কটের পাহাড় জমে আছে। মিয়ানমারের সাথে টানাপড়েন শুরু হওয়ার পর দেখা গেল, ভারত আমাদের স্বার্থের পক্ষে নেই। চীন আমাদের কথা ভাবছে না। প্রভাবক মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা কাক্সিত নয়। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালদ্বীপ মানবিক কারণে যতটা স্বতঃপ্রণোদিত-বাংলাদেশের নাজুক পরিস্থিতির ব্যাপারে ততটা আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বাড়া ভাতে ছাই ছিটাচ্ছে পড়শিরাÑ তাও মুসলিম বিশ্বের বন্ধুদের বিরাট বাজারে। পোশাক শিল্পের বাজারেও আমাদের উপস্থিতি ম্লান করে দিচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে পিছিয়ে পড়ার কারণে।
এক ‘ইউনূস ইস্যু’তে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে বসল। তাই বাড়তি বাণিজ্যিক সুবিধাপ্রাপ্তি ঝুলে গেল। ইউরোপ থেকে বাংলাদেশী বিতাড়নের সময় কোনো দেশই বাংলাদেশীদের ব্যাপারে বাড়তি সিম্প্যাথি দেখাল না। তাদের বাজারে আমাদের উপস্থিতির ক্ষেত্রেও রক্ষণশীলতা প্রদর্শন করল। ভারত যখন পাকিস্তানের সাথে ক্রিকেট কূটনীতির আসর জমায়, তখন বাংলাদেশকে প্রপাগান্ডার মেশিন বানিয়ে পুরনো গীত গেয়ে যেতে ইন্ধন জোগায়। আমরাও সেই কার্ড খেলতে নেচে উঠি।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইস্যুতে সরকার সব আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ‘মিথ্যাবাদী’ সাজিয়ে দিতে চাইল। অথচ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে অভিযোগ খণ্ডনের কোনো সাহস প্রদর্শন করল না।
রাজনীতির সস্তা ভাষায় কূটনীতি করা সমীচীন নয় জেনেও বাংলাদেশ সরকার সব কিছু অস্বীকার করা যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেÑ তাতে বন্ধুও বাড়েনি, শত্রুও কমেনি; বরং দূরত্ব বেড়েছে। নিজেদের অবস্থানও পরিষ্কার হয়নি। শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম-অপহরণ নিয়ে নয়, আইনের শাসন, গণতন্ত্রচর্চা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টকেও যখন রাজনীতির সস্তা ভাষায় চ্যালেঞ্জ করা হয়, তখন আমাদের ভাবমর্যাদা কূটনীতিক পাড়ায় ধস নামায়। বিদেশীদের কাছে আমরা অবিশ্বস্ত প্রমাণিত হই। এর খেসারতটা কূটনীতির ব্যর্থতার খাতায় জমা হয়। হোলে আর্টিজানের অভিযান কূটনীতিকদের আস্থাকে মেরামত করে, কিন্তু আশ্বস্ত করেনি। কারণ উগ্রপন্থী ইস্যুর সাথে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টিকে জড়িয়ে সরকার তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়নি। না জেনে বুঝেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধে পশ্চিমাদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর দেখা গেল, আমরা নিধিরাম সর্দার। কেউ আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলো না। আমাদের অর্থমন্ত্রী নাকি বিশ্বের তাবৎ অর্থনীতিবিদ ও অর্থমন্ত্রীদের মধ্যে ‘সেরা’। অথচ অর্থনৈতিক কূটনীতির এ যুগে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ববাজারে নিতে পারলেন না। আমাদের ব্যাংকপাড়ায় রীতিমতো লুণ্ঠন চলল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ফোকলা হয়ে গেল। অর্থমন্ত্রীর জন্য এটাও কি সাফল্যের খতিয়ান? তিনি শেয়ারবাজার লুণ্ঠনের তদন্ত রিপোর্টটা প্রকাশ করেন না। রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করলে নাকি চুরির টাকা ফেরত পাওয়া কঠিন হবে। অর্থনীতিতে সাগর চুরির সব ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে।
আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির অবস্থা ‘রাবিশ’ না ‘বোগাস’, আমাদের জানা নেই। অর্থনৈতিক কূটনীতির আসল কাজ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা। সে রাজ্যে আমাদের পৃথিবী ‘গদ্যময়’। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির বিদেশ সফরের তালিকা নিয়ে অনেক মজার গল্প চালু আছে। আমাদের আন্তর্জাতিক পুরস্কারের তালিকাও ছোট নয়। বাস্তবে আমাদের কূটনীতির ক্ষেত্রে প্রাপ্তিযোগটা কী?
কূটনীতিতে দেয়া-নেয়া সাধারণ বিষয়। বঙ্গোপসাগর মামলায় আমরা জেতেছি। ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। এসব প্রাপ্তি কম নয়, কিন্তু সাধারণ কূটনীতি ও অর্থনৈতিক কূটনীতির খাতায় জমা-খরচের হিসাবটা কোথায়? সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তি আশাবাদী করেছিল। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কও থাকবে, আবার খুনসুটিও চলবে। মনে হয়েছিল, তিনি কূটনীতির শিরদাঁড়াটা চিনেছেন এবং বুঝেছেন। কিন্তু চীন-ভারতসহ লুক ইস্ট নীতিতে এর কোনো প্রতিফলন দেখা গেল না। আরব বিশ্ব ও পশ্চিমা রাজ্যে আমাদের নতুন কোনো ইমেজ সৃষ্টি হলো না। বন্ধুও তৈরি হলো না।
এখন বঙ্গোপসাগর-লাগোয়া ভূরাজনীতিতে নতুন পাশাখেলা শুরু হয়েছে। রোহিঙ্গারা গিনিপিগ। বাংলাদেশ পরিস্থিতির শিকার। ইউরোপ-আমেরিকার ঘুম নেই। তাই খেলাটা আগে-ভাগেই শুরু হয়ে গেল। পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাবে, তাতে সন্দেহ কী? চীন-ভারত এই পাশাখেলায় অসম পার্টনার। এ খেলায় দ্রুত পক্ষ হয়ে যাবে ইউরোপ-আমেরিকা। বাংলাদেশ পক্ষ হবে কি না, সময় বলে দেবে। তবে খেলাটা বাংলাদেশের জন্য সহজ ফর্মুলায় নেই। পড়শিদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি না করেই এগোতে হবে। এখন নিজেদের শক্তি সামর্থ্যরে প্রমাণ যেমন দিতে হবে, তেমনি কূটনীতির রাস্তায় বাংলাদেশের জন্য মসৃণ ও সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।
উৎসঃ নযাদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন