|
মাহবুব উল্লাহ
mahbub.ullah@yahoo.com |
|
বাংলাদেশ কখনই ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ ছিল না
24 August 2017, Thursday
এ দেশে অনেকেই সামরিক শাসনকে Banana Republic-এর সমার্থক বলে ভাবেন। একাডেমিক বিশ্লেষণে কখনও কখনও এ দুটি সমার্থক না-ও হতে পারে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই সামরিক শাসন চলছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিসরে জামাল আবদুল নাসেরের শাসন, ১৯৫৮-এর জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইরাকে ব্রিগেডিয়ার করিম কাসেমের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান এবং রাজতন্ত্রের অবসান, লিবিয়ায় মোয়াম্মার গাদ্দাফির নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান এবং রাজা ইদ্রিসের শাসনের অবসান। এ ছাড়াও প্রায় একই ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল আফ্রিকার কোনো কোনো দেশে। চরিত্রগতভাবে এসব শাসকগোষ্ঠী ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসের নীল নদের ওপর আসোয়ান বাঁধ নির্মাণের জন্য মার্কিন সাহায্যপ্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু মার্কিনিরা নাসেরের আবেদনে সাড়া দেয়নি। এ কারণে নাসের সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে আসোয়ান বাঁধ নির্মাণের বিরাট কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেন। ইরাকে অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে করিম কাসেম বাগদাদ প্যাক্টের অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন। ফলে পাকিস্তান, ইরান, ইরাক ও তুরস্ককে নিয়ে গঠিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটটি সংকটের মুখোমুখি হয়। পরে ইরাককে বাদ দিয়েই এই জোট ‘সেন্টো’ নামে পুনর্গঠিত হয়। লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফি দেশের তেল সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি কল্যাণমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এ ধরনের শাসনব্যবস্থার ফিরিস্তি আরও দীর্ঘ করা যায়। এর প্রয়োজন নেই। এসব শাসক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে এবং জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে এসব দেশ উপনিবেশবাদের অধীন অনেক দেশের মুক্তি সংগ্রামেও সাহায্য-সমর্থন জোগায়। তবে এটা সত্য, এসব দেশের শাসকরা নিজ নিজ দেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র চালু করেননি, বরং এক ধরনের একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এ ব্যবস্থা কখনও কখনও চরম নিষ্ঠুরতায় পরিণত হয়েছিল। এসব সত্ত্বেও এ দেশগুলোকে বিশ্বপ্রগতির আন্দোলনের সহযোগী মনে করা হতো। মাইকেল কালেস্কির তত্ত্ব অনুযায়ী এগুলোকে বলা হতো ইন্টারমিডিয়েট রিজিম। অর্থাৎ দেশগুলো রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথে ছিল। এ দেশগুলো সম্পর্কে বামপন্থী মহলে বেশ উৎসাহ লক্ষ্য করা যেত।
পূর্বোক্ত দেশগুলোর বাইরে অনেক দেশে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ষড়যন্ত্রে সামরিক শাসকরা ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। সামরিক শাসন ছড়াও রাজতন্ত্রকে পাকাপোক্ত করা হয়েছিল। তেলসমৃদ্ধ ইরানের তেল নিয়ন্ত্রণ করত অ্যাংলো আমেরিকান অয়েল কোম্পানি। ইরানে ছিল রেজা শাহ পাহলবির রাজতান্ত্রিক শাসন। ১৯৫৩ সালে জনাব মোসাদ্দেক ইরানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। শাহ দেশ ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে পালিয়ে যান। কিন্তু সিআইএ হারানো স্বর্গ উদ্ধারের জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত মোসাদ্দেক সরকারের পতন হয় এবং রেজা শাহ পাহলবি ইরানের শাসন ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হন। সিআইএর ষড়যন্ত্রের জাল পৃথিবীর অনেক দেশেই বিস্তৃত হয় এবং এ ষড়যন্ত্রের ফলে এসব দেশে মার্কিন স্ট্র্যাটেজি ও নয়া উপনিবেশবাদী শোষণের কব্জা মজবুত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব দেশ সামরিক শাসকদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। এসব দেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি মূলত মার্কিন স্বার্থেই পরিচালিত হতো। এ ব্যাপারে ল্যাটিন আমেরিকা ও সেন্ট্রাল আমেরিকার দেশগুলো ছিল মারাত্মক ভুক্তভোগী।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে সামরিক শাসন হয়ে উঠল ঠাণ্ডা যুদ্ধের একটি পরোক্ষ পরিণতি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় পরাশক্তি নিজ প্রভাববলয় বিস্তারের জন্য সামরিক শাসকদের বেছে নিতে কুণ্ঠাবোধ করত না। প্রায়ই নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই থাকত না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিশাল উন্নয়ন ঘটানো সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসকদের উৎসাহ দিতে কোনোরকম লজ্জাবোধ করত না। দুনিয়ার দেশে দেশে সিআইএর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক অনুসন্ধানী গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এগুলোর বেশিরভাগেরই লেখক মার্কিনি। তবে ষাটের দশকে যে গ্রন্থটি বহুলভাবে পঠিত হতো, সেটি হল CIA: The Invisible Government. ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু মাহমুদ এই গ্রন্থটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সিআইএর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ছাত্রসমাজকে সেমিনার ও আলোচনা সভার মাধ্যমে সচেতন করতেন। ড. আবু মাহমুদ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলেন।
এখন Banana Republic বা কদলি প্রজাতন্ত্র সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। Banana Republicগুলো ছিল রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল। এসব দেশের অর্থনীতি ছিল মুষ্টিমেয় সম্পদপণ্য রফতানির ওপর নির্ভরশীল। যেমন- কলা ও খনিজসম্পদ ইত্যাদি। আমরা জানি, উপনিবেশবাদীরা কোনো উপনিবেশের শিল্পায়ন হতে দিত না। তবে এসব দেশের খনিজসম্পদসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ এবং কলা, চা, কফি, কোকোর বাগান ইত্যাদি তৈরি করে একচেটিয়াভাবে এসব সম্পদ লুণ্ঠন করত। কার্যত কদলি প্রজাতন্ত্রে সমাজবিন্যাস বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীতে স্তরিভূত। দেশের জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ গরিব মেহনতি শ্রেণীভুক্ত। দেশ শাসিত হয় মুষ্টিমেয় ধনিকতন্ত্রভুক্ত শাসক ব্যক্তিদের দ্বারা। এদের মধ্যে থাকে ব্যবসায়ী, রাজনীতিক এবং সামরিক এলিটরা। এ গোষ্ঠীতন্ত্র অর্থনীতির প্রাথমিক খাত নিয়ন্ত্রণ করে শ্রম শোষণের মাধ্যমে। তাই পরিভাষা হিসেবে Banana Republic বা কদলি প্রজাতন্ত্র ধারণাটি নিন্দাসূচকভাবে ব্যবহৃত হয়। আসলে এ ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদের অনুগত ডিক্টেটররা আর্থিক ঘুষের বিনিময়ে বৃহৎ বাগান-কৃষিকে (Plantation Agriculture) শোষণে মদদ জোগায়। বিশেষ করে এর অন্তর্র্ভুক্ত ছিল কলার চাষ! অর্থনীতিশাস্ত্র অনুযায়ী Banana Republic হল এমন একটি দেশ, যেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হল রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ। দেশটি পরিচালিত হয় ব্যক্তিগত বাণিজ্যিক উদ্যোগ হিসেবে। এ থেকে মুনাফা করে শাসকশ্রেণী। এ শোষণ সম্ভব হয় রাষ্ট্র ও বিশেষ আনুকূল্যপ্রাপ্ত মনোপলির যোগসাজশে। এসব দেশে সরকারি জমি ব্যক্তিগত শোষণের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহৃত হয়। এ উদ্যোগে কোনোরূপ দায়দেনা হলে তা সরকারি তহবিল থেকে নির্বাহ করা হয়। এরকম একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হয় ভারসাম্যবর্জিত এবং এতে শহর ও গ্রামের দুস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়। জাতীয় মুদ্রার কোনো মূল্য থাকে না। এর ফলে এ রকম দেশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ঋণের জন্য অনুপযুক্ত বিবেচিত হয়।
১৯০৪ সালে লেখক ও’ হেনরি কেবেইজেক্স অ্যান্ড কিংস নামে একটি বই লেখেন। এটি ছিল কাল্পনিক দেশ আঞ্চুরিয়ার কাহিনী। বইটি লেখার পেছনে লেখক অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন মধ্য আমেরিকার দেশ হন্ডুরাসে ছয় মাস অবস্থান করে। বইটির দি এডমিরাল শীর্ষক ছোট গল্পে ও’ হেনরি এই দেশটিকে একটি ক্ষুদ্র সামুদ্রিক Banana Republic হিসেবে উল্লেখ করেন। স্বাভাবিকভাবেই এ ফলটি ছিল এই দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। ও’ হেনরির লেখায় একটি উষ্ণমণ্ডলীয় কৃষি অর্থনীতির দেশের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলেও এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে দেশটি এবং তার প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফল কোম্পানিগুলোর অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে ইউনাইটেড ফুড কোম্পানি, যেটি ছিল একটি বহুজাতিক মার্কিন কর্পোরেশন, তার হাতেই সৃষ্টি হয়েছিল ভূ-রাজনীতির একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে Banana Republic. ইউনাইটেড ফুড কোম্পানি ছাড়াও ছিল সুয়াইমেল ফুড কোম্পানি। এসব কোম্পানি মার্কিন সরকারের কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পেত। ফলে যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছিল তারই নাম Banana Republic.
Banana Republic-এর সূচনা হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৭০ সালে কলা বিক্রির মাধ্যমে। একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী জামাইকা থেকে কলা এনে বোস্টনে শতকরা ১০০০ ভাগ মুনাফায় কলা বিক্রি শুরু করে। অচিরেই আমেরিকানদের কাছে কলা একটি জনপ্রিয় পুষ্টিকর ফল হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ ফলের দাম স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আপেলের তুলনায় অনেক কম ছিল। ১৯১৩ সালে ২৫ সেন্টে আমেরিকায় এক ডজন কলা কেনা যেত। অথচ ওই একই সময়ে ২৫ সেন্টে পাওয়া যেত মাত্র দুটি আপেল। সংক্ষেপে এটাই হল Banana Republic-এর বা কদলি প্রজাতন্ত্রের কাহিনী। এর সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো সামরিক বা অসামরিক সরকারের তুলনা হয় না। সামরিক বাহিনী থেকে আসা জিয়ার সরকারও অন্ধ মার্কিন আনুগত্যের নীতি অনুসরণ করত না। একটি মাত্র দৃষ্টান্তে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। জিয়ার শাসনামলে ইরানে মার্কিনিদের জিম্মি করার ঘটনা ঘটে। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জিমি কার্টার। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সফল কূটনীতির ফলে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। প্রেসিডেন্ট কার্টার প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ফোন করে ইরানের ওপর অবরোধ আরোপের জন্য নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সমর্থন কামনা করলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়া বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই মার্কিনি চাপ পরিহার করলেন। বাংলাদেশ আমেরিকার পক্ষে ভোট দিল না। বাংলাদেশ ভোট দানে বিরত থেকে নিরপেক্ষ অবস্থান নিল। অথচ আমরা জানি এক সময়কার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডালেসের বিঘোষিত নীতি ছিল, যারা আমাদের সঙ্গে নেই তারা আমাদের বিরুদ্ধে। নিরপেক্ষতা ছিল মার্কিন বিরোধিতার শামিল। বুশের আমলে একই নীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অন্য সময় এ নীতি খোলাখুলিভাবে ঘোষণা না করা হলেও অনুক্তভাবে অনুসৃত হতো। জিয়া উত্তর কোরিয়ার কিম উল সুং সরকার কর্তৃক সে দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। উত্তর কোরিয়া আজ একটি কট্টরপন্থী কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত। এতকিছুর পর জিয়াকে কীভাবে Banana Republic-এর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তুলনা করা যাবে? সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে বাংলাদেশের অন্য সরকারগুলোও Banana Republic-এর অবস্থা সৃষ্টি করেনি। বাংলাদেশ কোনোক্রমেই হন্ডুরাসের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে তুলনীয় নয়। বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার স্পৃহা শত প্রতিকূলতার মধ্যে বাংলাদেশকে এমন মর্যাদা দিয়েছে।
ড. মাহ্বুব উল্লাহ্ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন