|
মাহবুব উল্লাহ
mahbub.ullah@yahoo.com |
|
সেফ জোনের অভিজ্ঞতা কিন্তু সুখকর নয়
19 September 2017, Tuesday
মিয়ানমারের আরাকান রাজ্য থেকে বিতাড়িত, বিধ্বস্ত ও সর্বস্বহারা মানুষগুলোকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশের বোদ্ধা মহলের একটি অংশ আরাকান রাজ্যে নিরাপদ অঞ্চল বা safe yone গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবটি অনেকের কাছেই হয়তো গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। যারা এই প্রস্তাব দিয়েছেন তাদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে এমনটি মনে করার কারণ নেই। গণহত্যাকবলিত একটি মানবগোষ্ঠীকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটাই এখনকার বিবেচ্য বিষয়। সুতরাং নানা ধরনের প্রস্তাব আসতেই পারে। তদুপরি রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য যে সম্ভাব্য বিপদের শঙ্কা তৈরি করেছে, সে কারণেই বিভিন্নমুখী সমাধানের কথা ভাবা হচ্ছে।
safe yone সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যেই বেশকিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। এসব অভিজ্ঞতা বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, রুয়ান্ডা, ইরাক ও সিরিয়াসংক্রান্ত। এগুলোর কোনোটিও আমাদের safe yone গঠনের ওপর আস্থা রাখতে মোটেও উৎসাহিত করে না। অনেকে আবার মনে করছেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর তদারকিতে safe yone গঠিত হলে তেমন কোনো ভয়ের কারণ নেই। কারণ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী safe yone-এ আশ্রয় নেয়া মানুষগুলোকে যে কোনো আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পাবে।
সেব্রেনিসার পর্বতগুলো বেয়ে যতই উপরে ওঠা যাবে ততই দেখা যাবে ওক এবং বিচ বৃক্ষের সঙ্গে মিশে আছে ফার, পাইন এবং স্প্রুস বৃক্ষরাজি। সেব্রেনিসার অবস্থান বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সবচেয়ে পূর্বপ্রান্তে। ১৯৯৫ সালে ফাতিমা ডটবেসিক-ক্লেমপিক নামের একটি মেয়ে এই পর্বতের পাদদেশে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পর্বত বেয়ে পালাচ্ছিল। ফাতিমার কাছ থেকেই জানা গেছে তারা যখন পর্বতের মধ্য দিয়ে পালাচ্ছিলেন তখন তারা জানতেন না, কে বেঁচে আছে কিংবা মারা গেছে অথবা ধরা পড়েছে অথবা কার কপালে কী ঘটেছে। ফাতিমা পরবর্তীকালে একটি ব্রিটিশ চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানকে জানিয়েছিল, সর্বত্র মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রাস্তাঘাট নিহত মানুষের স্তূপে ঢাকা পড়েছে। ১৯৯৫-এর জুলাই মাসে ৮০০০ বসনীয় মুসলিম পুরুষ ও বালকদের হত্যা করা হয়েছিল। নারী ও মেয়েরা অনেকে মৃত্যু থেকে রেহাই পেলেও ধর্ষণ থেকে রক্ষা পায়নি। এসব ঘটনা ঘটেছিল জাতিসংঘ রক্ষী বাহিনীর সামনেই। এ safe yoneটি ছিল নিরপরাধ-অসহায় মানুষের প্রতি জঘন্য এক প্রতারণা। এসব safe yone প্রায়ই শরণার্থীদের জন্য বন্দিশালায় পরিণত হয়। খাদ্যের সরবরাহের পথ বন্ধ হয়ে গেলে শরণার্থীদের উপোস করে মরতে হয়। এসব এলাকা হয় খুবই জনাকীর্ণ। এসব এলাকায় আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা থাকে নিরস্ত্র। জাতিসংঘের বাহিনী এদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। ‘নিরাপদ এলাকা’ কথাটি শুনতে ভালোই লাগে। এ মন্তব্যটি করেছিলেন ওই বছরের অক্টোবরে The NewYork Times-এর কাছে ন্যাটোতে কর্মরত একজন মার্কিন সামরিক অফিসার। তার দৃষ্টিতে শান্তিরক্ষীরা ঘটনা প্রত্যক্ষকারীর চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। তাদের হাতে থাকে না যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ। নিরেট সত্যটি হল, safe yone একটি অলীক চিন্তা। সেব্রেনিসায় যখন হত্যাকাণ্ড হচ্ছিল তখন সেখানে মাত্র ৪০০ হালকা অস্ত্রসজ্জিত এবং রসদের ঘাটতি নিয়ে ডাচ শান্তি রক্ষীরা নগরীটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল।
মূল প্রস্তাবে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বুট্রোস ঘালি সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ৩৭ হাজার শান্তিরক্ষী চেয়েছিলেন। বসনিয়ার safe yoneটি রক্ষার জন্য এ সংখ্যক সৈনিকের প্রয়োজন ছিল; কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ অনুমোদন দিল মাত্র ৭ হাজার ৬০০ শান্তিরক্ষী। safe yone-এর অনেক নাম। যেমন, Safe Area, Humanitarian Corridor এবং Safe Haven। যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এসব নামেই বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। ১৯৯১ সালে ইরাকে এবং ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এগুলোর বাইরেও আরও কিছু দৃষ্টান্ত আছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এ ব্যবস্থা সফল হয়নি। এখন সিরিয়াতে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন এই ধারণা অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরেছে।
গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি অবশ্যই সিরিয়াতে safe yone গড়ে তুলবেন। আমরা জানি, যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ত্যাগ করে অনেক সিরিয়াবাসী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চান না এই শরণার্থীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে পড়ুক। কাজেই এদের দূরে সরিয়ে রাখার জন্যই সিরিয়ার মধ্যেই safe yone গড়ে তোলা। এর ফলে ক’জন নিরীহ বেসামরিক সিরীয় নাগরিক রক্ষা পাবে সে ব্যাপারে অভিজ্ঞতার আলোকে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। এরপর ২২ মার্চ সেক্রেটারি অব স্টেট রেক্স টিলারসন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ‘অন্তর্বর্তীকালীন স্থিতিশীলতার এলাকা’ গড়ে তুলবে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা UNHCR-এর মুখপাত্র ফ্রিস বোইয়ান বলেছেন, সিরিয়ায় একটি চরম ভঙ্গুর অবস্থা বিরাজ করছে। সহজভাবে বোঝা যায় না কী করে সেখানে সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে। এ রকম এলাকা তৈরি করতে হলে মৌলিক সেবা- যথাক্রমে পানি, খাদ্য, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধের ফলে এসব সেবাপ্রদান ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। UNHCR শরণার্থীদের রক্ষা করার জন্য যে কোনো পরিকল্পনার ব্যাপারেই উৎসাহী। কিন্তু বোইয়ানের মতে, সংঘাতপূর্ণ এলাকার পরিস্থিতি খুবই টলমলে। বাস্তব ক্ষেত্রে চোখের পাতা পড়ার আগেই পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট Safe areaগুলো Unsafe হয়ে যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে দশ লাখেরও অধিক শরণার্থী সৃষ্টি হয়েছে। এদের সিংহভাগ রয়েছে বাংলাদেশে। এছাড়াও মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরব এবং ভারতেও এরা অবস্থান করছে। ন্যূনতম মানবিক সহায়তার জন্য নিশ্চিত করতে হবে খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা। আরাকান রাজ্যে এদের জড়ো করে একটি safe yone নামীয় ব্যবস্থা করা হলে ওটা হবে নরকতুল্য। কফি আনানের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, আরাকান রাজ্যে অভ্যন্তরীণভাবে দেড় লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ রয়েছে। এদের বলা হয়, IDP (Internally Displaced Persons)। এরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদের ক্যাম্পের বাইরে যাওয়ার অধিকার নেই। UNHCR তাদের জন্য যে রিলিফ বরাদ্দ দেয় সেটাই তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর UNHCR-এর পক্ষে রিলিফ সরবরাহ বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন যদি শরণার্থীদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে safe yone-এ আনার ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কে নিশ্চয়তা দেবে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সেব্রেনিসার মতো পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।
আমরা বাংলাদেশীরা মিয়ানমারের সৎ প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে চাই। এ দুই দেশের সম্পর্ক ভালো থাকার অর্থ দুই দেশের জন্যই কল্যাণকর। মিয়ানমার রাষ্ট্রটি যদি হৃদয়হীনতা পরিত্যাগ করে তার রোহিঙ্গা অধিবাসীদের নাগরিক অধিকারগুলো সাংবিধানিক নিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে ফিরিয়ে দেয়, তাহলে আমরাও বাঁচব এবং মিয়ানমারও অস্থিতিশীলতা থেকে রক্ষা পাবে। এমন ধরনের নিশ্চয়তার জন্য কাজ করতে হবে বাংলাদেশের সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে। একটি স্থায়ী ও কল্যাণকর পথে না হেঁটে safe yone-র মতো অনিশ্চিত সমাধানের কথা ভাবা বাতুলতা মাত্র। আশা করি সবাই তাদের চিন্তা-ভাবনাকে আরও তীক্ষ্ণ করে তুলবেন।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন