|
মাসুদ মজুমদার
digantaeditorial@gmail.com |
|
উম্মাহর ঐক্যের ফাটল ও যুবরাজ সালমানের সংস্কার
01 November 2017, Wednesday
বিশ্বটা এখন এমন এক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে যে, মেরুকরণের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ওপর একবাক্যে কিংবা হুট করে মন্তব্য করা বড়ই কঠিন, বিপজ্জনকও। তা ছাড়া ভাঙাগড়ার একটা খেলার সাথে উত্থান-পতনের সম্পর্কও জড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন মাও সে তুংয়ের পর চীন দেঙ যুগ পার করেছে। এখন শির যুগে প্রবেশ করে ‘শি-বাদকে’ সামনে রেখে চীন নিজেকে নতুনভাবে মেলে ধরতে চাইছে। চীন নিজেকে পরাশক্তি বলে না, কিন্তু অর্থনৈতিক পরাশক্তি হওয়া ছাড়াও দেশটি যে, প্রভাবক রাষ্ট্রের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে, তা ইউরোপ-আমেরিকাও স্মরণে রাখতে চায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রায় পাঁচ বছর বিশ্বকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। মিত্রশক্তির বিজয় গ্রেট ব্রিটেন ও তার মিত্রদের ভালোভাবে বিশ্ব রাজনীতির মোড়লের আসনে বসিয়ে দেয়। জার্মানিসহ বলকান এলাকার রাষ্ট্রগুলোর ওপর নতুন বিপদ নেমে আসে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অটোমান সাম্রাজ্য খ্যাত উসমানী খেলাফত ব্যবস্থা, যা তুর্কি খেলাফত হিসেবেও পরিচিত। ব্রিটেন হেজাজ-নজদসহ পুরো আরবদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মিত্রশক্তি যুদ্ধে বিজয়ের পর তাদেরকে অটোমানদের কাছ থেকে স্বাধীন করে দেবে। যে প্রতিশ্রুতিপত্র ব্রিটেনের বা যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ইহুদি নেতা রথচাইল্ডকে দিয়েছিলেন, সেটাই বহুলালোচিত বেলফোর ঘোষণা। সময়টা ছিল ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর অর্থাৎ আজকের এই দিনে। ঠিক ১০০ বছর আগে। সেই চুক্তিতে ছিল অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে আরবদের স্বাধীনতা দেয়ার প্রতিশ্রুতিটিও। এটি ছিল ১৯১৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে দেয়া প্রতিশ্রুতি। তবে আরবদের স্বাধীনতার বিষয়টি মুখ্য ছিল না। বেলফোর ঘোষণার মূল প্রতিশ্রুতিটি ছিল যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে ইহুদিদের জন্য একটা ‘আবাসভূমি’-এর ব্যবস্থা করে দেয়া।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনে প্রশিক্ষিত অস্ত্রশস্ত্রসহ একদল ক্যাডার ফিলিস্তিনিদের নির্মমভাবে হত্যা করে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের মাধ্যমে বেলফোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে। ব্রিটেন সে সময় হাজার হাজার ইহুদিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে ফিলিস্তিনে পাঠিয়েছিল। দেশটি আগের অবস্থানে নেই। এখন ব্রিটিশরাজ্যে সূর্য অস্ত যায়। ব্রিটেনের শাসকেরা যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণ-অনুকরণ করে পথ চলেন। সভ্যতাটাও স্থানান্তরিত হয়ে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে। এখন ব্রিটেনের স্থানে আমেরিকা তথা যুক্তরাষ্ট্র। উভয়ের ধরন আলাদা কিন্তু কথিত মূল্যবোধ অভিন্ন।
অটোমানদের উত্তরাধিকারী তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান আবার তার দেশকে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরার চেষ্টা করছেন। এর পাশাপাশি হেজাজ নজদের এই যুগের যুবরাজ ইতোমধ্যে আলোচনায় উঠে এসেছেন। সব সময়ের জন্য সত্য হচ্ছে- আরব, পারস্য ও তুরস্ক এক কাতারে দাঁড়ালে একটি নতুন ভবিষ্যৎ হাতছানি দেয়। বিপরীত কিছু ঘটে যাওয়ার নজিরও আছে। বাস্তবেও কি তা ঘটতে যাচ্ছে?
এ ছাড়া বিশ্বপরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। আমরা যখন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বিব্রত, তখন স্বাধীনতার দাবিতে টগবগ করে ফুটছে স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়া। ইউরোপ-আমেরিকা তাদের স্বাধীনতার পক্ষে নেই। বার্সেলোনাও একাট্টা হতে পারেনি। পোপের আহ্বানও হলো, ইউরোপ এক থাকুক। তার পরও পুজদেমন স্বাধীনতা ঘোষণার ঝুঁকি নিলেন; যেমন কুর্দিরা ভাবতে চাচ্ছে না সিরিয়া-ইরাক, তুরস্ক-ইরান কিংবা কোনো আরব দেশ তাদের সাথে নেই। কুর্দিদের কাছে সময়ের ভাবনার চেয়েও স্বাধীনতা বড়। তাদের এটা ভেবে দেখার অবকাশও নেই- পাঁচ দেশের পাঁচ টুকরো নিয়ে কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র দাঁড়ায় না। এই যুগে চার দিকে প্রতিপক্ষ রেখে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হেফাজত করা কঠিন, প্রায় অসম্ভব। সৌদি আরবের আগেই সংস্কারের ছোঁয়া পাওয়া, কাতারকে কাবু করার জন্য সৌদি আরব দৃশ্যমানভাবে এক পায়ে খাড়া। কিন্তু তুরস্ক-ইরান এই ইস্যুতে এক মেরুতে দাঁড়ানোর পর সৌদি আরব ও তার মিত্রদের সাতবার না ভেবে উপায় নেই। ইরান ও তুরস্ক কাছাকাছি আসার চেষ্টা এখন অন্তহীন। অটোমান ইগো ও পারস্য আভিজাত্য ভুলে ইরান ও তুরস্ক কাছাকাছি আসার ধর্মতাত্ত্বিক গুরুত্বও অনেক বেশি; আবার মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক অবস্থায় ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বড়মাপের নিয়ামকও। সৌদি যুবরাজ সংস্কারের জন্য উপযুক্ত সময় বুঝেছেন কিন্তু যে পথে হাঁটতে চাচ্ছেন- তাতে অনেক ঝুঁকি আছে। তবে যুগযন্ত্রণা আত্মস্থ করে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গের কারণ ঘটাতে না চাইলে সামনে এগোতেই হবে। উমাইয়া, আব্বাসী ও অটোমানদের উত্থান-বিকাশ ও পতন পর্বের শিক্ষাটা সামনে রাখা জরুরি। নয়তো ধর্মতাত্ত্বিকভাবে তো বটেই, শাসনতান্ত্রিক কাঠামোটাও ধাক্কা খাবে। তা ছাড়া ইউরোপ-আমেরিকার চশমায় আরবদের দেখলে তিনি ভুল করবেন।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইতোমধ্যে অনেক ওলটপালট ঘটনা ঘটে গেছে। মিসর-লিবিয়া, ইরাক-সিরিয়া আগের জায়গায় নেই। ফিলিস্তিন নতুনভাবে এগোবার পথ খুঁজছে। ইতোমধ্যে প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস এবং মুক্তিকামী ফাতাহ অভিন্ন সুরে কথা বলতে চাইছে। ইয়েমেনের আর্তনাদ আরববাদের হাঁ করা গহবরের ভেতর কাতরাচ্ছে। যে সৌদি আরব নাগরিকত্বের ব্যাপারে অতি সাবধানী, তারা রোবটকে প্রতীকী নাগরিকত্ব দিয়ে প্রযুক্তির ডঙ্কা বাজাল, না একধরনের অহম প্রকাশ করতে চেয়েছে, তা আরব ও মুসলিম বিশ্বকে বোঝাতে হবে।
সৌদি যুবরাজ হয়তো ভেবেছেন প্রযুক্তির সবটুকু আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন। রুশ বিপ্লবের পর তারাই প্রথম প্রযুক্তির চমক দেখিয়েছিল। অথচ এ পথে আগে আগে চলার অভিজ্ঞতা নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র সামগ্রিকতা নিয়ে ভেবেছে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন খান খান হয়ে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের ‘দারোগাগিরি’ ট্রাম্প অব্দি টিকে আছে। এই পরিস্থিতিতেও সৌদি যুবরাজ যখন বলেন, কাতার তাদের জন্য খুবই সামান্য ইস্যু, তখন থমকে দাঁড়িয়ে ভাবতে হয়, বাস্তবে সৌদি আরবের গন্তব্য কোথায়? সৌদি আরব মডারেট হোক। অতি রক্ষণশীলতা বর্জন করুক। কিন্তু ইসলামের প্রাণস্পর্শী আবেদন ও সার্বজনীন ধারণা থেকে সরে দাঁড়ালে শুধু ভুলই করবে না- পথ হারাবে। নিজের শরীরের চেয়েও বড়মাপের জামা পরলে গতর বাড়ে না। সৌদি আরব সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন- সৌদি আরবের এমন একজন প্রজ্ঞাবান বন্ধু প্রায় দশ বছর আগে বলেছিলেন- এটা হজরত সোলায়মান আ:-এর লাঠিতে ভর দিয়ে জিনদের মসজিদ নির্মাণ তদারকির মতো। একসময় সোলায়মান নবী ইন্তেকাল করলেন, লাঠিতে ভর দেয়া অবস্থায় তার অবয়বটা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সময়টা আরো গড়াল, একসময় লাঠিতে উইপোকা ঢুকে সাবাড় করে দিলো। ভর সরে যাওয়ার পর জিনরা টের পেল, তিনি আর নেই।
সৌদি আরব নিয়ে আমাদের আবেগ-উপলব্ধি দুটোই শ্রদ্ধামিশ্রিত। কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে দেশটির প্রতি মমত্ববোধও প্রচুর, কিন্তু বিশ্ব মুসলিমের ওপর নেতৃত্বের আবহ সৃষ্টির জন্য দেশের নেতৃত্বের আগ্রহ সব সময় কমই পরিলক্ষিত হয়েছে। অবশ্যই বাদশাহ ফয়সল ছাড়া। বিশেষত মুসলিম স্বার্থ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকেছে। তাই মাজহাবি বিতর্ক চাঙ্গা হয়েছে। শিরক ও বিদয়াতমুক্ত সৌদি আরব কাম্য কিন্তু বহুমতের সহাবস্থান ও বহুত্ববাদ বর্জনীয় নয়। অনেক সময় সুযোগটা হাতছাড়া করেছে বলেই উম্মাহর স্বার্থ ও ঐক্য দেশীয় কূটনীতির কাছে হেরে গেছে।
তাই সৌদি যুবরাজের সংস্কার ভাবনাকে স্বাগত জানাতে মন বলে, আবার নব্য তুর্কিদের মতো কিংবা পাশ্চাত্যবাদী ভাবধারার সেকুলার চিন্তকদের মতো না হয়- সেটা মাঝে মধ্যে বিবেককে সতর্ক হতে বলে। কূটনীতির ক্ষেত্রে এবং নতুন মিত্রের সন্ধানে সৌদি আরব পরীক্ষিত অনেক আদর্শিক বন্ধুকে অবমূল্যায়ন করেছে। দেশে দেশে যারা সৌদি ধর্মতাত্ত্বিক চিন্তা ফেরি করেছেন- তারা এখন বিব্রত। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, ইংরেজরা যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে আরবে ভাগবণ্টনে বানরের পিঠা ভাগের মতো ভূমিকা পালন করেছিল- তারাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, আল্লাহর নবীর সাথে যোগসূত্র ছিন্ন করলে আরব ঐক্যের ফাটল মেরামত করা যেমন সম্ভব হবে না, মুসলমানদের ওপর ভরসার সুতাটাও ছিঁড়ে যাবে। সব কিছুর পরও সৌদি আরবের সংস্কার সময়ের দাবি, আবার জনগণের মৌলিক ভাবাদর্শের সাথে বহুত্ববাদ ও চিন্তাগুলোর সমন্বয়ও জরুরি। আধুনিক মানস লালন করা অপরিহার্য; কিন্তু বড় ক্যানভাসের ভেতর আদর্শিক ও স্বকীয় অস্তিত্ব বিপন্ন করে নয়। বিশ্বজুড়ে নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসের মাঝে উম্মাহর ঐক্যের সূত্র অনুসন্ধান করাটাই সবচেয়ে বড় সংস্কার।
ইউরোপে যখন ভাঙনের সুর বাজে, যুক্তরাষ্ট্র যখন ট্রাম্পের মতো ক্ষ্যাপাটে ধরনের মানুষকে নিয়ে পথ চলে তখন বুঝতে চেষ্টা করি সভ্যতা বোধকরি স্থান বদল করছে। কারণ ইতিহাস তো এ সাক্ষ্যই দেয়Ñ সভ্যতা বৃদ্ধ যাযাবরের মতো। সময়ের ব্যবধানে স্থান পাল্টায়। চীন যখন শক্তিধর হয়ে ওঠে, তখন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছে করলেও উত্তর কোরিয়ার ওপর একক ছড়ি ঘুরানোর লাইসেন্স পাবে না। ভারত নিজের জনগণকে উপেক্ষা করে দেশকে অস্ত্রভাণ্ডারে পরিণত করে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করতে পারে- পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন। হিন্দুত্ববাদের ভেতর যে শক্তি আছে- সেটা দেশ শাসনের জন্য শাসকদের দরকারি ধন্বন্তরী হতে পারে, তবে আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিকে প্রভাবিত করা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনোভাবেই মোক্ষম হতে পারে না। তাই বিশ্বপরিস্থিতি নিয়ে আরো ভাবার অবকাশ রয়েছে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন