|
মাহবুব উল্লাহ
mahbub.ullah@yahoo.com |
|
৫৭ ধারা নিয়ে সরকার কী করবে?
03 August 2017, Thursday
বিদ্যমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের নিবর্তনমূলক ৫৭ ধারা নিয়ে সরকার কী করবে? এমন একটি প্রশ্ন সাম্প্রতিক সময়ে তীব্র হয়ে উঠেছে, অনেকেই এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করছেন এবং এর জবাব খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছেন না।
সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়েছে, ২৪ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে তথ্যমন্ত্রী এ ধারা বহাল রাখার পক্ষে তার মত পুনর্ব্যক্ত করেছেন। খবরে বলা হয়, ‘সরকারের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে ৫৭ ধারার বিষয়টি তোলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। বিদ্যমান আইসিটি আইনের এ ধারা নিয়ে দেশের সর্বত্র যে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে, সেটি তুলে ধরেন তিনি। এরপর একাধিক মন্ত্রী বলেন, ৫৭ ধারা নিয়ে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সাংবাদিকদের নামে এ ধারায় মামলা হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। এ সম্পর্কে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। না হলে সমস্যা বাড়বে। মন্ত্রীদের এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তথ্যমন্ত্রী ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ধারাটির পক্ষেই বক্তব্য দেন। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সারবস্তু সেই আগের মতোই- ৫৭ ধারা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রণীত হয়নি। এটি গণমাধ্যমের বিষয় নয়। সাংবাদিকতার জন্য কারও বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়নি। মামলা হয়েছে সাইবার অপরাধের অভিযোগে। এটা সব নাগরিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।’ সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়, বৈঠকে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করেননি।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকেই এ ধারা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন। রাজনৈতিক গতিধারা সম্পর্কে সচেতন হলেই এমন প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। ৫৭ ধারার অধীনে প্রায়ই মামলা হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষক সহকর্মী অপর এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে এ আইনের অধীনে মামলা করেছিলেন। অথচ এ বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং বলছেন। কয়েকদিন আগে, হবিগঞ্জের এক সাংবাদিককে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্য এক সাংবাদিকের খবর নকল করার অপরাধে। সেই নকলে চরিত্রহনন ছিল না, অভিযোগকারী লেখার শিরোনামের মানে ও বিষয়বস্তুর অর্থ বুঝতে পারেননি বলে কথা উঠেছে। যিনি মামলা করেছিলেন তিনি একজন সংসদ সদস্য।
এ মামলাবাজির ব্যাপারে অবশ্য সংসদ সদস্যের অনুসারীরাও কম যান না। অতি সম্প্রতি পিরোজপুর ও ময়মনসিংহে দুটি মামলা হয়েছে একই আইনে। একটি হয়েছে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়, অন্যটি ময়মনসিংহের নান্দাইলে। পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজীকে নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় রাজপাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বশির হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অবশ্য এর আগেও রুস্তম আলী ফরাজীকে নিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করায় এক সাংবাদিক ও এক আওয়ামী যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ময়মনসিংহের নান্দাইলের সংসদ সদস্য মো. আনোয়ারুল আবেদিন খানের বিরুদ্ধে ফেসবুকে নেতিবাচক প্রচারণার দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন মো. মনোয়ার হোসেন ওরফে মন্টু খান। সাম্প্রতিক সময়ে এক উদ্ভট প্রবণতা হচ্ছে, একজনের মানহানি হয়েছে এ অভিযোগে মামলা করছেন কাছের অথবা দূরের কোনো অনুসারী বা সমর্থক। এটা কৌশলগত কিনা তা অবশ্য কেউ জানে না। দেখা গেছে, আদালতও এসব মামলা গ্রহণ করছেন।
আলোচিত ধারাটি আইনে এমনভাবে লেখা হয়েছে যা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ আছে। পৃথিবীর সব দেশেই নৈতিকতার সঙ্গে গণমাধ্যম আইনের একটা বিরোধ থাকে; কিন্তু সেটা বোধ করি বাংলাদেশের মতো এত নোংরা নয়। ৫৭ ধারায় বলা হচ্ছে, ‘যদি কেউ ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এ কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ এ ধারায় এমন সব বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে যা সভ্যতার শুরু থেকেই বিতর্কিত। যেমন বলা হয়েছে নীতির কথা, সততার কথা, অশ্লীলতার কথা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে? সমাজে যে নীতিভ্রষ্টতা ও অসততা বিরাজমান সে কথা উচ্চারণে যদি জেলে যেতে হয়, অর্থদণ্ড দিতে হয় তাহলে এটা স্পষ্ট যে, ওইসব কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়ার জন্যই এ ব্যবস্থা। নৈতিকতার আলোচনা এত ব্যাপক ও বিতর্কিত যে, এ বিষয়ে ক্ষুদ্র একটি লেখায় সব কিছু আলোচনা করা যাবে না। বিভিন্ন ধর্মে যেসব নৈতিক বিধানের কথা বলা আছে, সেসব বিধান কি ওইসব ধর্মের বিশ্বাসীরা মেনে চলেন? নিঃসন্দেহে জবাব হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে সমাজের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। পড়া, দেখা বা শোনার খারাপ প্রভাব যদি এতই প্রবল হতো, তাহলে পৃথিবীতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হতো না, পৃথিবী এগিয়ে যেত না। একসময় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীকে নিগ্রহের শিকার হতে হতো। এখন কি আর সেটি প্রযোজ্য? আপনি ইলেকট্রনিক বিন্যাসের কথা বলেছেন; কিন্তু বিভিন্ন মুদ্রণ মাধ্যমে প্রতিদিন যেসব অসত্য প্রকাশিত বা প্রচারিত হয়, তার জন্য কি কেউ দায় নেবে?
শ্লীল-অশ্লীলের মাঝেও সীমারেখা টানা অত্যন্ত কঠিন। যারা কাঁটা চামচ দিয়ে খায় তাদের কাছে হাত দিয়ে খাওয়াটা অশ্লীল ব্যাপার। একসময়ের চেটেপুটে খাওয়ার বিষয়টিও এখন অনেকের কাছে অশ্লীল ব্যাপার। লুঙ্গি পরে বাইরে যাওয়াও অনেকের কাছে অশ্লীল ব্যাপার। শ্লীলতা-অশ্লীলতার সীমানা সমাজে নির্ধারিত হয় শ্রেণীভেদে। ছাত্রছাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে সংবর্ধনা নেয়া বা তাদের পিঠে চড়ে নৃত্য করার দৃশ্য যদি কেউ অশ্লীল বিবেচনা করেন তাহলে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি মামলা করবেনই। তিনি বলতে পারবেন এতে তার সম্মানহানি হয়েছে। কিন্তু তার ভয়টা সম্মানহানির নয়। তিনি জানেন, ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এসব দুষ্কর্মের খবর যত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে অন্য মাধ্যমে সেটি হয় না। ভয়টা এখানেই।
আইনে যেসব বিষয়ে শাস্তিযোগ্য ধারা প্রয়োগ হবে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কে নেবে? আদালত কি এসব প্রশ্নে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পারেন? পারেন না এবং একই প্রশ্নে একই আদালতে দু’বার দু’ধরনের সিদ্ধান্তের অনেক উদাহরণ এদেশেও আছে।
মন্ত্রী বলেন, এ আইনটি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয় না। অথচ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ থেকে এ আইনে তাদের ৯ জন সদস্য এবং সেই সঙ্গে আরও ৭ জনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা দেয়া হয়েছে। গত বছর এ ধারায় মামলা হয়েছে ৩৬টি, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এ সংখ্যা ২৪।
এ আইন প্রয়োগ করে একটি অনৈতিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার কতখানি লাভবান হবে? হয়তো অনলাইন নিউজ পোর্টালের প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়ে তার সম্পাদক ও অন্যান্য সাংবাদিককে ধরে নেয়া যাবে। কিন্তু এর বাইরে সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করবেন কীভাবে? তাহলে তো ফেসবুক বা অন্যান্য মাধ্যম বন্ধ করে দিতে হবে। সেটি যে সমাধান নয় তা আগেই বোঝা গেছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা আছে, যেভাবে বিশেষ ক্ষমতা আইন বলবৎ আছে, তারপর এমন একটি আইনের প্রয়োজন নেই। আশ্বাস দেয়া হচ্ছে, এ ধারার বদলে যে নিরাপত্তা আইন হচ্ছে তাতে স্বস্তি মিলবে। সেখানে হয়তো শাস্তির ক্ষেত্রে হেরফের হবে; কিন্তু মূল বিতর্ক অমীমাংসিতই থেকে যাবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সরকার ও ব্যক্তি সম্পর্কে যে আলোচনা হয় তা ক্ষমতাসীনরা সহ্য করতে পারেন না। তারা এটা ভুলে যান, আইন দিয়ে কণ্ঠরোধ করা যায়; কিন্তু মানুষের মনের ভেতর যে ক্ষোভ থাকে তাকে বন্দি করা যায় না। তারা এটাও ভুলে যায়, আইন প্রয়োগ করে সত্যকে মিথ্যা বানানো যায় না।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ থেকে ৩০০ সালে চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে রচিত বলে বিবেচিত অর্থশাস্ত্রে চাণক্য শাসনের প্রয়োজনে গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে শাস্তির কথা বলেছেন। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। সরকারবিরোধী সব খবরই গুজব।
মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন