কয়েক দিন আগে পেশাদার সিনিয়র ডাক্তাররা বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) ব্যানারে এক ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। তারা চেম্বারে রোগী দেখবেন না। এর ফলে সারা দেশে অসংখ্য রোগী অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন। এ ধর্মঘটের কারণ সামান্যই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী একজন রোগিণী চৈতির সেন্ট্রাল হাসপাতালে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ওই হাসপাতালে ভাঙচুর চালান তার সহপাঠীরা। তাতে সেখানকার ডাক্তার-নার্সদেরও কয়েকজন আহত হন। ওই হাসপাতালের মালিক একজন সিনিয়র স্বনামধন্য চিকিৎসক। সেখানকার ডাক্তাররা রোগিণীর সহপাঠী ও আত্মীয়স্বজনকে এটা বোঝাতে ব্যর্থ হন যে, চৈতির মৃত্যু অবধারিত ছিল। তার ছিল ব্লাড ক্যান্সার। তাকে যখন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, তখন তার আর বাঁচার কোনো আশা ছিল না। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর মৃত্যু সবাই মেনে নেয়। কিন্তু সুস্থ মানুষ, হাসপাতালে নিয়ে এলাম আর মারা গেল, এটা কেউ মেনে নিতে পারে না। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ ওঠে। ভুল চিকিৎসা যে হয় না, তা কিন্তু নয়। ঢাকারই আরেক বিখ্যাত হাসপাতাল ল্যাবএইডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের ভুল চিকিৎসা হয়। তাতে ওই শিক্ষকের মৃত্যু হয়। তা নিয়ে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত ল্যাবএইড ওই শিক্ষকের পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে রেহাই পায়।
এর আগে বগুড়া মেডিক্যাল কলেজে একজন মরণাপন্ন রোগীর অ্যাটেন্ড্যান্ট ছেলে এক তরুণী ইন্টার্নি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপা ফ্যানের সুইচটি কোথায়?’ এতে ওই ইন্টার্নির শ্লীলতার বিশাল সর্বনাশ হয়ে যায়। কারণ নাকি হাসপাতালের মহিলা ইন্টার্নিকে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করতে হয়। ‘আপা’ সম্বোধন করা হয় সাধারণত নার্সদের। ছেলেটির তা জানা ছিল না। ইন্টার্নি ডাক্তারণী ছেলেটিকে সংশোধন করে দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি তার সহকর্মী ইন্টার্নিদের ডেকে এনে ছেলেটিকে রামধোলাই দেন। তাতে ছেলেটির অবস্থাও মরণাপন্ন হয়ে পড়ে। হাসপাতাল ভাঙচুর করা বা ইন্টার্নি ডাক্তারদের গণধোলাই দেয়ার ক্ষমতা ওই ছেলেটির ছিল না। ফলে সে ও মৃত্যুর মুখে পড়ে থাকে। ইতোমধ্যে তার বাবার মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ ঘটনায় কয়েকজন ইন্টার্নি ডাক্তারের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেন। কিন্তু না! নাসিম সাহেব কিছুই করতে পারলেন না। কিংবা করতে চাইলেন না। সারা দেশের সব হাসপাতালে ইন্টার্নি ডাক্তাররা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একযোগে ধর্মঘট শুরু করে দিলেন। আর নাসিম সাহেব সুড়সুড় করে এই মাস্তানিকে সমর্থন করে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া ব্যবস্থা প্রত্যাহার করে নিলেন। অর্থাৎ এই মর্মে লাইসেন্স দেয়া হলো যে, এসব উঠতি ডাক্তার মানুষ হত্যা করতে পারবেন।
এসব উঠতি নবীন ডাক্তার আর প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মধ্যে পার্থক্য কী থাকল? পার্থক্য শূন্য। ইন্টার্নি ডাক্তার আর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার- উভয়েই তাদের দাবি আদায় করার জন্য অসহায় আর নিরুপায় রোগীদের জিম্মি করে বসলেন। বাংলাদেশের বহু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন, যারা আন্তর্জাতিক মানের। বাংলাদেশের রোগীরা সাধারণত চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ভারতের ডাক্তারেরাও অনেক সময় বাংলাদেশী রোগীদের বলে থাকেন, এই চিকিৎসার জন্য তার কাছে যাওয়ার দরকার ছিল না। বাংলাদেশের অমুক চিকিৎসার জন্য অমুক ডাক্তারর কাছে যাওয়াই যথেষ্ট ছিল। এটা আমাদের জন্য গর্বের। এই সত্য আমরা অস্বীকার করি না। এখানে আছেন অত্যন্ত দক্ষ আন্তর্জাতিক মানের ডাক্তার, সার্জন। বাইপাস থেকে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যাট সব কাজেই তাদের দক্ষতা প্রশংসিত। কিন্তু ধর্মঘটের মতো যে কাজ তারা করলেন, তা কি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য? সে ক্ষেত্রে ওই ইন্টার্নিদের সঙ্গে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পার্থক্য কী থাকল? কার্যত থাকল না। উভয় দলই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিল।
কিন্তু কী অর্জন তারা করলেন বা কী অর্জন তারা করতে চেয়েছিলেন? বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা তাদের নিরাপত্তা ও হাসপাতালের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তারা নিশ্চিত জানতেন যে, এক বিকালের ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে তাদের সে দাবি আদায় হবে না। কোথায়ও কুটোটিও নড়বে না। নড়েওনি। মাঝখান থেকে সাধারণ রোগীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হলেন। সঙ্কটটা বোধকরি এখানেই। সাম্প্রতিক সময়ে দুনিয়ার কোথায়ও এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানা নেই। দুনিয়াজুড়ে ডাক্তারেরা রোগীকে অর্ধেক ভালো করে তোলেন তাদের অমায়িক ব্যবহার দিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ ডাক্তার যেন রোগীদের কথা শুনতেই চান না। তাদের সঙ্গে খুব একটা কথাও বলতে চান না। ঝটপট ওষুধ টেস্ট লিখে পরের রোগীকে ডাক দেন। অথচ রোগীর অনেক কথা বলার ছিল, বলা হলো না। এক চরম অতৃপ্তি নিয়ে রোগী ফিরে আসেন ডাক্তারের চেম্বার থেকে। টেস্ট ডাক্তারই দেন। কিন্তু সেই টেস্ট রিপোর্ট ওই ডাক্তারকে দেখাতেও আবার পয়সা দিতে হয়। কেন?
এখন জীবন-সায়াহ্ন। নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত আছি। আমি সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে অনলাইনে যোগাযোগ করলাম। তিনি লিখলেন, কেন এত টাকা খরচ করে আসবে, কেন আমাকে পয়সা দেবে? তার চেয়ে তোমার প্যাথলজি রিপোর্টগুলো আমাকে পাঠাও। আর যেসব ওষুধ খাচ্ছ, জেনেরিক নামে সেগুলোর বিবরণ পাঠাও। পাঠালাম। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আমাকে জানালেন, তোমার আসার দরকার নেই। ওষুধগুলো ঠিক আছে। তিনি শুধু এদিক- ওদিক করে দিলেন। কয়েক দিনের জন্য নতুন দু’টি ওষুধ লিখে দিয়ে আমার সুস্বাস্থ্য কামনা করলেন। অথচ এই প্রেসক্রিপশন করেছেন ঢাকারই একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। শুধু সিঙ্গাপুরই বা বলি কেন, ঢাকার একজন সহকারী অধ্যাপক লেভেলের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম আমার লিভারের কোনো সমস্যা আছে কি না, দেখাতে। তার দরজার সামনে লেখা ভিজিট ১০০০ টাকা। তিনি কতকগুলো টেস্ট দিলেন। জানতে চাইলাম, এসব টেস্ট রিপোর্ট দেখাতে কবে আসব? তিনি বললেন, আবার আসবেন কেন। টেস্ট রিপোর্টগুলো ইমো বা ভাইবারে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। সেগুলো দেখে আপনাকে জানাব, কবে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, নাকি দেখা না করলেও চলবে। রিপোর্টগুলো পাঠানোর পরদিনই তিনি খুদে বার্তা দিয়ে আমাকে জানালেন, ‘আপনার লিভারের কোনো সমস্যা নেই। ভালো থাকুন।’ আমি চিত্রটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম মাত্র।
তবে সেন্ট্রাল হাসপাতাল নিয়ে আমার অভিযোগ আছে। গোটা চিকিৎসক সমাজকেই সেটা ভেবে দেখতে হবে। বেশ কয়েক বছর আগে ঈদের সময় বিকেলে আমার অধ্যাপিকা স্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া মেয়ে শপিং করতে গিয়েছিলেন ধানমণ্ডি ৬ নম্বর রেডের আহছানিয়া তাঁত মিশনে। কিন্তু রিকশা থেকে নামতেই সেখানে তাদের আক্রমণ করে বসে তিন ছিনতাইকারী। ছিনতাই করতে না পেরে তারা আমার স্ত্রীর পেট বরাবর চাকু দিয়ে পোচ দিয়ে পেট ফাঁক করে দেয়। আর সেখান থেকে অবিরাম রক্ত ঝরতে থাকে। ওরা আমাকে ফোন করলে সব চেয়ে কাছের সেন্ট্রাল হাসপাতালে যেতে বলি। ওরা সেন্ট্রাল হাসপাতালে যান। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার স্ত্রীকে কোনো রকম সেবা না দিয়ে নানা রকম গড়িমসি করতে থাকেন। আমি তখন সরকারের সিনিয়র মোস্ট অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কাজ করি। ওরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আমার পরিচয়ও দেন। কিন্তু তারা এতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি। আমার স্ত্রী শাড়ি ছিঁড়ে ক্ষত জায়গা শক্ত করে বেঁধে রক্তপাত থামাবার চেষ্টা করছিলেন। আমার ফোনও কেউ ধরছিল না। আমার অফিস ছিল সার্কিট হাইজ রোডে। ঈদের বাজার। ইতোমধ্যে ঘণ্টা দেড়েক কেটে গেছে। আমি সেন্ট্রাল হাসপাতালে পৌঁছলাম আরো এক ঘণ্টা পর। রিসিপশনে জিজ্ঞেস করলাম, কেনো রোগী আনঅ্যাটেনডেন্ট পড়ে আছেন? তারা জবাব দিলেন, ডাক্তার নেই। ডাক্তার কখন আসবেন? তারা জানালেন, খবর দেয়া হয়েছে। তারপর যার সঙ্গেই কথা বলতে যাই, সেই এড়িয়ে যায়। আমি চিৎকার করে বললাম, ডাক্তারকে এখনই ডাকেন। ডাকল কী ডাকল না, জানি না। আমার রোগীর রক্তপাত হয়েই যাচ্ছে। আমি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের পরিচালককে ফোন করলাম। তিনি বললেন, ট্রান্সপোর্ট থাকলে এখনই চলে আসুন। আমি আরো এক ঘণ্টা ধরে জ্যাম ঠেলে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে পৌঁছলাম। তারা আমার স্ত্রীর পেটে সেলাই করে দিয়ে রক্ত বন্ধ করে দিলেন। আমার হাতে সরকারি ক্ষমতা ছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল। আমি যদি সে দিন সেন্ট্রাল হাসপাতাল তচনছ করে দিতাম, তা হলে আমাকে কি কোনো দোষ দেয়া যেত? সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জবাব কী? এই মানের সেবার হাসপাতালের জন্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা আন্দোলন করছেন?
নচিকেতার গান শুনছিলাম : ‘ও ডাক্তার, ও ডাক্তার, ও ডাক্তার/তুমি কত শত পাস করে এসেছ বিলেত ঘুরে/মানুষের যন্ত্রণা ভোলাতে।/ও ডাক্তার, ও ডাক্তার,/তোমার এমবিবিএস মামা বোধহয় এফআরসিএস ডিগ্রি ঝোলাতো/ও ডাক্তার, ও ডাক্তার,/ডাক্তার মানে সে তো মানুষ নয়/ আমাদের চোখে সে তো ভগবান।/কসাই আর ডাক্তার একই তো নয়,/ কিন্তু দুটোই আজ প্রফেশন।/কসাই জবাই করে বোকা সচিবালোকে? তোমার আছে ক্লিনিক আর চেম্বার।/ ও ডাক্তার, ও ডাক্তার।/ ডাক্তার চাইবেন রক্ত রিপোর্ট,/ ক্লিনিকের সন্ধানও তিনিই দেবেন।/এক শত টাকা যদি ক্লিনিকের বিল হয়, অর্ধেক দালালি তিনিই নিবেন।/রোগীরা তো রোগী নয়, খদ্দের এখন।/ খদ্দের পাঠালেই কমিশন।/ ক্লিনিক আর ডাক্তার কি ঠুলি পরাচ্ছে,/ বুঝছে না গর্দভ জনগণ।/ কসাই জবাই করে প্রকাশ্য দিবালোকে,/ ওদের আছে ক্লিনিক আর চেম্বার/ ও ডাক্তার, ও ডাক্তার।/ নিজেদের ডাক্তার বলো কেনো, তার চেয়ে বলো ব্ল্যাকমেলার,/রোগীর আত্মীয়দের ঘটিবাটি চাটি করে করো সুযোগের সদ্ব্যবহার।/সরকারি হাসপাতালের পরিবেশ, আসলে তো তোমরাই করেছ শেষ।/হাসপাতাল না থাকলেই জনগণ/নার্সিং হোমে যাবে অবশেষ,/সেখানে জবাই হবে উপরি কামাই হবে মানুষের সেবার কী দরকার,/ ও ডাক্তার, ও ডাক্তার।/বাঁচানোর ক্ষমতা তো তোমারই হাতে/ তুমি যদি মারো তবে কোথা যাই।/অসহায় মানুষের তুমিই তো সব কিছু/ করজোড়ে নিবেদন করছি তাই/ তোমার গৃহিণী যে গয়না পরেন, দেখেছ কি তাতে কত রক্ত?/ তোমার ছেলের চোখে দেখেছ কি কত ঘৃণা জমা অব্যক্ত?/ তোমারও অসুখ হবে, তোমারই দেখানো পথে যদি তোমাকেই দেখে কোনো ডাক্তার?/ও ডাক্তার, ও ডাক্তার, ও ডাক্তার, ও ডাক্তার....’ (ইউটিউব/ নচিকেতা/ও ডাক্তার)
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন