|
মাহবুব উল্লাহ
mahbub.ullah@yahoo.com |
|
সবকিছুই ঠিক থাকলে ঝুঁকিপ্রবণ কেন হচ্ছে মানুষ?
01 August 2017, Tuesday
একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখতে পাই পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যেখানে সে দেশের আদিবাসীরা ছাড়া ভিন্ন দেশের মানুষ নেই। অনেক দেশই পাওয়া যাবে যেখানে ভিন্ন কোনো দেশের অধিবাসীরা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছে। আমরা বাংলাদেশিরা একটি মিশ্র বা সংকর জাতি হিসেবে পরিচিত। আমাদের রক্তে একাধিক রেইসের (RACE) সংমিশ্রণ ঘটেছে। দুটি প্রধান রেইসের সংমিশ্রণে আমাদের জনগোষ্ঠী অর্থাৎ বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে। বাঙালিরা অস্ট্রো-মঙ্গোলিয়ড হিসেবে পরিচিত। জাতিতত্ত্ব বিশারদরা তেমন কথাই বলেন। একটি জাতির উৎপত্তি ও গঠন নিয়ে গবেষণা করাই জাতিতত্ত্ব বিশারদদের কাজ। এ গবেষণার জন্য আদিতে পরিসংখ্যান শাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল। পৃথিবীতে যে ক’টি প্রধান রেইস বিদ্যমান, তাদের চেহারায় স্পষ্ট ভিন্নতা ধরা পড়ে। এই ভিন্নতা পরিস্ফুট চোয়াল ও কপালের হাড়সহ শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাপে ভিন্নতা থেকে। ভিন্নতাকে পরিসংখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য করার জন্যই পরিসংখ্যানের গাণিতিক গড় ও পরিমিত ব্যবধান হিসাবের পদ্ধতির উদ্ভব ঘটে। অর্থাৎ একটি রেইসের চোয়ালের গড় মাপে একটি সাধারণ প্রবণতা থাকে। তা সত্ত্বেও একই রেইসভুক্ত মানুষের চোয়ালের মাপ সমান হয় না। এই সমতাহীনতা পরিমাপের জন্য উদ্ভব ঘটেছে পরিসংখ্যানের পরিমিত ব্যবধানের হিসাব পদ্ধতি। জাতিতত্ত্ববিদদের বক্তব্য হল, নির্দিষ্ট রেইসভুক্ত জাতির শরীরের কোনো হাড়ের গড় মাপ ও পরিমিত ব্যবধানে মূল বৈশিষ্ট্য হল পরিমিত ব্যবধান গড়ের খুব কাছাকাছি থাকবে। অবশ্য বেশ কিছু পরিসংখ্যানবিদের মতে ইংরেজি ‘এভারেজ’ শব্দটি গ্রিক ‘হাভারিয়া’ শব্দ থেকে এসেছে। প্রাচীনকালে সমুদ্রপথে যে বাণিজ্য হতো, সেই বাণিজ্যে অনেক সময় জাহাজগুলো বৈরী আবহাওয়ার সম্মুখীন হতো। এ রকম দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে জাহাজের ওজন হ্রাস করার জন্য কিছু পণ্যসামগ্রী সমুদ্রে ফেলে দেয়া হতো। একই জাহাজে একদল ব্যবসায়ীর মালামাল বহন করা হতো। যেসব ব্যবসায়ীর মালামাল সমুদ্রে ফেলে দেয়া হতো তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য অন্যদের লাভ থেকে গড় করে একটি অংশ হিসাব করা হতো। একেই বলে ‘হাভারিয়া’। যাই হোক, রেইসের পরিচয় নির্ণয়ে পরিসংখ্যান শাস্ত্রের গড় ও পরিমিত ব্যবধানের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।
বাঙালি জাতির প্রাচীন ইতিহাস থেকে জানা যায়, এদের একটি গোষ্ঠী ছিল অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী। এরা যে কোনো কারণেই হোক অতীতের কোনো এক সময়ে সমুদ্রে ভেলা ভাসিয়ে ভিয়েতনামে চলে আসে। ভিয়েতনাম থেকে আবার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে আসে শ্রীলংকায়। শ্রীলংকাতেও তারা পুরোপুরি থিতু হতে পারেনি। শ্রীলংকা থেকে তারা আবার পাড়ি জমালো বঙ্গদেশে। এ জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে উত্তর দিক থেকে আসা মঙ্গোলীয় জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে তৈরি হল অস্ট্রো-মঙ্গোলয়েড জাতি। অর্থাৎ আজকের বাঙালি। অস্ট্রোলিয়ডদের বঙ্গদেশে আসার পক্ষে যুক্তি হাজির করতে গিয়ে রুশ ভাষাবিদরা দেখিয়েছেন, বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত বেশকিছু শব্দ ভিয়েতনামের ‘আন্নামিজ’ ভাষার অনুরূপ। কৃষির অন্যতম হাতিয়ার ‘লাঙল’ শব্দটি আন্নামিজ ভাষাতেও ‘লাঙল’। এ তথ্য থেকে বোঝা যায় এখানে অস্ট্রোলয়েডরা বসতি গড়ার সময় জীবন ধারণের অন্যতম উপায় ছিল কৃষি। পশ্চিমবঙ্গের পান্ডু রাজার ঢিবি থেকে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কার করা হয়েছে, তার মধ্যে মাটির হাঁড়িতে রাখা ধান বা ধান বীজও আছে। এ নিদর্শনগুলোর বয়স ২০০০ বছরের কম হবে না।
বাঙালি জাতির আদি ইতিহাস সম্পর্কে যা কিছু বলা হল তা হয়তো অনেকটাই অনুমাননির্ভর। অন্য কোনো দেশ বা ভূখণ্ড থেকে আসেনি এমন আদিবাসী বাঙালিও এ দেশে ছিল। তবে জনসংখ্যার অধিকাংশ গঠিত হয়েছে অস্ট্রোলয়েড ও মঙ্গোলয়েডদের সংমিশ্রণের ফলে। পরবর্তীকালে আরব, ইরান, তুরান থেকেও এ দেশে অনেকে এসেছে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে অথবা ভাগ্যান্বেষণে। সবকিছুর মিলন ও মিশ্রণের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট ভাষা ও জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি।
হাল আমলে বাংলাদেশের বাঙালিরা পৃথিবীর অনেক দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। জাপান থেকে চিলি পর্যন্ত প্রায় সব দেশেই বাংলাদেশিদের দেখতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো দেশে বাংলাদেশিরা বিপুল সংখ্যায় অবস্থান করছে, আবার কোনো কোনো দেশে কম সংখ্যায়। ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বাংলাদেশি কমিউনিটির শক্ত অবস্থান রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যারা অন্য দেশে গিয়েছে তাদের একটি অংশ সে দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে সেদেশেই থেকে গেছে। ব্রিটেনে এরকম একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে গত প্রায় ১০০ বছর ধরে। এখন তো সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূতরা ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে। এসব কাহিনী বলার উদ্দেশ্য আমাদের এ পৃথিবীতে মাইগ্রেশন বহুকাল ধরে চলে আসছে। বিশ্বায়নের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ মাইগ্রেশন। সেই অর্থে বিশ্বায়ন গত শতাব্দী বা বর্তমান শতাব্দীর মধ্যে সীমিত নয়।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশিদের অন্য কোনো দেশে মাইগ্রেশন বছরের পর বছর ধরে বেড়ে চলেছে। সাধারণভাবে বাঙালিরা ঘরকুনো হিসেবেই পরিচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর বাংলাদেশি বাঙালিদের চরিত্রে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশিরা এখন আর ঘরকুনো নয়। যেমনটি এ জাতির সৃষ্টি পর্বেও ছিল না।
মাইগ্রেশন সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের একটি প্রিয় তত্ত্ব হল ‘পুশ অ্যান্ড পুল’ ফ্যাক্টর। কেউ যখন তার নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন দেশে কর্মসংস্থান না হওয়া কিংবা অন্য কোনো বৈরী পরিস্থিতির জন্যই এরকম সিদ্ধান্ত নেয়। আবার যে দেশে যাবে সে দেশে গিয়ে জীবনকে আরও সুখময় করার আকর্ষণও টানে। বাস্তবে দেখা যায় বিদেশে যাওয়ার সুখস্বপ্ন অনেক সময় সোনার হরিণের মতো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। অবৈধ পথে এবং অবৈধ উপায়ে বিদেশ গমন করতে গিয়ে অনেক বাংলাদেশিকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। আমরা জানি, ২০১৫ সালে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের একটি প্রদেশে, মালয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী জঙ্গলে বেশ কিছু গণকবর আবিষ্কৃত হয়। তখন সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের বিষয়টি নিয়ে বড় রকমের উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল। একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সংবাদ অনুুযায়ী ২০১৪-১৫ সালে এ পথে প্রায় ৯৩ হাজার বাংলাদেশি নাগরিক ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গেছে। তাদের অনেকে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, এমনকি মৃত্যুবরণ করেছে। ভাগ্যান্বেষণে বিদেশ গমন বহু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এরকম যাত্রা থেমে থাকেনি। বাংলাদেশিদের বিদেশ গমনে প্রচুর ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়, ব্যয় করতে হয় বিশাল অঙ্কের অর্থ। ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা একটি ইতিবাচক গুণ। তবে বাংলাদেশের অনেক গরিব মানুষ কিংবা আর্থিক অবস্থা সচ্ছলতর করার প্রয়াসীরা অনেক ক্ষেত্রে বেহিসাবি ঝুঁকি নিচ্ছে। ফলে অনেক পরিবারে নেমে আসছে বিশাল ট্র্যাজেডি। বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল বিশেষ করে আল জাজিরায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মাইগ্রেন্টদের মৃত্যু অথবা করুণ পরিণতির দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছে। এদের ৯৮ শতাংশ লিবিয়া হয়ে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে। এর আগে তাদের লিবিয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৯৩ হাজার ৪৩৫ বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (IOM) তথ্য অনুযায়ী, দেশত্যাগের কারণ হিসেবে পাওয়া গেছে ৬৩ শতাংশ অর্থনৈতিক, ১১ শতাংশ মৌলিক সেবার ঘাটতি, ৩২ শতাংশ মানবিক সেবার অভাব এবং ৩০ শতাংশ নির্যাতন। এর সবই পুশ ফ্যাক্টর।
বাংলাদেশি ইমিগ্রেন্টদের সম্পর্কে আইওএমের এ তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে মেনে নিতে হবে উন্নয়নের জোয়ারের বয়ান সঠিক নয়। এমনকি মানবাধিকারের ভালো পরিস্থিতির বয়ানও নয়। এখন জাতির সামনে চ্যালেঞ্জ হল বাংলাদেশিদের মারাত্মক ঝুঁকিগ্রহণ প্রবণতাকে অধিকতর ইতিবাচক কর্মের দিকে ধাবিত করা। নিঃসন্দেহে ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা অনেক জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে গেছে। সফল বিদেশ গমনকারীদের রেমিটেন্সের অর্থ দেশকে উপকৃত করছে, সন্দেহ নেই। তবে একদিকে যেমন বিদেশ গমনে সফলতা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যদিকে ঝুঁকি গ্রহণের মনমানসিকতাকে আরও অনেক বেশি ফলদায়কভাবে ব্যবহারের নীতি-কৌশল খুঁজে বের করতে হবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন