|
মাহবুব উল্লাহ
mahbub.ullah@yahoo.com |
|
নিজের সঙ্গে যুদ্ধ!
12 September 2017, Tuesday
বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে যে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, সেই পরিস্থিতির অবসান কীভাবে হবে, কত দিন নাগাদ হবে, তা নিয়ে অকল্পনীয় অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের সৃষ্টি নয়। ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে তরঙ্গের পর তরঙ্গের মতো রোহিঙ্গারা বাধ্য হয়েছে নিজ জন্মভূমি পরিত্যাগ করে নিছক প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য বাংলাদেশে ছুটে আসতে। বাংলাদেশে এসে এরা যে খুব সুখকর জীবনযাপন করছে এমন কথা বলা যাবে না। অবশ্য ভাষাগত মিল থাকার ফলে এবং দেহাবয়বের মিল থাকায় এদের অনেকে হয়তো বাংলাদেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। এর জন্য তাদের দায়ী করা যাবে না। কারণ যে কোনো বিপন্ন জনগোষ্ঠী শুধুই বেঁচে থাকার জন্য নানারকম কৌশল অবলম্বন করে। রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। ১৯৭৮ সালের পরে কূটনৈতিক উদ্যোগের ফলে বেশকিছু রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফেরত গেছে। এদের মধ্যে অনেকে আবার পরবর্তীকালে অমানুষিক নির্যাতন, নিপীড়নে ও প্রাণভয়ে আবারও বাংলাদেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে।
রোহিঙ্গারা আজ যে নির্যাতন-নিপীড়নের মুখোমুখি হয়েছে, তাকে অনেকে একটি জাতিগোষ্ঠীর নির্মূলকরণ অভিযানের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই তুলনাও সঠিক। মিয়ানমার বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশ। এ কারণে একসময় বার্মা নামক রাষ্ট্রটির নামকরণ করা হয়েছিল ইউনিয়ন অব বার্মা। বার্মার সংবিধানে রোহিঙ্গা ব্যতিরেকে অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। তারপরও বার্মার জাতীয় ঐক্য সুনিশ্চিত করা যায়নি। বিভিন্ন বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে। এসব সশস্ত্র বিদ্রোহ দীর্ঘকাল অব্যাহত থেকেছে। এখনও বিদ্রোহের আগুন পুরোপুরি নিভে যায়নি। পূর্বতন বার্মা এবং আজকের মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর অব্যাহত ক্ষমতার যে দাপট, তার বৈধতা প্রমাণের জন্য জাতিগত বিদ্রোহের অজুহাত দাঁড় করানো হয়েছে। এই সামরিক গোষ্ঠী ফ্যাসিস্ট কায়দায় সব ধরনের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধকে দমন-পীড়নে প্রতিহত করতে নেমেছে। মিয়ানমার এমন একটি দেশ, যে দেশের সামরিক বাহিনী নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। জাতিগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারেরই আদি অধিবাসী। শত শত বছরের ইতিহাস এমন কথাই বলে। একটি দেশের আদি অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা যুগপৎ জাতিগত অধিকার এবং নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এজন্যই রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেও এদের ব্যাপারে কী নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করা হবে, সে সম্পর্কে আমাদের সরকারের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি দেখতে পাই না। হঠাৎ করে শত-সহস্র অভুক্ত এবং সর্বস্বহারা মানুষকে ঠাঁই দেয়ার জন্য কী করণীয়? সেটা কি কখনও ভাবা হয়েছিল? এদের সঠিকভাবে নিবন্ধিত করার জন্য কোনো ব্যবস্থা কখনও গৃহীত হয়েছে বলে মনে হয় না। বর্তমানে প্রযুক্তিগত যে সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান, তার সদ্ব্যবহারের কথাও ভাবা হয়নি আগে। যদি একটি শরণার্থী নিবন্ধন ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হতো, তাহলে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকির পরিমাণ অনেকটাই হ্রাস পেত।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে সরকারের নীতি-কৌশলের মধ্যেও অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। প্রথমদিকে এবং নিকট অতীতে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যখন বানপ্রবাহের মতো শরণার্থীদের ঢল নামল, তখন এই নীতিকে নমনীয় করা হল। ফলে দুই লাখ কিংবা তারও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী ২৪ আগস্টের পর বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। সরকারের তরফ থেকে যৌথ অভিযান চালানোর কথাও মিয়ানমার সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু এই অভিযান কাদের বিরুদ্ধে এবং কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হবে, সেটা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। আমাদের ঘাড়ের ওপর বোঝা খুব ভারি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে একটা গা ছাড়া ভাব লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের আগে তৎপর হয়েছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং তুরস্ক। তুরস্কের ফার্স্টলেডি বাংলাদেশে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে গিয়ে অশ্রুসজল হয়েছেন এবং মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছেন। যেসব দেশের কথা বলা হল, সেসব দেশের অবস্থান সমস্যার মূল ভরকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। এগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া কিছুটা হলেও রোহিঙ্গা সমস্যার আঁচ প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করছে। তুরস্কের ভূমিকা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কেউ কেউ ভাবছেন, তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব পেতে চায়। ফিরে পেতে চায় তুর্কি সালতানাতের হারানো গৌরব। আসলে তুরস্কের মনে কী আছে তা এখনই বলার সময় আসেনি। কেবল ভবিষ্যৎ দিনগুলো বলতে পারে তুরস্ক কতদূর যাবে। তবে এই মুহূর্তে তুরস্ক যতটুকু করেছে তা অবজ্ঞা করার মতো বিষয় নয়। বাংলাদেশ থেকে ভাবা হচ্ছে আরাকানে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো ধরনের নিরাপদ আশ্রয়দ্বীপ গড়ে তোলা যায় কিনা। সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করা যায় কিনা। তবে এসবের আয়োজন করতে বেশ সময় লেগে যাবে। এটা খুবই সত্য যে, পৃথিবীর কোথাও এ ধরনের সমস্যার ত্বরিত সমাধান হয়নি। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং কসোভোর ক্ষেত্রে আমরা তেমনটাই দেখেছি।
রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। এখন বিষয়টি আন্তর্জাতিকীকরণের পর্যায়ে উপনীত। বিশ্বমিডিয়া এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এ ব্যাপারে সরব হয়ে উঠেছে। এটা বাংলাদেশের সংকট লাঘবে সহায়ক হবে বৈকি। তবে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার ওপরও পুরোপুরি আস্থা রাখা যায় না। কারণ শেষ বিচারে এগুলোর আচরণ নির্ভর করবে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো কীভাবে সুতা টেনে ধরবে। ইরাককে কেন্দ্র করে এমবেডেড জার্নালিজমের পরিণতি কী হয়েছে সেটাও আমরা জানি।
নিভৃতচারী মিয়ানমার তার দরজাগুলো যতই খুলে দিয়েছে, ততই সামর্থ্যবান রাষ্ট্রগুলো দেশটির ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। মিয়ানমার একটি সম্পদশালী দেশ। সে দেশের প্রতি সামর্থ্যবান রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহ থাকারই কথা। মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। এসব বিনিয়োগের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের মতো একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থ কতটুকু গুরুত্ব পাবে, সেটাও ভাববার বিষয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারে গিয়ে সে দেশের অনুসৃত নীতির প্রতি সংহতি ঘোষণা করেছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশীর কাছ থেকে কোনোরকম সহানুভূতি পাওয়ার আশা করা যায় না। রুশ বিশেষজ্ঞরা রোহিঙ্গা প্রশ্নটি একটি চীনবিরোধী উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন। চীন তার জ্বালানি সমস্যা লাঘবের জন্য কুনমিং থেকে মিয়ানমারের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করেছে। এ ছাড়া আরাকানসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে বিশাল গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এমনকি আরাকানে বিশাল তেলক্ষেত্রও রয়েছে। চীনের জন্য এসব সম্পদ খুব প্রয়োজনীয়। চীন মালাক্কা প্রণালীর ঝুঁকিপূর্ণ পথ পরিহার করে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে তার জন্য জ্বালানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু আরাকান অঞ্চলে অস্থিরতা তৈরি হলে চীনের পক্ষে জ্বালানিসংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। ঘটনাক্রমে এটাই হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গাদের অনিবার্য পরিণতি। চীন প্রস্তাবিত বিসিআইএন উদ্যোগে যদি ভারত বাগড়া না দিত, তাহলে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি অনেক সুখকর হতে পারত। এ ধরনের উদ্যোগকে টেকসই করার জন্য মিয়ানমারের মতো দেশও রোহিঙ্গা ইস্যু তৈরি না করতে চাপের মুখে থাকত। কিন্তু ভারত অনেকটাই নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে চেয়েছে। ভারত এখনও উপলব্ধি করতে চাইছে না, সংঘাতের চেয়ে সহযোগিতা অনেক বেশি ফলদায়ক।
সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে রোহিঙ্গারাও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এটাকে কী বলা হবে? অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ? নাকি জঙ্গিবাদের উত্থান? ইতিমধ্যে আরসা নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের উত্থানের কথা শোনা গেছে। কারও মতে এটি মিয়ানমার সরকারের তৈরি করা একটি নাটক। আবার কারও মতে এটির বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে আরাকান অঞ্চলটি আগামী দিনে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে। সে রকম কিছু যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশেও এর উত্তাপ প্রবলভাবে অনুভূত হবে। এমনকি দীর্ঘদিন ধরে এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। এরকম সম্ভাব্য বিপজ্জনক অবস্থার জন্য বাংলাদেশ কতটুকু প্রস্তুত? তাই রোহিঙ্গা ইস্যুটি রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডার বিষয় নয়। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ভিত্তিতে সমস্যাটির মোকাবেলায় কী করা যায় বা কী করা উচিত সেটাই সবাইকে ভাবতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হল, যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ অপরিণামদর্শী নীতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য মহাবিপদ ডেকে আনতে পারে। রাষ্ট্র যখন নিজ জনগণের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে ওঠে, তখন তা আর রাষ্ট্রের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এই শিক্ষা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন