|
মাহবুব উল্লাহ
mahbub.ullah@yahoo.com |
|
একটি স্ববিরোধী, তবে গণমুখী জীবন
29 August 2017, Tuesday
২৭ আগস্ট লিখছি এই লেখা। দিনটি বহুল আলোচিত রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমদের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী। দু’বছর আগে আজকের এই দিনে সকালবেলা তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কথা ছিল তিনি এ দিনটিতে তার নিজ এলাকা চৌদ্দগ্রামের চিওড়া গ্রামে যাবেন। কাজী জাফর ছিলেন চিওড়ার বিখ্যাত কাজী পরিবারের সন্তান। তার পিতা কাজী আহমদ আলী ছিলেন একজন বিত্তশালী মানুষ।
খুলনা শহরে তার অনেক জমি ও অনেক বাড়ি ছিল। এরকম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও তিনি শোষিত মানুষের রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তার পিতা সন্তানের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ লক্ষ্য করে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না করিয়ে রাজশাহী কলেজে ইতিহাসে অনার্স পড়তে দিয়েছিলেন। সেই সময় একটি ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজশাহী কলেজের বেশ সুনাম ছিল। কিন্তু রাজশাহীতে থাকা সত্ত্বেও কাজী জাফর রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে মেলামেশা করতে অসুবিধার সম্মুখীন হননি। সেখানে তার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের ২য় সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিটুর সংস্পর্শে আসেন। গোলাম আরিফ টিটু মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে এখনও দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ তারই একসময়ের শিষ্য কাজী জাফর আহমদ ইহলোকে আর নেই। কাজী জাফর দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন। এক পর্যায়ে তার কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর তিনি বছর দশেক বেঁচে থেকে ৭৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
কাজী জাফর ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওটা ছিল এক কঠিন সময়। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছিল তখন। সামরিক শাসনের ফলে সব রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা ভাবছিলেন কী করে সামরিক শাসন ভাঙা যায়। সেই সুযোগটি অচিরেই এসে গেল। আইয়ুব খান আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা এবং পাকিস্তানের এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আইনে আটক করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে গোপন শলাপরামর্শ করার। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ফুঁসে উঠল। শহরব্যাপী সরকারবিরোধী মিছিলের উত্তাল জোয়ার বয়ে গেল। রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে রাখা আইয়ুব খানের ফটো চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হল। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হল।
বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজগুলো খোলার পর সরকারবিরোধী আন্দোলনের আরেকটি সুযোগ এসে গেল। সেই সময় পাকিস্তান সরকার অধ্যাপক শরীফের নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়িত করতে শুরু করেছে। বিশাল এ রিপোর্টের ভেতরে কী আছে অনেক ছাত্রছাত্রীই তা জানত না। তবে দুটি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এর একটি হল এইচএসসি পর্যায়ে আটটি ইংরেজি বইয়ের বোঝা। এগুলোর মধ্যে ছিল গদ্য সংকলন, পদ্য সংকলন, দুটি নাটিকা, একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস, ইডিয়ম ও ফ্রেজের বই এবং আরও দুটি আধুনিক ইংরেজি গদ্যের বই। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল দুই বছরের ডিগ্রি কোর্সের পরিবর্তে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স প্রবর্তন। ফলে প্রশ্ন উঠল ডিগ্রি পাস করার জন্য অতিরিক্ত এক বছরের পড়ার খরচ কীভাবে গরিব ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের পক্ষে বহন করা সম্ভব। এ ছাড়া ডিগ্রি পর্যায়ে হিউম্যানিটিজ ও কমার্সের ছাত্রদের জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করা হল। অন্যদিকে ডিগ্রির বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য সভ্যতার ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করা হল। এসবের বিরুদ্ধে প্রথমে কলেজ পর্যায়ে ক্লাস বর্জন ও ধর্মঘটের মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু হল। এ প্রতিবাদ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ এবং নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ। কলেজে যারা এ আন্দোলন শুরু করেছিল তারা দেখল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব ছাড়া এ আন্দোলনকে পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। শুরু হল ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যোগাযোগ। ঢাকা কলেজ থেকে আমি ও আমার বন্ধু সৈয়দ আহসান আলী মধুর ক্যান্টিনে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মরহুম মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বললেন। সিদ্ধান্ত হল কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এ আন্দোলনকে প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হবে। ছাত্রনেতারা আরও বললেন, শিক্ষার আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক অধিকারের আন্দোলন এক ও অবিভাজ্য। এভাবেই শিক্ষার ইস্যুটিকে গণতন্ত্রের ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত করা হল।
১৯৬২-এর ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট ঘোষণা করা হল। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এ অবস্থান ধর্মঘটকে নিষিদ্ধ করে দিল। এরই প্রতিবাদে সিদ্ধান্ত হল ১৭ সেপ্টেম্বর সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে। উল্লেখ্য, এ হরতাল সফল করার জন্য একটি বোমাও ফাটানো হয়নি এবং আগের রাতে গাড়ি-ঘোড়ায় অগ্নিসংযোগ করা হয়নি। হরতাল সফল করার জন্য বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, দোকান কর্মচারী সংগঠন, রিকশা ও বাসচালক সংগঠনসহ নানা পেশা ও শ্রমজীবী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। সব মহলের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া পাওয়া গেল। সচিবালয়ের কর্মচারীরাও সাড়া দিল। কথা ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আমতলায় ছাত্র গণজমায়েত হবে। কিন্তু সেদিন এত লোকের সমাগম হয়েছিল যে, সভা করা সম্ভব ছিল না। শুরু হল স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল। মিছিলকারীরা প্রাদেশিক মন্ত্রী নবাব খাজা হাসান আসকারীর মার্সিডিজ গাড়িটি কার্জন হলের সামনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। এরই সঙ্গে জ্বালিয়ে দেয়া হল পুলিশের একটি জিপ। এর পরপরই পুলিশ গুলি চালায়। নিহতের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে জঙ্গি মিছিল হল। আবারও নবাবপুরে পুলিশ গুলি চালাল। পুলিশের গুলিতে দু’জন নিহত হল। আহত হলেন আরও একজন। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী মরহুম আবদুস সামাদ। সামাদ ভাইয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক জীবনের অনেকটা সময় পার করেছি।
আন্দোলনের এ পর্যায়ে কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্ব অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ওই সময় তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তৃতায় ছাত্রছাত্রীরা কখনও ডুকরে কেঁদে উঠত। আবার কখনও স্লোগানে স্লোগানে বজ্রনিনাদ তুলত। তার বক্তৃতার মোহময়ী আকর্ষণ এতই প্রবল ছিল যে, একদিকে কান্না, অন্যদিকে ক্রোধের উচ্চারণ আকাশ-বাতাসকে কাঁপিয়ে তুলত। তার বক্তৃতায় ছিল ইতিহাসবোধ ও আবেগের অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। তিনি যখন আইয়ুবের সামরিক শাসনের সময় লাহোর দুর্গের অন্ধ্র প্রকোষ্ঠে কমরেড হাসান নাসিরের ওপর নির্যাতনের কাহিনী এবং এর ফলে তার প্রাণত্যাগের ঘটনা বর্ণনা করতেন, তখন চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠত। তিনি বলতেন কমরেড আবদুল বারীর নির্যাতনের কথা। বলতেন বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতের নৃশংস বোমাবর্ষণের কথা। তার বক্তৃতায় অত্যাচারীর অত্যাচার চরম থেকে চরমতর রূপে প্রতিভাত হয়ে উঠত। কার্ল মার্কস মেহনতি মানুষের বিদ্রোহকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলার জন্য এমন বক্তব্যগুণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে মেয়াদ শেষে তিনি টঙ্গীর শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ রকম দুঃসাহসিক শ্রমিক আন্দোলনের নজির খুব একটা নেই। কাজী জাফর আহমদ ১৯৭৭ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করাসহ বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি সংগ্রামের পথ থেকে দূরে সরে গিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। এরশাদের সময় তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি অনুশোচনা করে বলেছিলেন, রাজনৈতিক দর্শন পরিবর্তন করা ছিল তার জীবনের একটি বড় ভুল।
দেশকে আরও কিছু দেয়ার সময় তিনি পাননি। বলতে গেলে তিনিও একটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখে গেছেন। ইতিহাস বিচার করবে তিনি দেশের জন্য কী করেছেন কিংবা কী করতে পারেননি। মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন প্রায় কপর্দকশূন্য। এক সময় অস্ট্রেলিয়ায় তার মেয়ের সঙ্গে চিকিৎসা উপলক্ষে থাকার সময় একটি অস্ট্রেলীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও কাজ করেছেন। তিনি যে জ্ঞানী ও প্রতিভাবান ছিলেন এটাই তার প্রমাণ। বিশ্বনেতাদের অনেকের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, উত্তর কোরিয়ার কিম উল সুং এবং চীনের দেং শিয়াও পিং অন্যতম। রাজনীতিবিদদের জীবন বৈচিত্র্যময়। রাজনীতিবিদ কাজী জাফরের জীবনও ছিল বৈচিত্র্য ও স্ববিরোধিতায় ভরপুর। তারপরও এ দেশের ইতিহাস থেকে তার নামটি মুছে ফেলা সম্ভব হবে না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন