সমাজের পরিকাঠামো যে গতিতে পরিবর্তিত হয়, উপরি কাঠামোর পরিবর্তন সে গতিতে হয় না। এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করি পুঁজিবাদী সমাজেও সামন্তবাদী সমাজের ভাবধারা, বিশ্বাস, সংস্কার এবং সভ্যতাবিবর্জিত আচরণ অব্যাহত থাকে। আমাদের সমাজেও অনেক ভয়াবহ কুসংস্কার ছিল এবং এখনও অব্যাহত আছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। সতীদাহ প্রথার মূল বৈশিষ্ট্য হল স্বামীর মৃত্যু হলে হিন্দু নারীকে সহমরণের জন্য স্বামীর সঙ্গে একই চিতায় আরোহণ করতে হবে। ১৮৩২ সালে প্রিভিকাউন্সিল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অথচ তখনও এ বীভৎস প্রথার পক্ষে অনেকেই সাফাই গেয়েছিলেন। ০৫-০৫-১৮৩১ সালে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘সতীর বিপক্ষে যে যে মহাশয়রা সর্ব্বদা প্রকাশ্যপত্রে নানা প্রকার লিপি লিখিয়া থাকেন অর্থাৎ সতীর বিপক্ষ আইন হওয়াতে অনেক স্ত্রীর প্রাণ রক্ষা হইল, ইহাতে মহোপকার হইয়াছে তাঁহারা কেবল ইহাই লিখিতে পারেন ভরাডুবি হইয়া একেবারে কতকগুলিন লোকের প্রাণবিয়োগ হয় তাহা কী তাঁহারা কর্ণে শুনিতে পান না অতএব তাঁহারদিগের উচিত হয় এ বিষয়ের নিমিত্ত গভর্নমেন্টে প্রার্থনা করেন যাহাতে লোকের মহোপকার ও ধর্ম্ম হইবেক- কী খেদের বিষয় সাধারণের হিতাহিত বিষয়ে উক্ত লেখক মহাশয়রা কী মনে করিয়াছেন হিন্দুর শ্রীশ্রী দুর্গোৎসবাদি দেবার্চ্চনা এবং পিত্রাদির শ্রাদ্ধতর্পণাদি ধর্মকর্ম উঠিয়া গেলেই লোকের উপকার থাকাতে অনুপকার ইত্যাদি লেখা তাঁহারদিগের উচিত নয় এবং লিখিয়াও কিছু করিতে পারিবেন না...।’ একইভাবে A B rahmun 07-12-1829 সালে বেঙ্গল হরকরা অ্যান্ড প্রণিকল লিখেছেন, I will therefore venture to assert that if ‡ovt. persists in the abolition, the natives, particularly of the lower class will not be satisfied by making virtue of necessity, but will find means, However late it may be from their present almost helpless state, to shwo that they are not to be trampled upon with impunity...’। সমাচার দর্পণ পত্রিকায় ১৪-১১-১৮৩২ সালে লেখা হয়েছিল, ‘আমরা মহ খেদে ও মনস্তাপে তাপিত ও ভাবিত এবং উদ্বেগসাগরে মগ্ন হইয়া নয়ননীড়ে ভাসিতে ২ সতীর অশুভ সংবাদ প্রকাশ করিতেছি ইহাতে পাঠকবর্গ মধ্যে হিন্দু ধর্ম্মপরায়ণ মহাশয়দিগের মর্মবেদনা অন্তরযাতনা অত্যন্তই হইবেক ইহা নিশ্চয় জানিয়াও অশুভ সম্বাদ প্রকাশকরণে বাধিত হইলাম যেহেতুক সম্বাদপত্রের নিয়মই এই শুভাশুভ সকলি প্রকাশ করিতে হয়।’
সতীদাহের মতো মর্মান্তিক প্রথার প্রতি শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও যে সমর্থন থাকতে পারে তা আমরা বুঝতে পারি সংবাদপত্রে লেখা এদের মতামত থেকে। ইংরেজ শাসকরা এই প্রথাকে অত্যন্ত বর্বর ও সভ্যতাবিরোধী মনে করেই এর বিরুদ্ধে আইন করেছিল। সতীদাহ সম্পর্কে হৃদয়বিদারক চিত্র আমরা দেখতে পাই প্রমথনাথ বিশীর লেখা ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস কেরি সাহেবের মুন্সী থেকে। এই উপন্যাসের রেশমি চরিত্রটি যাদের এখনও স্মৃতিপটে জাগরূক আছে, তাদের পক্ষে অশ্রু সংবরণ করা কঠিন। বহুকাল ধরেই হিন্দুস্তানে এই অশুভ প্রথা প্রচলিত ছিল। বিনয় ঘোষ ফরাসি পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের Travels in the Mogul Empire (1656-1668 A. D.) অবলম্বনে ‘বাদশাহী আমল’ গ্রন্থটি রচনা করেছেন। এই গ্রন্থ থেকেও জানা যায়, মোগল শাসকরা সতীদাহ প্রথাকে নিরুৎসাহিত করেছেন, কিন্তু উচ্ছেদ করতে পারেনি। বার্নিয়ের লিখেছেন, ‘সতীদাহ ও সহ-মরণ প্রথা সম্বন্ধে অনেক পর্যটক অনেক কথা বলেছেন। নতুন কিছু বলবার নেই। অনেকে অবশ্য সতীদাহের যথেষ্ট অতিরঞ্জিত বিবরণও দিয়েছেন। ক্রমেই সতীদাহের সংখ্যা কমে আসছে মনে হয় এবং আগের তুলনায় এখন অনেক কমে গেছে। মুসলমান রাজত্বকালে মুসলমান বাদশাহরা নানাভাবে হিন্দুদের সহমরণ প্রথা নিবারণ করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কখনও কোনোদিন তারা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করেননি এবং প্রত্যক্ষভাবে বিধিনিষেধ জারি করে সতীদাহ বন্ধ করার চেষ্টা করেননি। নানারকম কৌশলে তারা এই অমানবিক দাহ বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন। প্রাদেশিক গভর্নর বা সুবাদারের অনুমতি ছাড়া কেউ সহমরণ করতে পারবেন না বলে আদেশ জারি করে গিয়েছিলেন। সহমরণের জন্য সুবাদারের অনুমতি নিতে হবে এবং তার কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদন করলে সুবাদার সহজে অনুমতি দিতেন না, নানাভাবে চেষ্টা করতেন আবেদনকারীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাঁচাবার জন্য। নানা রকম যুক্তি দিয়ে আশার কথা বলে সুবাদার নিজে যখন ব্যর্থ হতেন, তখন তিনি সহমরণ প্রার্থিনীকে অন্দরমহলে মহিলাদের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। সুবাদারের পরিবারের মহিলারা তাকে নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করতেন। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে এবং বাইরে থেকে কোনো প্ররোচনা দেয়া হচ্ছে না বলে সুবাদারের বিশ্বাস হলে, তবে তিনি সহমরণের অনুমতি দিতেন। এত চেষ্টা সত্ত্বেও সহমৃত্যুর সংখ্যা হিন্দুস্তানে খুব বেশি বলা চলে।
সতীদাহ প্রথা এখনও ভারতের কোথাও প্রচলিত আছে কিনা সে সম্পর্কে বিশেষ কোনো সংবাদ পাওয়া যায় না। তবে ১৯৮৭ সালে ভারতের রাজস্থানে রূপ কানওয়ার নামক মহিলার সহমরণের কাহিনী সমগ্র ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ যুগেও এমনটি হতে পারে বলে অনেকে বিশ্বাস করতে চাননি। রূপ কানওয়ারের ট্র্যাজেডি আমাদের বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে একথাই বলে দেয়, শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক বিস্তৃতি সত্ত্বেও প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক অ-মানসিক কুসংস্কার আইন-কানুনের বাধা অতিক্রম করে টিকে থাকতে পারে। সমাজব্যবস্থা একটি অদ্ভুত সংস্থা।
ইংরেজ শাসনে সমাজ সংস্কারের আরেকটি বড় দৃষ্টান্ত হল হিন্দু সমাজের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রচলন। হিন্দু বিধবাদের বিবাহের পক্ষে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মানুষও গুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় নেমেছিলেন। কিন্তু এ জন্য তাকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়। সংবাদ প্রভাকর ১৯-১২-১৮৫৬ তারিখে লিখেছে, ‘খ্রীষ্টান মিসনরি সাহেবেরা যেমন হিন্দুজাতির, পারত্রিক অমঙ্গল অনুভূত করিয়া অতিশয় কাতর হইয়া তাহাদিগের নিস্তার নিমিত্ত সাতিশয় পরিশ্রম করিতেছেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সেই প্রকার বিধবাদিগের নিদারুণ যন্ত্রণা দর্শনে তাহারদিগের উপকারার্থ মিসনরি হইয়াছেন। আমরা তাহার দয়ালু স্বভাবের যথেষ্ট প্রশংসা করি, কিন্তু তিনি মিসনরি ভাব পরিত্যাগপূর্ব্বক অক্ষতজনি বিধবা বালাগণের পরিণয় সম্পাদানার্থ সাধারণরূপে সভা করিয়া সকলের সম্মতি গ্রহণ করিতে না পারিলে তাঁহার এই উদ্যোগ দ্বারা কোন উপকার দর্শিবেক না, হিন্দু বালকেরা মিসনরি মন্ত্রে দিক্ষিত হইলে যেরূপ স্বতন্ত্র শ্রেণীভুক্ত হয়, তাঁহার মতস্থেরাও সেইরূপ স্বতন্ত্র শ্রেণীমধ্যে গণ্য হইবেন।’ সুতরাং হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলনের কাজটি সহজসাধ্য ছিল না। পুরাতন সংস্কার ও সামাজিক রীতি পরিবর্তন করতে চাইলে বহুবিধ বাধা এসে উপস্থিত হয়। তবে বিশ্বায়নের ফলে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের যাতায়াত সুগম হওয়ার ফলে এখন মানুষের পক্ষে বোঝা অনেকটাই সহজ হয়ে গেছে যে, কিসে মানুষের মঙ্গল এবং কিসে মানুষের অমঙ্গল।
চীন দেশে এক সন্তান নীতি প্রবর্তনের ফলাফল চীনের জনগণ বহুলাংশে মেনে নিয়েছিল। এটি সম্ভব হয়েছিল এই কারণে যে, এক সন্তানধারী পরিবারগুলো রাষ্ট্র থেকে যেসব সুযোগ-সুবিধা পেত, সেসব সুযোগ-সুবিধা দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। অর্থাৎ একটি মাত্র সন্তান থাকলে পুরস্কৃত হওয়ার লাভ, একের অধিক সন্তান মানে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হওয়া। এ ছাড়া এক সন্তান নীতির পক্ষে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বিশাল সাংগঠনিক শক্তি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল। এত কিছুর মধ্যেও চীনের গণ্ডগ্রামে একাধিক সন্তানের জন্ম হতো। তবে একের অধিক সন্তান রাষ্ট্রীয় নিবন্ধন পেত না। ফলে চীনের জনসংখ্যার একটি অংশ অদৃশ্য থেকে গেছে। অন্যদিকে পুত্র সন্তানের প্রতি আগ্রহ থাকায় কন্যাসন্তানের ভ্রুণ হত্যার মতো অনৈতিক ঘটনাও ঘটেছে। সমাজে বড় ধরনের সংস্কার আনতে গেলে এরকম বিচ্ছিন্ন কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনাও ঘটতে পারে। বহু বছর ধরে এক সন্তান নীতি অনুসরণের পর জনমিতিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়ার ফলে এক সন্তান নীতির পরিবর্তে দুই সন্তান নীতিতে প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে চীন সরকার। মজার ব্যাপার হল, এখনকার চীনা মধ্যবিত্তরা অনেকেই এক সন্তান নীতির পক্ষে। কারণ চীনের জীবনযাত্রায় যে পরিবর্তন এসেছে, তার ফলে একের অধিক সন্তান গ্রহণ পছন্দনীয় থাকছে না। দুই সন্তান নীতিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য চীন সরকারকে প্রণোদনা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। সিঙ্গাপুরেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর নীতি প্রবর্তিত হয়েছিল। এর ফলে সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা বেশ ক’বছর ধরে এক ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিল।
বাংলাদেশের গ্রামীণসমাজ সম্পর্কে সত্তরের দশকে অর্থনীতিবিদ ও নৃ-তাত্ত্বিকরা অনেক গবেষণা করেছেন। সেই সময়কার গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, বিশেষ করে নৃ-তাত্ত্বিকরা যেসব গবেষণা করেছেন, সেগুলো থেকে জানা গেছে গ্রামীণ সমাজে সহিংসতার দুটি বড় উৎস হল জমি ও নারী। অথচ আমরা জানি, নারীর জীবনে পরিবর্তন আনতে না পারলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। উন্নয়নের স্বার্থেই বিবাহের বয়স বাড়িয়ে দিতে পারলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সহজ হবে। অল্প বয়সে নারীর সন্তানধারণ নারী ও সন্তান উভয়ের স্বাস্থ্যের জন্যই বিপজ্জনক। প্রসূতি মৃত্যু, মৃত সন্তানের জন্ম, উচ্চ শিশু মৃত্যু হার প্রভৃতি সমস্যার মূলে রয়েছে অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া। সে জন্যই আজ বিশ্বব্যাপী বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের পক্ষে দাবি উঠেছে। বাংলাদেশে আমরা যদি মেয়েদের ১৮ বছর বয়সে এবং ছেলেদের কমপক্ষে ২১ বছর বয়সে বিয়ে নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে উন্নয়নের পথে যেসব বড় রকমের বাধা রয়েছে তার কিছুটা হলেও অতিক্রম করতে পারব। এ ছাড়া নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়ানো হলে ফলদায়ক হবে। ১৮ বছর বয়সে একটি মেয়ের পক্ষে এইচএসসি পাস করা সম্ভব। একটি মেয়ে যদি এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে তাহলে সে মা হিসেবেও সফল মা হতে পারবে। নেপোলিয়ন একটি জাতির জন্য এরকম মা-ই চেয়েছিলেন। অন্যদিকে পুরুষ ছেলেদের জন্য বিয়ের বয়স কমপক্ষে ২১ হলে ছেলেটির পক্ষে বিএ বা বিএসসি পাস করা সম্ভব হয়। এটাও পারিবারিক উন্নয়নের জন্য কাম্য।
আমাদের দেশে জন্ম নিবন্ধনের কথা বলা হলেও বিজ্ঞানসম্মত জন্ম নিবন্ধনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ইউরোপের গির্জাগুলো মধ্যযুগ থেকে তার নিজস্ব এলাকায় জন্ম নিবন্ধন ও মৃত্যু তালিকাভুক্ত করার ব্যবস্থা নিয়েছিল। এর ফলে মধ্যযুগের ইউরোপের গ্রামীণ ইতিহাসের অনেক কাহিনী সংরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ফ্রান্সের ইতিহাসবিদ লিরয় লাদুরি গির্জার রেকর্ডপত্র ঘেঁটে মন্তাইলু গ্রামের ইতিহাস রচনা করেছেন। আমাদের দেশে মসজিদ কিংবা মন্দিরে কোথাও এই রীতি অনুসৃত হয় না। এরকম কোনো ব্যবস্থা যদি অতীতকাল থেকে থাকত তাহলে কারও বয়স সম্পর্কে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকত না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা ওয়ার্ড কাউন্সিলররা বয়সের যে সনদপত্র দেন তা তাদের প্রতি কোনো অশ্রদ্ধা না দেখিয়েই বলা যায়, ক্ষেত্রে বিশেষে সেগুলো সঠিক হয় না। বাল্যবিবাহ নিরোধের জন্য সরকার যে আইন তৈরি করেছে, সে অনুযায়ী বিবাহ নিশ্চিত করতে হলে জন্ম নিবন্ধন ব্যবস্থাকেও উন্নত ও বিজ্ঞানসম্মত করতে হবে। এ জন্য চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
খসড়া আইনের ১৮ নম্বর ধারার ৪ নম্বর উপ-ধারাটি যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। এই উপধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের সাধারণ কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ না করিয়া বিশেষ পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের পিতা-মাতার সম্মতি এবং আদালতের অনুমোদনক্রমে অন্যূন ১৮ (আঠারো) বৎসর বয়স্ক ছেলে ও অন্যূন ১৬ (ষোল) বৎসর বয়স্ক কন্যার সহিত বিবাহ অনুষ্ঠিত হইতে পারিবে। খসড়া আইনের এই ধারাটি দেখে মোগল সম্রাটদের সতীদাহ সংক্রান্ত নীতির কথাই মনে পড়ে। মোগল সম্রাটরা হিন্দুস্তানের হিন্দু প্রজাদের অনুসৃত রীতি-নীতিতে আঘাত করার অবস্থান গ্রহণ করেননি। সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে এরকম নীতি অনুমোদনযোগ্য হতে পারে। তবে এটা হবে সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা সবকিছু বিবেচনা করে এই বাল্যবিবাহ আইনটা করেছি। কিছু কিছু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এটা নিয়ে অনেক কথা বলছে। যারা কথা বলছেন, তারা কিন্তু একটানা দুই-চার বছর গ্রামে বসবাস করে নাই। এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নাই।’ সামাজিক পরিবর্তন একটি কঠিন বিষয়। বিশেষ করে আইনগত পরিবর্তন করার পর কিছু প্রতিরোধ দেখা দেয়। সমাজ প্রগতির বিরোধীরা এতে ইন্ধন জোগায়। অন্যদিকে এ কথাও সত্য, সমাজের অনেক রীতি-নীতি গ্রানাইড পাথরের চেয়েও কঠিন। তাই সমাজ পরিবর্তনের জন্য একদিকে যেমন যুগোপযোগী প্রণোদনা ও তিরস্কারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, অন্যদিকে তেমনি এমন একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যাতে জন্ম নিবন্ধনে কোনো রকম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া সম্ভব না হয়। আমাদের মেয়েরা কী ধরনের অসহায়ত্বের মধ্যে আছে তা বোঝা যায়, মাস্তান ছেলেদের দ্বারা মেয়েদের উত্ত্যক্ত হওয়ার ঘটনা দেখে। এসব ঘটনা থেকে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে যায়। অনেক সময় অসহায় মেয়ে সন্তানের পিতারা এসব কারণে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়। ইভটিজিংয়ের ঘটনার বিরুদ্ধে আইনের নি-িদ্র প্রয়োগ সম্ভব হলে ছেলেদের জন্য ২১ বছরে বিয়ে এবং মেয়েদের জন্য ১৮ বছরে বিয়ের আইন বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে না। এজন্য পারস্পরিক দোষারোপ না করে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এই একটি প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য হলে অন্যান্য প্রশ্নেও জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন