অনেকের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যর্থ শিক্ষামন্ত্রী সম্ভবত নুরুল ইসলাম নাহিদ। কিংবা তিনি এতটাই চালাক যে, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপর্যয়ের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কার্যত অন্য দেশের স্বার্থ উদ্ধারের পথ করে দিচ্ছেন। মহা উৎসাহের সঙ্গে তিনি ৯৮-৯৯% পাস দেখান, জিপিএ ৫ দেখান। ধারাবাহিকভাবে প্রশ্ন আউট হলেও চিকন হাসি দিয়ে তুড়ি মেরে তা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। পাঠ্যপুস্তকগুলোকে বিজাতীয় সংস্কৃতির বাহন করে তুলেছেন। নতুন প্রজন্মকে পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমেই ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করা হচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁসের মহোৎসব চলছে। পিইসি, জেডিসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষারও।
এই শতভাগ পাস আর জিপিএ ৫-এর এমন ধাক্কা সমাজে লেগেছে যে, পাস করার যে উপযুক্ত নয়, সে-ও জিপিএ ৫ পেয়ে যাচ্ছে। আর তিনি আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। শিক্ষকদের বলে দেয়া হচ্ছে, কোনো অবস্থাতেই ছাত্রদের ফেল করানো যাবে না। কিছু না লিখতে পারলেও পাস করিয়ে দিতে হবে। কোনো ছাত্র পরীক্ষায় পাস নম্বর পেল না, এ জন্য শিক্ষকদেরই জবাবদিহি করতে হয় কেন? ফলে শিক্ষকেরাও চাকরি রক্ষা আর ঝুটঝামেলা এড়ানোর স্বার্থেই চোখ বন্ধ করে নম্বর দিয়ে যান। দেশে জিপিএ ৫-এর বন্যা বয়ে যায়। এরপর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে এলে দেখা যায়, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের নম্বরও জোগাড় করতে পারছে না। তাহলে কী লাভ গণহারে জিপিএ ৫ দিয়ে কিংবা গণহারে পাস করিয়ে দিয়ে? লাভ বোধ হয় একটাই, তা হলো বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দেয়া। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় যে জেনারেশন এখন তৈরি হচ্ছে, তারা তেমন কোনো শিক্ষাই পাচ্ছে না। বিবিসি জিপিএ ৫ প্রাপ্তদের সঙ্গে এক আলোচনা বৈঠকের আয়োজন করেছিল। তাতে ওই শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি এর ইংরেজি কী? এর সঠিক উত্তর কেউই দিতে পারেনি। বলেছে ‘আই অ্যাম জিপিএ ৫’।
তা হলে কী লাভ হলো? প্রাথমিক স্তর থেকে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত, সর্বত্রই এমন এক অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। একেবারেই শিশুদের শেখানো হচ্ছে, ব-তে বলি, ধ-তে ঢাক, ব দিয়ে বক হয় না? ঢ দিয়ে ঢাকা হয় না? কোন উদ্দেশ্যে শিক্ষামন্ত্রী এমন আয়োজন করেছেন, বলতে পারি না। এসব আমাদের সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাতের শামিল। এ পর্যন্ত যা দেখা গেছে, তাতে প্রতীয়মান হয় মন্ত্রী তথা সরকার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাস্তবে অশিক্ষিত, অজ্ঞ ও মূর্খ করে তোলার অভিযানে নেমেছেন। এর প্রতিকার জরুরি।
এ দিকে প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছে অনেক। এ ফাঁসের সঙ্গে প্রধানত সরকারি দলের শিক্ষকেরা কিংবা ছাত্রলীগ জড়িত থাকে। ফলে ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত কিছুই নেয়া যায় না। শিক্ষামন্ত্রীকে একদিন বলতে শুনলাম, ‘পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, না বলতে পারছি, না সইতে পারছি।’ তাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কেন বলতে পারছেন না? কখনো প্রশ্ন ফাঁস করছে বিজি প্রেসের কর্মচারীরা। কখনো ফাঁস করছে সরকারি দলের শিক্ষার্থীরা। কখনো বা সরকারি দলের শিক্ষকেরা। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।
তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ১৪০ জন ছাত্রের ভর্তি বাতিল করে দিয়েছে। একজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেছে; অপরজনকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। অভিযোগ, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফ্যাকালটিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ৭ ডিসেম্বর ২০১৬ এরা ফাঁস করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট দুইজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাও নোটিশ জারি করেছে। তাদের আগামী দুই বছরের জন্য ভর্তিসংক্রান্ত কোনো কাজে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কর্মচারীও রয়েছেন। এরা সেখানকার অঙ্ক ও পরিসংখ্যান বিভাগের কর্মচারী। কোনো সন্দেহ নেই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা প্রশংসনীয়। কিন্তু অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ইতোমধ্যে দেশের কয়েকটি সংবাদপত্রে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনার বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। তার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, কেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এমন ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল? ঘটনা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রশ্ন ফাঁসকারীদের দ্রুত শাস্তির দাবি জানান। তারা উপাচার্যের কাছে লিখিত চিঠিতে জানালেন, ছাত্রলীগেরই অন্য একটি গ্রুপ এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। আর তাদের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের সবার শাস্তির দাবি করে ছাত্রলীগ। এটি মন্দ নয়, স্বাভাবিক সময়ে এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে সবাই তাতে বাহবা জানাত। কারণ প্রশ্ন ফাঁসের মতো শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসকারী কাজকে কেউ সমর্থন করতে পারে না।
তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, ছাত্রলীগের এই দুই গ্রুপ অনেক দিন ধরেই রেষারেষিতে আছে। এর পরিণতিতেই এই শাস্তির ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি বিরাট ব্যবসা। এই ব্যবসা করছে একশ্রেণীর অসাধু লোক। তার সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সবাই আছেন। প্রশ্ন ফাঁস করে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়া যায়। আর এই অর্থই সব অনর্থের মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অর্থ নিয়েই ছাত্রলীগের রেষারেষি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ একজন শিক্ষকের দ্বারা তদন্তের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তারপরও এই পরিস্থিতি বহু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভর্তি পরীক্ষা শুরু হওয়ার দু’দিন আগে কড়া নিরাপত্তায় রক্ষিত ভর্তি পরীক্ষার ৬০ সেট প্রশ্নপত্র চুরি হয়ে যায় এবং সেগুলো এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পরীক্ষার্থীরা সহজে পাস করার জন্য এসব প্রশ্নপত্র কিনে নেয় আর সংশ্লিষ্টরা এখান থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থের মালিক হয়।
পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ১৬ মার্চ পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সে পরীক্ষা অনুষ্ঠান দুই মাসের জন্য স্থগিত করে দেন। আগের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, সে রকম ৮৮ জন ছাত্র নতুন ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত রাখার আবেদন করেন। আদালত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছেন, নতুন করে এই ভর্তি পরীক্ষা নেয়া কতটা যৌক্তিক। তাহলে অবস্থা দাঁড়াল এই যে, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বেকায়দায় পড়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক সেশন স্থগিত হয়ে গেছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষার সততা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। তার ওপর দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। প্রায় সর্বত্রই অসৎ শিক্ষক, অফিস কর্মচারী ও সরকারি প্রেসের কর্মীরা মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এদের কাজই প্রশ্নপত্র ফাঁস করা এবং এর মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থবিত্তের মালিক হওয়া। এর আগে দেখা গেছে, প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কেউ যদি আটক হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের সদস্যরা তাদের নেতাকে নিয়ে থানায় গিয়ে প্রশ্ন ফাঁসকারীকে ছাড়িয়ে এনেছেন। এখানেও শিক্ষামন্ত্রী অসহায়। তিনি এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছেন না। আর সম্ভবত তাই তিনি বলেছেন- কিছু বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না। তিনি সম্ভবত সবই জানেন, কিন্তু কী করে বলেন যে, ছাত্রলীগই প্রশ্নপত্র ফাঁসের নায়ক। এটি বলার সাধ্য তার নেই।
সদ্যসমাপ্ত এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ঢাকার কমলাপুর শেরেবাংলা রেলওয়ে হাইস্কুলের একজন শিক্ষকসহ ১৯ ব্যক্তিকে আটক করেছিল পুলিশ। প্রশ্নপত্র সাধারণত ফাঁস হয় পরীক্ষার দিন সকালে, যখন এগুলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের হাতে দেয়া হয়। তারা ফেসবুকের মাধ্যমে এসব প্রশ্নপত্র তাদের ছাত্রদের কাছে ছড়িয়ে দেন। ছড়িয়ে দেন এই কুচক্রী দলের সঙ্গে জড়িত অন্য শিক্ষকদের কাছে। তারপর অর্থের বিনিময়ে প্রশ্নপত্রগুলো বিক্রি করেন। গ্রাহক আগে থেকেই ঠিক করাই থাকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন- সরকারি কর্মচারী ও কোচিং সেন্টারগুলো প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। এটা খুব স্বাভাবিক যে, প্রশ্নপত্র যেখানে ছাপা হয় এবং যেখান থেকে বিতরণ হয়, সেখান থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের সূত্রপাত। তিনি অভিযোগ করেন, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, শিক্ষা বোর্ডগুলো এবং বিজি প্রেস কোনো-না-কোনোভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত। আর জড়িত আওয়ামীপন্থী ছাত্র-শিক্ষকেরাও। আটক এই শিক্ষকেরা স্বীকার করেছেন, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে তাতে প্রশ্নের উত্তর সংযোজন করে প্রশ্নপ্রতি ছাত্রদের কাছ থেকে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। তারপরও এত অসহায় কেন শিক্ষামন্ত্রী?
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com
উৎসঃ dailynayadiganta.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন